জৈব পদার্থের গুরুত্ব

জৈব পদার্থের গুরুত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান – ১২০৪ কোর্সের ইউনিট ৪ এর,  ৪.২ নম্বর পাঠ।

বাংলাদেশের মৃত্তিকার শ্রেণিগত পরিচিতি , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৫ , পাঠ ৫.২

জৈব পদার্থের গুরুত্ব

জৈব পদার্থের সংজ্ঞা :

উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবশিষ্টাংশ, অণুজীব ও মৃত্তিকাস্থিত জীবের কোষকলা বিযোজিত (Decomposed) হয়ে যে গাঢ় দ্রব্য অবশিষ্ট থাকে তাকে মৃত্তিকা জৈব পদার্থ বলে। জৈব পদার্থকে মৃত্তিকার প্রাণ বলা হয়।

জৈব পদার্থের উৎস:

অসংখ্য উৎস থেকে জৈব পদার্থ মৃত্তিকায় মজুদ হয়। এগুলো হচ্ছে ফসলের অবশিষ্টাংশ, কান্ড, পাতা, সবুজ সার, গোবর, খৈল, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, ডাস্টবিনের আবর্জনা, ঘরবাড়ীর আবর্জনা, পরিত্যক্ত কাগজ, শহর বন্দরের আবর্জনা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর মল ও ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য বন জঙ্গলে পরিত্যক্ত পাতা, হার্ব, ঘাসের শিকড়, ঘাস, ধনচে, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রটোজোয়া, কেঁচো, শৈবাল, প্রভৃতির মৃতদেহ, মেরুদন্ডী ও অমেরুদন্ডী প্রাণীর মৃতদেহ, কলকারখানার বিশেষ বিশেষ কাঁচামাল প্রভৃতি ।

জৈব পদার্থের গুরুত্ব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.২

মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব অপরিসীম। জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়।

ভৌত গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

১। মৃত্তিকার রং ধূসর, গাঢ় ধূসর, বাদামী, গাঢ় বাদামী, কিংবা কাল করতে সাহায্য করে ।

২। মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলী যেমন ঘনত্ব, পানি ধারণ, বুনট, রন্ধ্রতা ইত্যাদি জৈব পদার্থের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।

৩। মৃত্তিকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

8। মৃত্তিকায় বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে।

৫ ৷ মৃত্তিকার সংযুক্তি ও দলা উন্নত করে।

৬। পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় ও পানির অপচয় রোধ করে।

৭। মৃত্তিকার উপরিভাগে আস্তরণ তৈরি হওয়া বন্ধ রাখে।

৮বেলে ও কাদা মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায়।

৯। ভূমিক্ষয় রোধ করে।

১০। দুর্বহ (হেডী) এঁটেল মাটি সুবহ (হালকা) করে তোলে।

 

মৃত্তিকার রাসায়নিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

১। উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান মজুদ রাখে এবং প্রয়োজনমত সরবরাহ করে। কারণ জৈব পদার্থকে উদ্ভিদের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২। মৃত্তিকা নাইট্রোজেনের প্রায় ৯৮% বিভিন্ন জৈব যৌগে থাকে যা উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য

৩। জৈব এসিড ও কার্বনিক এসিড তৈরি করে মৃত্তিকার ক্ষারকত্ব কমায়।

8। চুন বা রাসায়নিক সার প্রয়োগে মৃত্তিকায় যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে তা প্রশমিত করতে জৈব পদার্থ বাফার হিসেবে কাজ করে।

৫। সার ও মৃত্তিকাস্থিত অন্যান্য উপাদান বা পুষ্টি উপাদানের মধ্যে সুষম সম্পর্ক বজায় রাখে।

৬। সার ও অন্যান্য খনিজ হতে যে সকল পুষ্টি উপাদান মুক্ত হয় জৈব কোলয়েড সেগুলো শক্তভাবে আটকে ধরে রাখে ফলে চুয়ানী ক্ষয় কমে আসে।

৭। জৈব পদার্থ বিয়োজনের ফলে যে সব আয়ন মুক্ত হয় তা উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক।

৮। মৃত্তিকায় ক্যাটায়ন বিশেষ করে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, এমোনিয়াম প্রভৃতির বিনিময় ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গাছের পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বাড়ায়।

৯। পেস্টিসাইড ব্যবহারে মৃত্তিকায় যে বিষ জমা হয় জৈব পদার্থ ঐ সব বিষাক্তদ্রব্য শুষে নেয় ।

১০। সেলুলোজ ও হেমিসেলুলোজের রাসায়নিক প্রকৃতি মাটির পানি শোষণ ত্বরান্বিত করে।

১১। অম্ল মাটিতে জৈব পদার্থ লৌহ, এলুমিনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ এর সাথে বিক্রিয়া করে স্থায়ী কমপক্ষে গঠন করে ফলে ফসফরাস ফিক্সেশন বাধা পেয়ে ফসফরাসের সহজলভ্যতা বেড়ে যায়।

১২। মৃত্তিকায় জারণ ও বিজারণ বিক্রিয়ায় অসামান্য প্রভাব ফেলে ।

১৩। জৈব পদার্থে কার্বন, হাইড্রোজেন, আক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস ও অন্যান্য।

 

মৃত্তিকার জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

১। জৈব পদার্থের প্রধান উপকরণ হচ্ছে কার্বন। কার্বন জারিত হওয়ার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় সে শক্তি গ্রহণ করেই মাটিতে জীবাণুরা তাদের কার্যক্ষমতা রক্ষা করে। যে মাটিতে যত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়, সে মাটিতে তত অধিক জীবাণু থাকে। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাইকোরাইজা, শেওলা, একটিনোমাইসিটিস প্রভৃতি অণুজীব মৃত্তিকার উর্বরতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। মৃত্তিকায় জৈব পদার্থ না থাকলে এসব জীবাণুর সংখ্যা কমে যায় ফলে মৃত্তিকার উর্বরতা ব্যহত হয়।

২। কেঁচো, পিঁপড়া, উইপোকা, ইঁদুর, সেন্টিপেড ইত্যাদি জীব জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। এরা মাটিতে গর্ত করে, ফলে শিকড় অধিক পরিমাণ অক্সিজেন পায়, গাছের বৃদ্ধি ও সতেজতা বাড়ে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহজে বের হয়ে যেতে পারে।

৩। মৃত্তিকা জৈব পদার্থ মৃত্তিকা অণুজীবের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।

8। জৈব পদার্থস্থিত প্রোটিন মৃত্তিকাস্থ অণুজীব দ্বারা ভেঙ্গে বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করে। এনজাইমের সাহায্যে এমোনিয়াম যৌগ তৈরি করে ও সর্বশেষে নাইট্রেটে রূপান্তরিত হয়। ফলে গাছের পক্ষে এমোনিয়াম ও নাইট্রেট গ্রহণ সহজতর হয়। মৃত্তিকা জৈব পদার্থ উল্লিখিত অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া) সংখ্যা বাড়ায়।

জৈব পদার্থের গুরুত্ব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.২

 

গাছপালার উপর জৈব পদার্থের প্রভাব বা গুরুত্ব:

জৈব পদার্থ গাছপালার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি হলে কোন গাছপালা ভালভাবে বাড়তে পারে না এবং ফসলের ফলনও কমে যায়। কোন কোন গাছ জৈব নাইট্রোজেনও গ্রহণ করতে পারে। তবে পরিমাণে অতি সামান্য, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতি সামান্য অংশ পূরণ করতে পারে। জৈব পদার্থ গাছের বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অজৈব নাইট্রোজেন ও সালফার সরবরাহে সহায়তা করে। তাছাড়া ইহা কার্বন, হাইড্রোজেন এবং পানিরও অন্যতম উৎস।

জৈব পদার্থ শুধু যে গাছপালার খাদ্যের উৎস তা নয়, ইহা মৃত্তিকায় ভিটামিন ও হরমোন জাতীয় পদার্থেরও যোগান দেয়। জৈব পদার্থ বিয়োজিত হয়ে এ সকল পদার্থ মুক্ত হয়। পরিমাণের দিক থেকে সামান্য হলেও গাছপালার বৃদ্ধিতে অসামান্য প্রভাব ফেলে। জৈব পদার্থ সরাসরি মালচিং হিসাবেও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

আবার গাছপালা লাগিয়ে গোড়ায় জৈব পদার্থ মালচিং আকারে দেয়া হয় যাতে গোড়ার মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে না যায়। যুগ যুগ ধরে চাষাবাদের ফলে মাটির যে গুণগত মান হ্রাস পায় এবং ফসলের ফলনের ওপর প্রভাব ফেলে জৈব পদার্থ মাটির এ সুস্থতা নিশ্চিত করে। বীজের অংকুরোদগম, শিকড়ের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন জৈব পদার্থ দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়।মৌলিক পদার্থ থাকে যা উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

জৈব পদার্থের গুরুত্ব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.২

কখনও কখনও জৈব পদার্থ গাছপালার পক্ষে অনিষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। জৈব পদার্থ থেকে ডাই হাইড্রোস্টিয়ারিক এসিড নামক পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে যা গাছপালার পক্ষে ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি জমে এরূপ পদার্থ উৎপন্ন হয়। সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন, চুন প্রয়োগ, যথাযথ সার ও উন্নত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে এ অবস্থার উন্নতি হয় এবং ক্ষতিকর যৌগগুলো আপনা থেকে নষ্ট হয়। মৃত্তিকা জৈব পদার্থের সুষ্ঠু পচনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।

সূত্র:

  • জৈব পদার্থের গুরুত্ব , পাঠ ৪.২, ইউনিট ৪ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি।

আরও দেখুন:

Leave a Comment