বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গার উপায় , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি , বীজতত্ত্ববিদগণ বীজের সুপ্ততা ভঙ্গের নানা উপায় খুজে বের করেছেন। এদের একক বা সম্মিলিত পদ্ধতি বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গতে বা কমিয়ে আনতে সক্ষম। কোন পদ্ধতিই এককভাবে সকল বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বীজ এবং সুপ্ততার প্রকৃতি অনুসারে পদ্ধতিরও পার্থক্য হয়।
বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গার উপায় , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি
কোন একটা পদ্ধতি হয়ত কোন জাতের বীজের সুপ্ততা তাড়াতাড়ি ভঙ্গ করতে পারে। সেই পদ্ধতি আবার অন্য জাতে তা দীর্ঘায়ু করতে পারে। তাই বীজের সুপ্ততা ভংগের কাজ অবশ্যই যথাযথভাবে করা বাঞ্ছনীয়। বীজের সুপ্ততা ভংগের বিভিন্ন পদ্ধতি নিচে বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো
(১) পানিতে ভিজিয়ে রাখা : এ পদ্ধতিতে বীজকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ফলে যে সমস্ত বীজে সহজে পানি প্রবেশ করতে পারে না সে সকল বীজে পানি প্রবেশ ত্বরান্বিত হয়, বীজ আবরণ নরম হয়, ভ্রূণের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং বীজ আবরণ সহজে অল্প চাপে ফেটে যায়। পানির পরিমাণ এবং ভিজিয়ে রাখার সময় বীজের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল।
(২) যান্ত্রিক ও দৈহিক আঁচড়ানো : আঁচড়ানোর উদ্দেশ্য হলো শক্ত বীজাবরণকে এমনভাবে পরিবর্তন করে নেয়া যাতে করে বীজের ভিতরে সহজেই পানি ও অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে। যান্ত্রিক উপায়ে বীজকে একটি যন্ত্রে নিয়ে এমনভাবে নাড়াচাড়া করা হয় যাতে বীজের আবরণে কোথাও কোন ফাটল ধরে বা ক্ষয় হয়। দৈহিকভাবেও বীজকে কোন পাথর, ইট, বা এ জাতীয় কোন পদার্থের সাথে ঘর্ষণ বা কোন কিছুর মাঝে রেখে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
যান্ত্রিক বা দৈহিক আঁচড়ানোর কাজ খুব সাবধানে করতে হবে যাতে কোন অবস্হাতেই বীজের ভ্রূণ নষ্ট না হয়। কী পদ্ধতিতে বা কতক্ষণ আঁচড়াতে হবে তা বীজের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।
(৩) অল্পদ্রব্য সহযোগে আঁচড়ানো ঃ এ পদ্ধতিতে বীজকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হয়। ঘন সালফিউরিক এসিডের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৮৪ হওয়া দরকার। সাধারণত বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ এসিড (নির্দিষ্ট ঘনমাত্রার) একটি কাঁচ বা মাটির পাত্রে নিতে হয়। তারপর বীজকে উক্ত পাত্রে ঢেলে মুখ আটকাতে হবে এবং মাঝে মাঝে কোন কাঠির সাহায্যে বীজকে নাড়াচাড়া করতে হবে।
অতিরিক্ত নাড়াচাড়া উচিত নয়। তবে বীজের চতুপার্শ্বে যেন সমভাবে এসিডের ক্রিয়া হয় এবং উক্ত মিশ্রণের তাপমাত্রা যেন খুব বেড়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ৬০-৮০ ফাঃ।
এই পদ্ধতিতে বীজকে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করতে হবে তা তাপমাত্রা, বীজের প্রকৃতি, এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বীজের স্তুপের উপর নির্ভর করবে। সময়ের পরিমাণ ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। বীজাবরণ যখন পাতলা হয়ে আসে তখন সাবধানে এসিড ঢেলে নিতে হয় এবং তৎক্ষনাৎ বীজগুলোকে প্রবাহমান পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। উক্ত ধোয়া বীজ ভিজা অবস্হায় সরাসরি জমিতে বপন করা চলে। অথবা ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামেও রাখা চলে।
সাবধানতাঃ সালফিউরিক এসিড শরীরের চামড়ায় বা কাপড়ে লাগলে তা পুড়ে যাবে। তাই সাবধানে এসিড নিয়ে কাজ করা উচিত।
(৪) আলো : আলোর উপস্থিতি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুপস্হিতি বীজের অংকুরোদগমকে ত্বরান্বিত বা প্রতিরোধ করে। এসব ক্ষেত্রে আলো বীজের সুপ্ততা ভংগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। চিহ্নিত আলোর উপস্হিতি বীজের প্রকার, বয়স ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে তার সুপ্তাবস্হাকে ভেংগে দিতে যথেষ্ট সহায়তা করে। পরিপক্কতা লাভের পরপরই আলোর প্রতি বীজের সংবেদনশীলতা বেশি থাকে এবং গুদামজাত করার বয়সের সাথে তা কমতে থাকে।
(৫) গুদামজাতকরণ : অনেক বহুবর্ষজীবী লতাগুলোর বীজ বেশ কিছুদিন গুদামজাত না করা পর্যন্ত তাদের অংকুরোদগম হয়না। এই সুপ্ততা কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। স্বাভাবিক অবস্হায় বীজকে শুরুনাবস্হায় বেশ কিছুদিন ঘরে রাখা হয় এবং পরে বপন করার ফলে উক্ত সময়ের মধ্যে বীজের সুপ্ততা প্রাকৃতিকভাবেই ভেংগে যায়।
(৬) সরাসরি বপন : অনেক জাতের বীজ, যেমন : জুনিপার ও ম্যাগনোলিয়ার প্রজাতি সমূহে পরিপক্কতা লাভের পর বীজ শুকিয়ে গেলে বীজাবরণ যথেষ্ট শক্ত হয় ও বীজে সুপ্ততা আসে। এ অবস্হায় উক্ত বীজসমূহকে না শুকিয়ে সরাসরি বপন করলেই সুপ্ততার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
(৭) বীজকে ঠান্ডায় রাখা ঃ বহু প্রকার বৃক্ষ ও ঝোপ জাতীয় গাছের বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ঠান্ডা প্রয়োগ ফলপ্রসু হয়েছে। এই ঠান্ডাবেশ বীজে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় যার ফলে বীজের পরবর্তী পরিপক্কতা ত্বরান্বিত হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে ১°-১০° সেঃ তাপমাত্রা, পরিমিত পানি এবং অক্সিজেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখা হয়। প্রথমে বীজকে শুষ্ক অবস্হায় ১২-২৪ ঘন্টার জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় তারপর আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে এমন মাধ্যমে যেমন: বালি, পিট মাটি, করাতের গুঁড়া ইত্যাদির মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ২° –৭° সেঃ তাপমাত্রায় রাখা হয়।
এ পদ্ধতিতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে বীজের প্রকৃতির উপর। তবে অধিকাংশ বীজের জন্য ১-৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনবোধে উক্ত সময়ে মাঝে মাঝে পানি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয় এবং বীজে অংকুরোদগম হতে থাকে। তখনই বীজ বপন করা উচিত।
(৮) তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে : তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে বীজের সুপ্তাবস্হা পরিবর্তন করা সম্ভব। তাপমাত্রার পরিবর্তন দুইভাবে করা যায়ঃ
(ক) শুষ্ক অবস্হায় ও
(খ) ভিজা অবস্হায়।
(ক) শুষ্ক অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে বীজে শুষ্ক অবস্থায় তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটানো হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের পরিমাণ ১০-২০ সেঃ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। 0 যেমন : জনসন ঘাস এর বীজ ৩০° সেঃ তাপমাত্রায় ১৮-২২ ঘন্টা এবং পরে ৪৫ সেঃ তাপমাত্রায় ২-৮ ঘন্টা রেখে সুপ্ততা ভাংগানো সম্ভব হয়েছে।
(খ) ভিজা অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে ভিজা অবস্হায় তাপমাত্রার পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের সীমা অনেক বেশি। প্রথমে শক্ত আবরণ সম্পন্ন বীজকে তাদের প্রায় ৫ গুণ পানিতে ভিজিয়ে ৭৭° – ১০০° সেঃ তাপমাত্রায় কিছুক্ষণ রাখা হয়। তারপর আবার ঠান্ডা পানিতে ১২-২৪ ঘন্টা রাখা হয় এবং তারপর বীজকে সরাসরি বপন করা হয়।
(৯) চাপ প্রয়োগ : চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও বীজের সুপ্ততা ভংগ করা যায়। বীজ শুকানোর আগে এই চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং চাপের প্রভাব শুকানোর পর অথবা গুদামজাত করার দরুণ দূরীভূত হয়না।
আলফা আলফা বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ১৮ সেঃ তাপমাত্রা ও ২০০ বায়ুচাপে বীজকে ৫-১০ মিনিট রেখে দেওয়া বেশ কার্যকরী।
(১০) রাসায়নিক উত্তেজক প্রয়োগ : বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উত্তেজক দ্বারা বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা সম্ভব হয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
(ক) পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্বারা ঃ অনেক সদ্য আহরিত বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে চোষ কাগজ বসানো একটি পেট্রিডিসে নিয়ে ০.১ থেকে ০.২% দ্রবণ দ্বারা চোষ কাগজ ভিজিয়ে দেয়া হয়। দ্রবণ শুকিয়ে গেলে আর পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ না দিয়ে শুধু পানি দিতে হয়। এভাবে কিছুক্ষণ রাখার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয়।
(খ) সোডিয়াম হাইপো ক্লোরাইড ঃ ধান বীজের খোসায় পানিতে দ্রবণীয় যে অংকুরোদগম নিরোধক থাকে তা দূরীকরণের জন্য উপরোক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। ১০০ গ্যালন পানিতে ১ গ্যালন সোডিয়াম হাইপো ক্লোরাইড (১% দ্রবণ) মিশিয়ে এ কাজ করা হয়।
(গ) থায়ো ইউরিয়া ঃ যে সমস্ত বীজ অন্ধকারে ও উচ্চ তাপমাত্রায় গজায় না, তাদের সুপ্তাবস্হা ভাঙ্গার জন্য থায়ো ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে ০.৫–৩% দ্রবণে বীজ ভিজিয়ে রাখতে হয়। তবে ২৪ ঘন্টার বেশি বীজ ভিজিয়ে রাখা যাবে না, কারণ গাছের বৃদ্ধির উপর থায়ো ইউরিয়ার কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে।
(ঘ) জিবারেলিক এসিড : বীজের সুপ্তাবস্হাজনিত অসুবিধা দূরীকরণে জিবারেলিক এসিড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি বীজ গজাতে, অংকুরোদগম হার বৃদ্ধি এবং চারা গাছের বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহৃত হয়। এমনকি বীজের এপিকোটাইল খাটোজনিত অসুবিধা দূরীকরণের জন্যও ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ১০০-৫০০ গ্রাম এসিড ১০০০ মিঃলিঃ পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করা হয়।
অনেক সময় শক্ত বীজাবরণ ভেংগে দিতে হয় অথবা খোসা খুলে নিতে হয় যাতে দ্রবণ সহজে প্রবেশ করতে পারে। এসিডের দ্রবণ বীজের বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্হার ওপর নির্ভরশীল।
আরও দেখুন:
- বীজের সুপ্ততা এবং সুপ্ততার কারণসমূহ , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি , ইউনিট-১ , পাঠ-১.৪
- বীজমান বৈশিষ্ট্যসমূহ , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি , ইউনিট-১ , পাঠ-১.৩
- ধান চাষের পদ্ধতি
- ওলকচু চাষ করার পদ্ধতি
- বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা