বাংলাদেশের কৃষির জন্য খরা ব্যবস্থাপনা কৌশল

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন নানা ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে খরা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। খরা শুধু ফসল উৎপাদনকে নয়, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের জীবনমান, গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই খরা মোকাবেলায় কার্যকর কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের কৃষির জন্য খরা ব্যবস্থাপনা কৌশল

 

খরার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

খরা হলো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাতের অভাব দেখা দেয়, মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকে না এবং পানির অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) এবং গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে মে) খরার প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

  • দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল যেমন রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুর খরাপ্রবণ এলাকা।
  • বোরো মৌসুমে সেচনির্ভর কৃষি প্রচলিত থাকলেও পানির অভাব ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে সেচ ব্যবস্থায় ব্যয় বাড়ছে।
  • খরার কারণে খাদ্যশস্য, ফল, সবজি, ডাল এবং তেলের ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

বাংলাদেশের কৃষিতে খরার প্রভাব

  1. ফসল উৎপাদন হ্রাস – পানি স্বল্পতার কারণে ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
  2. খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি – কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং মূল্য বৃদ্ধি পায়।
  3. পশুপালন ক্ষতি – পানির অভাবে পশুখাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায় ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।
  4. মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া – দীর্ঘমেয়াদি খরা মাটির জৈব পদার্থ নষ্ট করে।
  5. অর্থনৈতিক ক্ষতি – কৃষকের আয় হ্রাস পায়, ঋণের বোঝা বাড়ে, গ্রামীণ দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।

 

খরা ব্যবস্থাপনার কৌশল

১. ফসল নির্বাচন ও কৃষি পরিকল্পনা
  • খরা সহনশীল জাত: ধান, গম, ডাল, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদির খরা সহনশীল জাত চাষ। যেমন – ধানের জন্য BRRI dhan56, 57; ভুট্টার জন্য BARI Hybrid Maize।
  • বহুমুখী ফসল চাষ: এক মৌসুমে শুধু একটি ফসলের ওপর নির্ভর না করে ডাল, তেলবীজ, সবজি ইত্যাদি চাষ করা।
  • ফসল বিন্যাস পরিবর্তন: যেখানে পানির সংকট বেশি, সেখানে বোরোর পরিবর্তে গম, ভুট্টা বা ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা।
২. পানি ব্যবস্থাপনা
  • সেচ প্রযুক্তি: আধুনিক সেচ প্রযুক্তি যেমন ড্রিপ সেচ, স্প্রিঙ্কলার সেচ, পাইপ সেচ ব্যবহার করা।
  • বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: খাল, বিল, পুকুর, জলাধার ও ভূগর্ভস্থ রিচার্জ পিটের মাধ্যমে বর্ষার পানি সংরক্ষণ।
  • ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: গভীর নলকূপের পরিবর্তে অগভীর নলকূপ ও পুকুরভিত্তিক সেচ বাড়ানো।
৩. মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ
  • মালচিং পদ্ধতি: খড়, পলিথিন বা জৈব পদার্থ দিয়ে মাটির ওপরে ঢেকে রাখা, যাতে পানি দ্রুত বাষ্পীভূত না হয়।
  • জৈব সার ব্যবহার: মাটির গঠন উন্নত করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো।
  • সংরক্ষণশীল কৃষি (Conservation Agriculture): ন্যূনতম চাষ, ফসলের অবশিষ্টাংশ রাখা ও ফসলের আবর্তন।
৪. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন
  • কৃষি আবহাওয়া তথ্য: খরা পূর্বাভাস, আবহাওয়ার তথ্য ও কৃষি পরামর্শ SMS বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  • ড্রোন স্যাটেলাইট ব্যবহার: খরার এলাকা শনাক্ত করা ও সেচ পরিকল্পনা করা।
  • গবেষণা: নতুন খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবন এবং স্থানভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন।
৫. সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল
  • কৃষক প্রশিক্ষণ: পানি সাশ্রয়ী চাষ, আধুনিক প্রযুক্তি ও খরা মোকাবেলার পদ্ধতি শেখানো।
  • কৃষি সমবায় গঠন: কৃষক পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা ও সেচে সহযোগিতা।
  • নীতিগত সহায়তা: সরকার কর্তৃক সেচযন্ত্রে ভর্তুকি, খরা আক্রান্ত কৃষকের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, ফসল বীমা চালু।

 

বাংলাদেশের জন্য খরা ব্যবস্থাপনার মডেল

১. ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প: প্রতিটি ইউনিয়নে পুকুর বা খাল খনন করে পানি সংরক্ষণ।
২. গ্রামীণ পানি কমিটি: কৃষকেরা মিলে পানি ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করবে।
৩. ফসল বীমা ব্যবস্থা: খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া।
৪. প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি: কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস ও ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা।
৫. জলবায়ু অভিযোজন তহবিল: সরকার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় খরা ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন।

 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

  • ভারত: ড্রিপ সেচ ও জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে খরা মোকাবেলা।
  • ইসরায়েল: খরা-সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, পুনর্ব্যবহৃত পানি ও ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবহারে সাফল্য।
  • চীন: বিশাল আকারে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশ এসব অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে পারে।

 

ভবিষ্যৎ করণীয়

  1. খরা-সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ বাড়ানো।
  2. পানি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা।
  3. কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নীতি সমন্বয় জোরদার করা।
  4. খরা ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
  5. কৃষিতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার (সোলার পাম্প)।

 

চৈত্রের দিনে বাংলাদেশের ফেটে যাওয়া মাটি বাংলাদেশের কৃষির জন্য খরা ব্যবস্থাপনা কৌশল

 

বাংলাদেশে কৃষি টেকসই করতে হলে খরা ব্যবস্থাপনা কৌশল এখন সময়ের দাবি। খরা মোকাবেলায় ফসল বৈচিত্র্য, পানি সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকের সক্ষমতা বৃদ্ধি একসাথে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষক ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া টেকসই খরা ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষিতে খরার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।