বাঁধাকপি চাষ। বাঁধাকপি (Brassica oleracea var. capitata) এক ধরনের সবজি যা কপিজাতীয় সবজির মধ্যে অন্যতম। এটি বাঙালি রান্নার একটি সাধারণ উপাদান এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। বাঁধাকপি চাষ অত্যন্ত লাভজনক এবং কৃষকেরা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভালো ফলন এবং মুনাফা পেতে পারেন। এ নিবন্ধে আমরা বাঁধাকপি চাষের প্রক্রিয়া, মাটি, সেচ ব্যবস্থা, রোগবালাই এবং সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
Table of Contents
বাঁধাকপি চাষ
মাটি এবং আবহাওয়া
বাঁধাকপি চাষের জন্য উর্বর, জলনিকাশের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে এমন দোঁআশ বা বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ (pH) মান ৫.৫ থেকে ৬.৫ এর মধ্যে হলে তা বাঁধাকপি চাষের জন্য আদর্শ। বাঁধাকপি চাষের জন্য শীতল এবং আর্দ্র আবহাওয়া প্রয়োজন হয়। সাধারণত শীতকাল বাঁধাকপি চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তবে উচ্চ অঞ্চলগুলিতে গ্রীষ্মকালেও বাঁধাকপি চাষ করা যেতে পারে।
চারা প্রস্তুতি
বাঁধাকপি চাষের প্রথম ধাপ হল সঠিক জাত নির্বাচন এবং চারা তৈরি। বাঁধাকপির বিভিন্ন জাত আছে যেমন ‘গোল্ডেন একর’, ‘প্রাইড অফ ইন্ডিয়া’, ‘শ্রাবণ’, ‘স্নোবল’ ইত্যাদি। জাত নির্বাচনের পর ভালো মানের বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
– বীজ বপন: সাধারণত বীজতলায় চারা তৈরির জন্য ১ সেন্টিমিটার গভীরতায় বীজ বপন করা হয়। এরপর বীজতলার উপর মাটি বা গোবরের পাতলা স্তর দেওয়া হয়।
– সেচ: বীজ বপনের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। চারা গজানোর পর সেচের প্রয়োজন হয় না, তবে বীজতলা সবসময় আর্দ্র রাখতে হবে।
– চারা রোপণ: ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে চারা রোপণের উপযোগী হয়ে ওঠে। চারা ৪ থেকে ৫টি পাতা গজানোর পর মূল জমিতে রোপণ করা হয়।
জমি প্রস্তুতি
বাঁধাকপি চাষের জন্য জমি ভালোভাবে চাষ করা প্রয়োজন। জমি ভালোভাবে চাষ করে এবং আগাছা ও অন্যান্য বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জৈব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। বাঁধাকপি চাষের জন্য জমিতে ১০-১৫ টন গোবরের সার বা কম্পোস্ট সার মেশানো যেতে পারে।
– সার প্রয়োগ: চারা রোপণের আগে ১০-১২ কেজি ইউরিয়া, ২০-২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৫-২০ কেজি এমওপি সার বিঘা প্রতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। সার প্রয়োগের পর জমি ভালোভাবে চাষ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
– ফসল ঘূর্ণন: বাঁধাকপি চাষের জমিতে পূর্ববর্তী ফসল হিসেবে ডাল বা অন্যান্য রোটেশনাল ফসল চাষ করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
চারা রোপণ এবং যত্ন
– দূরত্ব: বাঁধাকপির চারা রোপণের জন্য সারির মধ্যে ৪৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার এবং গাছের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখতে হবে।
– সেচ: রোপণের পর প্রথম ২-৩ সপ্তাহ পরপর হালকা সেচ দিতে হবে। পরে সপ্তাহে একবার সেচ দেওয়া যথেষ্ট। বর্ষাকালে অতিরিক্ত সেচ দেওয়া উচিত নয়।
– আগাছা দমন: চারা রোপণের পর ১৫-২০ দিনের মধ্যে প্রথম আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে আরও ২-৩ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
– গোড়ায় মাটি চাপা: চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর প্রথমবার এবং ৬০-৬৫ দিন পর দ্বিতীয়বার মাটির গোঁড়া দেওয়া উচিত। এতে বাঁধাকপির পাতা ভালোভাবে বাঁধা পড়ে।
রোগবালাই এবং প্রতিকার
বাঁধাকপি চাষে কিছু সাধারণ রোগবালাই দেখা দেয়। নিচে কিছু প্রধান রোগবালাই এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
– ডাউনি মিলডিউ: এ রোগে পাতায় সাদা রঙের দাগ দেখা যায় এবং পাতাগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডাউনি মিলডিউ প্রতিরোধে ডাইথেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
– ব্ল্যাক রোট: এ রোগে বাঁধাকপির পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং কালো দাগ পড়ে। রোগাক্রান্ত গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য চাষের আগে বীজ শোধন করতে হবে।
– কীটপতঙ্গ: বাঁধাকপিতে কিছু সাধারণ কীটপতঙ্গ আক্রমণ করে, যেমন ডায়মন্ড ব্যাক মথ, ক্যাবেজ ওয়ার্ম ইত্যাদি। কীটপতঙ্গ দমনের জন্য বিটি (Bacillus thuringiensis) ভিত্তিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাঁধাকপি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ
বাঁধাকপি রোপণের ৭০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের উপযোগী হয়ে ওঠে। বাঁধাকপির মাথা (হেড) যখন সম্পূর্ণভাবে গঠিত হয় এবং মুচমুচে থাকে তখন তা সংগ্রহ করতে হবে।
– সংগ্রহ পদ্ধতি: বাঁধাকপির গাছের মূল থেকে হাতের সাহায্যে বা ছুরি দিয়ে কেটে মাথা সংগ্রহ করা যায়। মাথার নিচে কিছু পাতা রেখে দেওয়া উচিত যাতে বাঁধাকপি সংরক্ষণে সুবিধা হয়।
– সংরক্ষণ: বাঁধাকপি একটি ক্ষণস্থায়ী সবজি হওয়ায় তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই ফসল সংগ্রহের পরপরই তা বাজারজাত করতে হবে। তবে, ঠাণ্ডা স্থানে বাঁধাকপি সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘ সময় ভালো থাকে।
বাঁধাকপি চাষ একটি লাভজনক ফসল এবং এর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। বাঁধাকপি চাষে সঠিক মাটি, আবহাওয়া, সার প্রয়োগ এবং পরিচর্যার মাধ্যমে কৃষকরা ভালো মানের ফসল উৎপাদন করতে পারেন। চাষের প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে বাঁধাকপি চাষে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান বাজারে বাঁধাকপির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এই ফসলটি চাষ করে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।

আরও দেখুন: