চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। চন্দ্রমল্লিকা জনপ্রিয় একটি মৌসুমী ফুল। ক্রিসমাসের সময় ফোটে বলে একে ক্রিসেন্থিমামও বলা হয়। জাপান ও চীন এর আদি জন্মস্থান। এটি বিভিন্ন বর্ণ ও রঙের হয়। তাই একে ‘শরৎ রানি’ও বলা হয়। বাড়ির আঙিনা, বারান্দা ও ছাদে ফুলটি চাষ করা যায়।

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি

চন্দ্রমল্লিকার চাষের জন্য জলবায়ু :

চন্দ্রমল্লিকা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় ভালো জন্মে। বাংলাদেশে শীতকালই এ ফুল চাষের উপযুক্ত সময়।

চন্দ্রমল্লিকার চাষের জন্য মাটি :

জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে মাটি চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ ৬.০-৭.০ হওয়া জরুরি।

চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি :

বীজ, সাকার ও শাখা কলম থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে শাখা কলম করা শুরু হয়। একবছর বয়সী সবল ডাল থেকে ৮-১০ সেন্টিমিটার লম্বা ডাল তেরছাভাবে কেটে বেডে বা বালতিতে বসিয়ে দিলে তাতে শেকড় গজায়। ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে যখন ফুল দেওয়া শেষ হয়ে যায়। তখন গাছগুলোকে মাটির উপর থেকে ১৫-২০ সেন্টিমিটার রেখে কেটে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর ওসব কাটা জায়গার গোড়া থেকে কিছু সাকার বের হয়। এসব সাকার ৫-৭ সেন্টিমিটার লম্বা হলে মা গাছ থেকে ওদের আলাদা করে ছায়াময় বীজতলায় বা টবে লাগানো হয়। মে-জুলাই মাসে চারাকে বৃষ্টি ও কড়া রোদ থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

চন্দ্রমল্লিকার চারা রোপণ :

শেষবারের মতো নির্দিষ্ট স্থানে কিংবা টবে রোপণের আগে চারাগুলোকে স্বতন্ত্র জমিতে বা টবে পাল্টিয়ে নিয়ে তাদের ফুল উৎপাদনের উপযুক্ততা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। জমি কিংবা টবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় অক্টেবর-নভেম্বর। জাতভেদে ৩০x২৫ অন্তর চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করতে হবে।

চন্দ্রমল্লিকার চাষে সার প্রয়োগ :

চন্দ্রমল্লিকা গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদন শোষণ করে থাকে। এ কারণে জৈব ও রাসায়নিক খাদ্যযুক্ত মাটিতে এ গাছ খুব ভালোভাবে সাড়া দেয়। প্রতি হেক্টরে ১০ টন পঁচা গোবর বা কম্পোস্ট, ৪০০ কেজি ইউরিয়া, ২৭৫ কেজি টিএসপি, ৩০০ কেজি মিউরেট অব পটাশ, ১৬৫ কেজি জিপসাম, ১২ কেজি বোরিক অ্যাসিড ও জিংক অক্সাইড সার প্রয়োগ করতে হবে।

সাকার রোপণের ১০-১৫ দিন আগে পঁচা গোবর বা কম্পোস্ট এবং ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সার ৭-১০ দিন আগে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সাকার রোপণের ২৫-৩০ দিন পর ইউরিয়া সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং বাকি অর্ধেক সার সাকার রোপণের ৪৫-৫০ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে একটু দূর দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।

চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি :

চন্দ্রমল্লিকার বেড ও টব আগাছামুক্ত রাখা উচিত। চারা লাগানোর মাসখানেক পর গাছের আগা কেটে দিতে হয়। এতে গাছ লম্বা না হয়ে ঝোপালো হয়। চারা গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আসলে তা সঙ্গে সঙ্গে অপসারণ করতে হয়। বড় আকারের ফুল পেতে হলে ডিসবাডিং করা উচিত। অর্থাৎ মাঝের কুঁড়িটি রেখে পাশের দুটি কুঁড়ি কেটে ফেলতে হয়। আর মধ্যম আকারের ফুল পেতে চাইলে মাঝের কুঁড়িটি অপসারণ করা উচিত।

চন্দ্রমল্লিকার চাষে সেচ :

চন্দ্রমল্লিকার চারা বিকেলে লাগিয়ে গোড়ার মাটি চেপে দিতে হয়। চারা লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হয়। গাছ কখনো বেশি পানি সহ্য করতে পারে না। তাই পানি এমনভাবে দিতে হবে যেন গোড়ায় বেশিক্ষণ পানি জমে না থাকে। চারা রোপণের আগে এবং পরে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পরিমাণমতো পানি সেচ জরুরি।

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি

চন্দ্রমল্লিকার ঠেস দেয়া :

চন্দ্রমল্লিকা ফুল সাধারণত ডালপালার তুলনায় বড় হয়। তাই গাছের গোড়া থেকে কুঁড়ি পর্যন্ত একটা শক্ত কাঠি পুঁতে দিতে হবে। এতে ফুল নুয়ে পড়বে না। চারা লাগানোর সময় কাঠি একবারেই পুঁতে দেওয়া ভালো। এজন্য জাত বুঝে চন্দ্রমল্লিকা গাছের উচ্চতা অনুযায়ী বাঁশের কাঠি চারার গোড়া থেকে একটু দূরে পুঁতে দিতে হয়।

চন্দ্রমল্লিকার নিয়মিত পরিচর্যা :

ঘন ঘন নিড়ানি দিয়ে সব সময় জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। ঘাস না থাকলেও মাঝে মাঝে মাটিতে নিরানি দিলে গাছ স্বাস্থ‌্যবান হয়। লাগানোর ১০ দিনের মধ্যে মরে যাওয়া চারাগুলি বদলে দিতে হবে। মূল কাণ্ডের অগ্রভাগ ছেঁটে দিয়ে কাক্ষিক মুকুলের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। চারা গুলি যখন ২০ সেমি লম্বা হয়, তখন ছাঁটাই করতে হয়। ছোট ফুলের ক্ষেত্রে আরও এক বার ডগা ভেঙে দিতে হয়। বড় ফুলের গাছগুলি উঁচু হয় এবং এদের শক্ত কাঠি দিয়ে বেঁধে খাড়া করে রাখতে হয়। অবাঞ্ছিত ও অপরিণত কুঁড়ি ভেঙে দিলে কম সংখ্যক বড় আকারের বা বেশি সংখ্যক ছোট ফুল উৎপাদন করা সম্ভব।

চন্দ্রমল্লিকার উন্নত চাষ পদ্ধতি

চন্দ্রমল্লিকার রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ :

শোষক পোকা :

এ পোকা পাতা ও ফুলের রস শোষণ করে। ফলে আক্রান্ত পাতা ও ফুলে দাগ পড়ে। এমনকি ফুল এবং গাছও শুকিয়ে যায়। এ পোকা দমনের জন্য ২ মিলি ম্যালাথিয়ন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

জাব পোকা :

অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয় অবস্থাতেই গাছের নতুন ডগা বা ফুলের রস চুষে খায়। এটি গাছের বৃদ্ধি এবং ফলনে মারাত্মক ক্ষতি করে। নোভাক্রন (০.১%) বা রগর (১%) প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়।

পাউডারি মিলডিউ :

এ রোগ হলে গাছের পাতা ধূসর হয়ে যায়। পাতার ওপরে সাদা সাদা পাউডার দেখা যায়। টিল্ট ২৫০ইসি ০.৫ মিলি বা ২ গ্রাম থিয়োভিট প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

চন্দ্রমল্লিকার ফলন :

ভালো ফলন হলে বিঘা প্রতি প্রায় তিন লাখ ছোট চন্দ্রমল্লিকা ফুল পাওয়া যায় যার ওজন প্রায় দুই টন এর মত এবং বড় চন্দ্রমল্লিকা ফুল পাওয়া যায় প্রায় ৭৫ হাজার।

চন্দ্রমল্লিকা ফুল তোলা :

চন্দ্রমল্লিকা ফুলের কুঁড়িতে রং এলেই ফুল তোলা যায়। পুষ্প দণ্ডের নিচের ১০ সেমি থেকে পাতা ছেঁটে ফেলতে হয়। ফুল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা সংরক্ষক ও ব্যাকটেরিয়ানাশক মেশানো পানিতে কিছু সময় রাখতে হয়। গাছে ২৮ থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত ফুল তাজা থাকে। স্পর্শ জনিত কীটনাশকের দ্রবণে কাটা ফুল আধ ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে তারপর শুকিয়ে রাখা উচিত। প্লাস্টিকে মুড়ে -০.৫ ডিগ্রি –০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চন্দ্রমল্লিকা ফুল প্রায় দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত হিম ঘরে মজুত করে রাখা যায়‌।

পাঠ—৮.৬ : চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষ

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment