বনজ বৃক্ষের চারা রোপণ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.৪ , বনজ বৃক্ষের চারা সাধারণত বীজ থেকে উৎপাদন করা হয়। চারা উৎপাদনের জন্য সুস্থ ও সবল বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। সুস্থ ও সবল বীজ নিশ্চিত করতে হলে বীজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বপন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সতর্কতা দরকার। বনজ গাছের প্রজাতিভেদে বিভিন্ন সময়ে ফল ধরে ও বীজ পরিপক্ক হয় বলে বীজ সংগ্রহের সময়কালও ভিন্ন ভিন্ন হয়। বনজ বৃক্ষের চারা সাধারণত নার্সারীতে উৎপাদনপূর্বক নিধার্রিত জায়গায় লাগানো হয়। কখন ও কিভাবে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, বপনের সময় ও বীজ অঙ্কুরোদগমনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়কালের উপর ধারণা সারণি—১ এ দেয়া হলো।
Table of Contents
বনজ বৃক্ষের চারা রোপণ
কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র । ইউনিট ১৫ । পাঠ – ১৫.৪
সারনি —১ : প্রজাতিভেদে বীজ সংগ্রহের সময়কাল, বপনের সময় ও অঙ্কুরোদগমনের সময়
বীজ সংগ্রহের পর বীজ সাধারণত নার্সারীতে বীজতলা তৈরী করে সেখানে বপন করা হয়। ইদানিং বনজ বৃক্ষের চারা সরাসরি পলিথিন ব্যাগে উত্তোলন করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বীজ খুব ছোট আকারের হলে প্রথমত ট্রেতে বপন করা হয় পরে উত্তোলিত ছোট ছোট চারা পলিব্যাগে স্থানাস্তর করা হয়।
পলিব্যাগে চারা উৎপাদন :
ইদানিংকালে বনজ বৃক্ষের চারা উৎপাদনের সবচেয়ে সহজ ও কম ব্যয় বহুল উপায় হচ্ছে পলিব্যাগ পদ্ধতি। বীজতলায় সরাসরি উৎপাদিত চারা রোপণের জন্য যখন তোলা হয় তখন শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। পলিথিন ব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে মৃত্যু হার খুবই কম। পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদন পদ্ধতির প্রচলন হওয়ায় নার্সারীতে চারা উৎপাদন অনেক সহজ হয়েছে। এখন প্রায়
সকল নাসার্রীতে পলিব্যাগ পদ্ধতিতে বনজ বৃক্ষের চারা উৎপাদন করা ক খ হচ্ছে।
পলিব্যাগের সুবিধা হলো— ক) উত্তোলন (ক. মাটি ভর্তি পলিব্যাগ; খ. উত্তোলিত চারা) সহজে বহন যোগ্য খ) চারা
অনেকদিন পর্যন্ত লালন পালন করা যায় গ) যে কোন সাইজ ও পুরুত্বের ব্যাগ পাওয়া যায় ঘ) ব্যাগ মজবুত, হালকা ও দীঘস্থায়ী। ফরেষ্ট নার্সারীতে চারা উৎপাদনের জন্য সাধারণত ১৫ ী ২৫ সে.মি. বা ৬″ ী ১০″ সাইজের পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। তবে বৃক্ষের প্রজাতি, চারা পলিব্যাগে লালন পালনের সময়কাল ইত্যাদির উপর ব্যাগের আয়তন নির্ভর করে।
পলিব্যাগে সাধারণত ফসলি জমির দোআঁশ মাটির সাথে ২৫ ভাগ হারে গোবর সার ভালভাবে মিশিয়ে চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হয়। পলিব্যাগে মাটি ভরাট করার পর বীজ বপন করতে হবে। দু—আঙ্গুল দিয়ে বীজ ধরে পলিব্যাগে মাঝখানে বীজটিকে উষ্ণ চাপ দিয়ে মাটির একটু নীচে বসিয়ে দিয়ে উপর দিকটা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজ অঙ্কুরোদগমনের পর চারা বাহির হলে প্রয়োজনীয় সেচ ও আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রজাতিভেদে পলিব্যাগে চারা সাধারণত ১ থেকে ১ঙ্গবৎসর, কখনও কখনও দু’বছর পর্যন্ত রাখার পর স্থায়ী জায়গায় রোপণ করা যায়।

পলিব্যাগে চারা উৎপাদনের সুবিধা ও অসুবিধা : সুবিধাসমূহ— (১) যে কোন সাইজ ও পুরুত্বের ব্যাগ পাওয়া যায় (২) ব্যাগ হালকা, দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত বিধায় সহজে ব্যবহারযোগ্য (৩) পলিব্যাগে উত্তোলিত চারা সহজে বহনযোগ্য বলে খরচ কম হয়।
অসুবিধাসমূহ— (১) পলিব্যাগে চারা দীর্ঘ সময় রাখলে মাটিতে খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে (২) পলিব্যাগে চারা বড় করে রোপণ করতে চাইলে অনেক সময় শিকড় কুন্ডলী পাকিয়ে (ৎড়ড়ঃ পড়রষরহম) যায় বিধায় রোপণকৃত বৃক্ষের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের বিভিন্ন ধাপ বনজ বৃক্ষের চারা উৎপাদনের পর রোপণের জন্য স্থান নির্বাচন করে সঠিকভাবে চারা রোপণ এবং রোপণকৃত চারার মৃত্যুহার কমাতে হলে ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো ধাপ অনুসরণ করা প্রয়োজন। যেমন—
ক. স্থান নিবার্চন
খ. সুস্থ চারা বাছাই
গ. গর্ত খনন
ঘ. গর্তে সার প্রয়োগ
ঙ. চারার সহ্য ক্ষমতা বাড়ানো
চ. চারা রোপণ
ছ. পানি সেচ, খুটি লাগানো ও বেড়া দেওয়া
ক. চারা রোপণের জন্য স্থান নির্বাচন
বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের পূর্বে বৃক্ষ প্রজাতির প্রকৃতি অনুসারে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা জরুরী। উপযোগী স্থান নির্বাচনে ব্যর্থ হলে রোপিত চারার মৃত্যুহার বেড়ে গিয়ে বনায়ন কার্যক্রম সাফল্য লাভ করবে না। চারা রোপণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন :
১. নিবার্চিত স্থানের মাটি দো—আঁশ ও উর্বর হতে হবে।
২. যেখানে পানি জমে না বা বন্যার পানি উঠে না এমন জায়গা বৃক্ষ রোপণের জন্য আদর্শ স্থান।
৩. চারা রোপণের জায়গা আলো বাতাস পূর্ণ ও সুনিষ্কাশিত হওয়া দরকার।
৪. বাড়ি ঘরের আশেপাশে বৃক্ষ লাগাতে চাইলে সাধারণত উত্তর পাশে বা উত্তর—পশ্চিম পাশে জায়গা নিবার্চন করা ভালো।
৫. জলাবদ্ধতা সহ্যশীল গাছপালার জন্য নীচু ও সঁ্যাতেসেতে জায়গায় গাছ লাগানো যায়। যেমন—হিজল, পিটালি, জারুল, কদম, মান্দার প্রভৃতি।
খ. সুস্থ চারা নির্বাচন
বনজ বৃক্ষ একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। তাই রোপণের পূর্বে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে:
১. নিবার্চিত চারাগাছ সবল, সতেজ ও নিরোগ হতে হবে।
২. চারা লাগানোর জায়গার অবস্থান অনুযায়ী প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। যেমন উচঁু জায়গার জন্য কাঁঠাল, মেহগনি, সেগুন ইত্যাদি। জায়গা নিচু হলে জারুল, কদম, হিজল ইত্যাদি।
৩. চারা স্বাভাবিক আকৃতির ও বাড়ন্ত হতে হবে।
৪. চারার প্রধান শিকড় অক্ষত থাকতে হবে। কোনভাবেই যাতে প্রধান শিকড় কুন্ডলী পাকিয়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পলিব্যাগে উত্তোলিত চারার বয়স বেশি হলে অনেক সময় প্রধান শিকড় কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে। এরকম হলে ঐ চারা রোপণের জন্য নিবার্চন করা উচিত হবে না।
৫. খুব বেশি বয়সের চারা নির্বাচন না করা ভালো।
গ. চারা লাগানোর জন্য গর্ত বা পীট তৈরী
চারা রোপণের অন্তত ১ মাস পূর্বে পীট তৈরী করা উচিত পীট তৈরীর কৌশল নিম্নরূপ:
১. চারার প্রজাতিভেদে পীটের সাইজ ঠিক করতে হয়। বনজ বৃক্ষের জন্য ৫০ সে.মি ী ৫০ সে.মি. ী ৫০ সে.মি. অথার্ৎ ৫০ সে.মি দৈর্ঘ্য, ৫০ সে.মি. প্রস্থ ও ৫০ সে.মি. গভীর গর্ত হলে চলে।
২. পীট তৈরীর সময় উপরের উর্বর মাটি এক পাশে ও নিচের মাটি আরেক পাশে রাখতে হবে।
৩. পীটের তলদেশের মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে নরম করে নিতে হবে।
৪. উপরের সার মাটি থেকে সব ধরনের আগাছা ও গাছপালার শিকড় বাছাই করে ফেলতে হবে।
৫. খোড়া মাটিগুলো ভালোমতো গুড়া করে রাখতে হবে।
ঘ. গর্তে সার প্রয়োগ
১. গর্ত খননের কয়েকদিনের পর মাটি শুকিয়ে গেলে প্রত্যেক গর্তের মধ্যে গোবর/কম্পোষ্ট ১০ কেজি, ইউরিয়া ১০০— ১৫০ গ্রাম, টি.এস.সি ও এম.পি ৭৫—১০০ গ্রাম করে প্রয়োগ করে রেখে দিতে হবে।
২. গোবর সার দেওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে অন্যান্য সার দিয়ে গর্তটি ১৫—২০ দিন রেখে দিতে হবে।
৩. চারা রোপণের আগে সব সার ভালোমতো মেশাতে হবে।
৪. মাটি খুব উর্বর হলে সার না প্রয়োগ করলেও চলে।
ঙ. চারার সহ্য ক্ষমতা বাড়ানো
১. নার্সারী থেকে পলিব্যাগ উঠিয়ে আশপাশের শিকড় হালকা করে কেটে দিয়ে চারা ছায়াযুক্ত স্থানে কয়েকদিন রাখতে হবে। এতে চারা নূতন আবহাওয়ায় টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করবে।
২. চারার প্রধান মূল যাতে না কাটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩. চারার গোড়ার মাটি পলিব্যাগ ফেটে আলগা না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪. রোগাক্রান্ত ও দূর্বল চারা বাছাই করে বাদ দিতে হবে।
চ. চারা রোপণ
চারা রোপণের সময় কিছু সর্তকতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সেগুলো হলো:
১. গর্তে সার প্রয়োগের ১৫—২০ দিন পর চারা রোপণ করা ভালো।
২. পলিব্যাগে উত্তোলিত চারা রোপণের পূর্বে পলিব্যাগটি লম্বালম্বিভাবে ব্লেড দিয়ে কেটে খুলে ফেলতে হবে।
৩. পলিব্যাগ অপসারণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন মাটি আলগা না হয়ে যায়।
৪. দুই হাতে ধরে চারাটি গর্তের ঠিক মাঝখানে মাটির চাকসহ বসিয়ে দিতে হবে।
৫. এরপর চারার চারাপাশে গর্তের উপরের মাটি দিয়ে শক্ত করে চেপে ভরে দিতে হবে। গর্তের নীচের মাটিগুলো উপরের দিকে দিতে হবে।
৬. সাধারণত বিকাল বেলায় চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
ছ. চারায় পানি সেচ, খুটি ও বেড়া দেওয়া
১. রোপণের প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী পানি দিতে হবে।
২. চারা যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য খুটি বেঁধে চারাটি সোজা রাখতে হবে।
৩. চারাগাছকে গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই বেড়া দিতে হবে।
আরও দেখুন :
- সামাজিক বনায়ন , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.৩
- বন ও বনায়নের প্রকারভেদ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২
- বন ও বনায়নের ধারণা ও গুরুত্ব , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.১
- ব্যবহারিক : বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্ম পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরি , গর্ভবতী গাভী শনাক্তকরণ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৪ , পাঠ – ১৪.৭ , পাঠ – ১৪.৮
- বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা