ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৬

ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৬ , ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক কারণ দ্বারা উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রভাবিত হয়। এই কারণসমূহের কয়েকটি
নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের দ্বারা। সর্বশেষ আবিষ্কৃত বাহ্যিক প্রভাবক সমূহের একটি হচ্ছে দিনের দৈর্ঘ্য।

ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৬

প্রযুক্তিগতভাবে ইহা পরিচিত ফটোপিরিয়ড নামে। আলোক কাল বা ফটোপিরিয়ডে উদ্ভিদের সাড়া প্রদানকে বলে ফটোপিরিয়ডিজম। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে পুষ্পিত ও ফলবান উদ্ভিদে পরিণত হওয়ার জন্য আলোক ও অন্ধকারের আপেক্ষিক স্থিতিকালের প্রতি উদ্ভিদের সংবেদনশীল তাকে বলে ফটোপিরিয়ডিজম। আলোর স্থিতি বা মেয়াদকাল গাছের বৃদ্ধিও পুষ্পায়ণে প্রভাব বিস্তার করে।

ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৬

আলোর মেয়াদকাল যত দীর্ঘ হবে পাতায় পতিত মোট আলোর পরিমাণও তত বেশী হবে। গাছের সবুজাংশে ধারণকৃত আলোর পরিমান যতবেশী হবে, গাছের বৃদ্ধিও তত বেশী হবে। ফসলের আলো সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে ক্রান্তীয় দিবা দৈর্ঘ্য নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন নির্দিষ্ট উদ্ভিদে ফুল ফোটার সূচনার জন্য একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘে্যর দিবালোক থাকে যা অনেক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে নিম্নতম মাপকাঠি, আবার অনেক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে উচ্চতম মাপকাঠি হিসাবে কাজ করে তাকে ক্রান্তীয় দিবা দৈর্ঘ্যে বলে। গবেষণায় দেখা গেছে আলোক সংবেদনশীল অনেক উদ্ভিদের ফুল ফোটার জন্য দিবা দৈর্ঘে্যর উচ্চতম মাপকাঠি ১২ ঘন্টা।

আবার অনেক উদ্ভিদে নিম্নতম মাপকাঠি ১২ ঘন্টা। কাজেই যেসকল উদ্ভিদে দিবা দৈর্ঘ্যে ১২ ঘন্টার যত কম হবে তত দ্রুত ফুল ফুটবে। একইভাবে যে সকল উদ্ভিদে ফুল ফোটার জন্য দিবা দৈর্ঘ্যের জন্য নিম্নতম
মাপকাঠি ১২ ঘন্টা সে সকল উদ্ভিদে দিবা দৈর্ঘ্যে ১২ ঘন্টার যত বেশী হবে তত দ্রুত ফুল ফুটবে।

আলোকের দৈনিক স্থিতিকাল অনুসারে গার্নার ও এ্যালার্ড উদ্ভিদকে দুইভাগে ভাগ করেন—

১. আলোক সংবেদনশীল উদ্ভিদ;
২. আলোক অসংবেদনশীল উদ্ভিদ।
১. আলোক সংবেদনশীল উদ্ভিদ : যে সকল উদ্ভিদের ফুল উৎপাদনের জন্য দিনের আলো গুরুত্বপূর্ণ সে সকল উদ্ভিদকে আলোক সংবেদনশীল উদ্ভিদ বলে।

যেমন— চন্দ্রমল্লিকা, ব্রি ধান ৩৪।

এদেরকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় :

১) খাটো দিবা দৈর্ঘ্যের উদ্ভিদ : যে সকল উদ্ভিদের ফুল উৎপাদনের জন্য কম দিবা দৈর্ঘ্যের প্রয়োজন তাদেরকে খাটো দিবা দৈর্ঘ্যের উদ্ভিদ বলে। এক্ষেত্রে এ সকল উদ্ভিদের জন্য রাতের দৈর্ঘ্য যত অধিক হবে এ সকল উদ্ভিদ তত দ্রুত ফুল ধারণ করবে। দিনের দৈর্ঘ্য ১২ ঘন্টার বেশি হলে এ সকল উদ্ভিদের ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই দিনের দৈর্ঘ্য ১২ ঘন্টা অপেক্ষা যত কম হবে এসব উদ্ভিদের তত তাড়াতাড়ি ফুল ফুটবে। যেমন: শীতকালিন শাকসবজি ও ফুল , তামাক, সয়াবিন, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কসমস ইত্যাদি।

ধান চাষ ৩ ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৬

 

২) দীর্ঘ দিবা দৈর্ঘ্যের উদ্ভিদ : যে সকল উদ্ভিদের ফুল উৎপাদনের জন্য বেশি দিবা দৈর্ঘ্যের প্রয়োজন হয়। তাদেরকে দীর্ঘ দিবা দৈর্ঘ্যের উদ্ভিদ বলে। সাধারণত এসব উদ্ভিদের ফুল উৎপাদনের জন্য দৈনিক ১২ ঘন্টার বেশি দিবা দৈর্ঘ্যের প্রয়োজন। কাজেই দিবা দৈর্ঘ্য ১২ ঘন্টা অপেক্ষা যত বেশি হবে এ সকল উদ্ভিদের তত দ্রুত ফুল উৎপাদন হবে। বসন্তকালীন শস্যসমূহ, আলু, মূলা, বাঁধাকপি, পালংশাক, লেটুস, যব, ঝিঙা, মটর, ছোলা, বার্লি ও অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন ফুল এর উদাহরন।

২. আলোক অসংবেদনশীল বা দিবা দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ উদ্ভিদ : সে সকল উদ্ভিদের ফুল উৎপাদনের জন্য দিবা দৈর্ঘ্যের হ্রাস বৃদ্ধি কোন প্রভাব বিস্তার করে না তাদেরকে আলোক অসংবেদনশীল বা দিবা দৈর্ঘ্য নিরপেক্ষ উদ্ভিদ বলে। প্রতিদিন ৮১০ ঘন্টা বা সর্বক্ষণ আলো প্রয়োগ সত্ত্বেও এদের ফুল ধারণের কোনরূপ সময়ের পরিবর্তন হয় না। যেমন— চিনা বাদাম, টমেটো, মরিচ, ঢেঁড়স, ভূট্টা, বি আর—৩ ধান, তুলা, শসা, কয়েক প্রকারের কুমড়া ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা—নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আলোক পর্যায়ের প্রভাবেই উদ্ভিদ যৌন—অঙ্গ গঠন করে ফুল এবং ফল উৎপাদন ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু পরবতীর্কালে আলোক—পর্যায়ের পরিবর্তন ঘটালেও ফটোপিরিয়ডিজমের উপর কোন প্রভাব দেখা যায় না। এই অবস্থাকে বলা হয় “আলোককালীন আবেশ”।

উপরোক্ত উদ্ভিদ ছাড়াও গার্ণার ও এলার্ড ১৯৪০ সালে মধ্যবতীর্ উদ্ভিদ নামে এক প্রকার উদ্ভিদের বর্ণনা দেন। এ সকল উদ্ভিদ প্রত্যহ ১২—১৪ ঘন্টা সময়কাল ব্যাপী আলো পেলে স্বাভাবিক সময়ে ফুল প্রদান করে। এই সময় কালের অধিক বা অল্প সময় আলো দ্বারা প্রভাবিত হলে প্রজনন বন্ধ হয়ে যায়।

ফটোপিরিয়ডিজমের তাৎপর্য ব্যবহারিক উদ্ভিদে ফটোপিরিয়ডিজম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। কারণ, এই নীতি অনুসরণের মাধ্যমে এক ঋতুর শস্য অন্য ঋতুতে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এক ঋতুর শস্য অন্য ঋতুতে উৎপাদন করা সম্ভব হওয়ায় কৃষিভিত্তিক দেশে খাদ্য সমস্যার অনেকাংশে সমাধান করে সামগ্রিক অর্থনীতির বুনিয়াদ মজবুত করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশের ফসল মৌসুম শস্য উৎপাদন প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব ছাড়াও শস্য মৌসুম দ্বারা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত বিশেষ বিশেষ ফসলের জন্য বিশেষ বিশেষ মৌসুম উপযোগী। শস্য উৎপাদন বিচারে বাংলাদেশে প্রতি ছয় মাসকে এক মৌসুম ধরে সমগ্র বছরকে দু’টি প্রধান শস্যমৌসুমে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা—

ধান চাষ ১ ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৬

১. রবি মৌসুম : বাংলাদেশে রবি মৌসুম নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল (মধ্য আশ্বিন—মধ্যে চৈত্র) পর্যন্ত বি¯ৃত। বাংলাÍ দেশে এটাই শুষ্ক মৌসুম। এই মৌসুমে সাধারণত বষ্টি বিরল বৃ লে ফসলের আবাদের জন্য পানিসেচ নিতান্তই প্রয়োজন। শুষ্ক এবং অনার্দ্র আবহাওয়ায় ও অল্প তাপমাত্রায় রবিশস্য উত্তমরূপে জন্মায়। ছোলা, মসুরি, খেসারি প্রভৃতি কয়েকটি রবিশস্য সেচ ছাড়াও চাষ করা যেতে পারে। এদের বৃদ্ধির জন্য মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা সংরক্ষণই যথেষ্ট।

সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে— যে সকল শস্য তাদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং ফুল, ফল উৎপাদনের অধিকাংশ সময় রবি মৌসুমে অতিবাহিত করে তাদেরকে রবিশস্য বলা হয়ে থাকে।

উদাহরণ : শীতকালীন ধান, গম, গোল আলু, সরিষা, বার্লি, তামাক, মটর, ছোলা, মসুরি, শালগম, গাজর, বীট, টমেটো, সীম, লাউ, পালং শাক, ধনে প্রভৃতি।

২. খরিফ মৌসুম : মে থেকে অক্টোবর পর্যš Í (মধ্য চৈত্র—মধ্য আশ্বিন) এই মৌসুমের শস্য সময়সীমা বি¯ৃÍত। বাংলাদেশে এটাই উষ্ণতম মৌসুম। বৃষ্টিপাতের প্রাচুর্য এই শস্যমৌসুমের বৈশিষ্ট্য এবং প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাতের ফলেই এই মৌসুমে পানিসেচের তেমন প্রয়োজন হয় না। দক্ষিণ—পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের গুরুতেই এই

মৌসুমের আগমন হয় এবং আর্দ্রতা বিহীন উত্তর—পূর্বে বায়ু প্রবাহ এর সমাপ্তি ঘোষণা করে। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে— “যে সকল শস্য তাদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং ফুল—ফল উৎপাদনের অধিকাংশ সময় বষার্ মৌসুমে অতিবাহিত করে তাদেরকে খরিপ শস্য বলা হয়।”উদাহরণ : আউশ ধান, পাট, কলা, চাল কুমড়া, করলা, কাকরোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, ধুন্দল, মিষ্টি কুমড়া ঢেঁড়শ, পটল প্রভৃতি।

Capture 1 7 ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৬Capture 62 ফসলের আলোক সংবেদনশীলতা ও ফসলের মৌসুম , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৬

খরিফ—১, খরিফ—২ ও রবি মৌসুম
চাষাবাদ পদ্ধতির বিজ্ঞানসম্মত আধুনিকায়নের ফলে কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রচলিত রবি ও খরিপ ঋতুর ধারণাকে পুনবিন্যাস করে তিনটি শস্য মৌসুমে ভাগ করেছেন। এগুলো হল খরিপ—১, খরিপ—২ বা বর্ষা মৌসুম ও রবি মৌসুম ।
খরিফ—১ : এই মৌসুমের বি¯ৃÍতি মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত। এই মৌসুমে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়। এই সময়ে তাপমাত্রা থাকে অধিক। শস্য উৎপাদনের জন্য সেচের প্রয়োজন অল্প। এই সময়ে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য থাকে প্রায় সমান সমান। শিলাবৃষ্টিতে শস্যহানির আশঙ্কা বেশি থাকে। আউশ ধান, পাট, ভূট্টা, কাউন, তিল, মিষ্টি কুমড়া প্রভৃতি খরিপ—১ মৌসুমের ফসল।

খরিফ—২ : এই মৌসুমের বিস্তৃতি জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এই সময়ে বৃষ্টি—পাতের পরিমাণ প্রচুর। বায়ুমন্ডলে এই সময়ে আর্দ্রতা থাকে অনেক বেশি। প্রায় সারাক্ষণই আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। শস্য উৎপাদনের পানিসেচের কোন প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে আবদ্ধ পানি অপসারণের জন্য নিষ্কাশনের প্রয়োজন হতে পারে। এই সময়ে ফসলে পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের উপদ্রব বেশি হয়। আমন ধান, ভূট্টা, মাসকলাই, মুগকলাই, প্রভৃতি খরিফ—২ মৌসুমের ফসল।

রবি মৌসুম : এই মৌসুমের বি¯ৃÍতি নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এই মৌসুমে বৃস্টিপাতের পরিমাণ নগন্য। শস্য উৎপাদনের জন্য এই ঋতুতে পানি সেচের প্রয়োজন হয়। এই ঋতুতে পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের উপদ্রব কম। বন্যা, শিলাবৃষ্টি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুযোর্গের আশঙ্কাও কম। গম, গোলআলু, মিষ্টি আলু, তামাক, মরিচ, বেগুন, সরিষা, মুগ, মসুর, ছোলাম, পিঁয়াজ, রসুন, চিনাবাদাম, টমেটো, কপি, বোরো ধান প্রভৃতি রবি মৌসুমের ফসল।

আরও দেখুন :

Leave a Comment