ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ , ধান ক্ষেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে বর্ষার পানি জমে থাকে যা নিঃসন্দেহে মাছ চাষের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ। ধান ক্ষেতে ব্যবহৃত সার, গোবর ইত্যাদি, পানি ও মাটির সাথে মিশে প্রাকৃতিকভাবে খাবার তৈরি করে যা মাছ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন চাষি ধান উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়তি আয়ও পেতে পারে । আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা সম্ভব । তবে আমন মৌসুমে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ বেশী লাভজনক ।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

সেচ সুবিধার আওতাধীন যে সমস্ত ধান জমি রয়েছে সেসকল জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প পরিশ্রমে ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু অর্থই যোগান দেয় না সেই সাথে তাদের পুষ্টিও নিশ্চিত করে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা:

  • একই জমি থেকে ধানের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায় সুতরাং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
  • ধান ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে এবং অনিষ্টকারী পোনা-মাকড় মাছ খায়ে ফেলে। ফলে ধানক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
  • মাছের চলাফেরার মাধ্যমে ক্ষেতের কাদামাটি উলটপালট হয় ফলে জমি হতে ধানের পক্ষে অধিকতর পুষ্টি গ্রহণযোগ্য হয়।
  • মাছের বিষ্টা সার হিসাবে ধান ক্ষেতের উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে।

ধান ক্ষেতে চাষ পদ্ধতি:

সাধারণত: দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়:

১. ধানের সাথে মাছের চাষ:

  • একই জমিতে ধান ও মাছ একত্রে চাষ করা হয়।
  • আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে যেখানে ৪-৬ মাস বৃষ্টি পানি জমে থাকে সেখানে ধানের সাথে মাছ চাষ করা যায়।
  • বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধার আওতাধীন জমিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।

 

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

২. ধানের পরে মাছের চাষ

  • বাংলাদেশের যে সমস্ত জমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয় এবং রোপা আমন চাষ করা হয় না সেখানে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।

মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন:

  • সব ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয়। ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে জমি নির্বাচনের ওপর। জমি নির্বাচনের সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জমি নির্বাচনের সময় বিবেচনাধীন বিষয়গুলো:-
  • সাধারণত: দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এটেল মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা এবং উর্বরা শক্তি বেশি বিধায় এসব মাটির জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
  • অতি উঁচু অর্থাৎ পানি ধরে রাখাতে পারে না এবং অধিক নিচু জমি অর্থাৎ সহজেই প্লাবিত হয় সেসব জমি মাছ চাষের অনুপযোগী।
  • বন্যার পানি প্রবেশ করে না এরূপ উঁচু জমিই মাছ চাষের উপযোগী।
  • বোরো মৌসুমে চাষের ক্ষেত্রে সেচের সুবন্দোবস্ত থাকতে হবে।

ধান ক্ষেত প্রস্তুতকরণ:

  • যথাযথভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধান চাষের প্রচলিত নিয়মে জমি প্রস্তুত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন ক্ষেত আগাছামুক্ত হবে তেমনি জমি কাদা হয়ে ধান রোপণের উপযুক্ত হবে।
  • ক্ষেতের চারপাশের আইল কমপক্ষে ০.৩ মিটার বা ১ ফুট উঁচু ও ১ ফুট চওড়া করে তৈরি করতে হবে। তবে আইলের উচ্চতা নির্ভর করবে জমির অবস্থানের ওপর।
  • জমির যে অংশ অপেক্ষাকৃত ঢালু সে অংশে জমির শতকরা ২-৩ ভাগ এলাকা জুড়ে কমপক্ষে২-৩ ফুট গভীর একটি ডোবা খনন করতে হবে, যা ক্ষেতের কোণায়, পাশে বা মধ্যে হতেপারে ।
  • শুঙ্ক বা খরা মৌসুমে অথবা অন্য কোনও কারণে জমির পানি শুকিয়ে গেলে উক্ত গর্ত মাছের জন্য সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
  • জমি তৈরির জন্য প্রচলিত নিয়মেই জমিতে সার, গোবর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ধান রোপণ করতে হবে।

ধানের জাত নির্বাচন:

ধানের জাত নির্বাচনে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:-

  • সমন্বিত ধান-মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে জাতের ধান বেশী পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং ফলনও বেশি সেই জাত নির্বাচন করতে হবে।
  • আমন মৌসুমের জন্য বি আর-৩ (বিপব), বি আর-১১ (মুক্তা), বি আর-১৪ (গাজী) এবং বোরো মৌসুমের জন্য বি আর-১৪ ও বি আর-১৬ ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উপযোগী।
  • ধানের সাথে মাছের চাষের জন্য ধানের চারা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. রাখাতে হবে।

মাছের প্রজাতি নির্বাচন:

মাছের প্রজাতি নির্বাচন লক্ষণীয় বিষয়সমূহ:-

  • অগভীর পানিতে চাষ করা যায় এমন প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে।
  • কম অক্সিজেনে বাঁচতে পারে এমন প্রজাতির মাছ।
  • দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- রাজপুঁটি, মিরর কার্প, মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া ইত্যাদি ।

মাছের পোনা মজুত:

  • ধান ক্ষেতে ধান রোপণের পরপরই পোনা মজুদ করতে হয় না, রোপণের পর ধানের চারা মাটিতে শিকড় মেলে শক্ত হতে ও ধানের কুশী গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে । এ জন্য১৫-২০ দিন পর ধান ক্ষেতে মাছের পোনা মজুদ করতে হয়।
  • জমিতে কমপক্ষে ১০-১৫ সেমি. পানি থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১৫-২০টি ৫-৭ সেমি.আকারের রাজপুঁটি/মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া/ মিরর কার্পের পোনা ছাড়তে হবে।
  • উভয় জাতের মাছ একত্রে চাষ করার ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৮টি রাজপুঁটি ও ৭টি মিরর কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে।
  • সকালে অথবা বিকালে অর্থাৎ যখন পানি ঠাণ্ডা থাকে তখন ক্ষেতে পোনা মজুদ করা উচিত। এ নিয়মে পোনা মজুত করলে ধান চাষকালীন সময়ের অর্থাৎ ১০০-১২০ দিনের মধ্যেই মাছ খাওয়ার ও বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে থাকে।
  • মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়ার মিশ্র চাষ না করে একক চাষ করতে হবে।

ধান ক্ষেতে পানি ব্যবস্থাপনা:

  • মাছ ধান ক্ষেতে থাকা অবস্থায় সবসময় পানি থাকতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষেতে পানির গভীরতা ১০-১৫ সেমি. থাকতে পারে, তবে মাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির গভীরতা বাড়াতে হবে।
  • যদি কোনও সময় বাইরে থেকে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়, তখন পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানিসরবরাহ করতে হবে।
  • ইঁদুর, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণী যাতে আইলে গর্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমে ক্ষেত প্লাবিত হওয়ার আশংকা থাকলে অপেক্ষাকৃত ঢালু অংশে আইলের কিছু জায়গা ভেঙে বাঁশের বানা বা ছাঁকনিযুক্ত পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাবারই মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। তবে প্রাকৃতিক খাবারের অপর্যাপ্ততা পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনবোধে মাছের খাবার হিসেবে ক্ষুদি পানা বাচালের কুঁড়া সরবরাহ করা যেতে পারে।
  • প্রচলিত নিয়মে জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করা যেতে পারে।
  • ধান ক্ষেতের মাছকে ডোবা বা নালায় স্থানান্তরের পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের পর বৃষ্টি হলে ৫-৭ দিন পর মাছগুলোকে ক্ষেতে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন পর সেচের মাধ্যমে পুনরায় মাছকে সমস্ত জমিতে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের উপযুক্ত সময় হলো বিকেল বেলা কারণ এ সময় ধানের পাতা শুঙ্ক থাকে।
  • পাশের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কীটনাশক মিশ্রিত পানি কোনক্রমেই মাছের ক্ষেতে প্রবেশ না করে।
  • ধান রক্ষার জন্য জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছকে আইলের সাহায্যে গর্তে আটকে রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত গরম বা খরার সময় ক্ষেতে গর্তের পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য গর্তের কিছু অংশে কচুরিপানা রাখতে হবে ।
  • ক্ষেতের পানির প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন

 

ধান ক্ষেতে মাছ আহরণ:

  • ধান পাকার পর ক্ষেতের পানি কমিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে, এসময় মাছ আস্তে আস্তে ডোবায় চলে যাবে এবং মাছ ধরতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে ৩-৪ মাসে হেক্টরপ্রতি ৩২৫-৩৫০ কেজি মাছ এবং ২.০-২.৫ টন মাছের ফলন পাওয়া যায়।
  • অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ধানের সাথে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন গড়ে প্রায় শতকরা১৫ ভাগ বেশি হয়। এতে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

পরামর্শ:

  • ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারে সর্তক থাকতে হবে।
  • অতি বৃষ্টিতে যেন ধান ক্ষেত প্লাবিত না হয় অথবা খরায় ধান ক্ষেত শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • চাষিকে দৈনিক সকাল-বিকালে ধানক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment