মাছের রোগ সৃষ্টিকারী নিয়ামকসমূহ ও তাদের আন্তঃক্রিয়া , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৪ , পাঠ -৪.১ , সহজ কথায় রোগ বলতে যে কোনো প্রাণির দেহ ও মনের অস্বাভাবিক অবস্থাকে বুঝায় যা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ, আচরনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মাছ বা চিংড়ির রোগ বলতে প্রতিকূল পারিবেশিক অবস্থায় মাছ বা চিংড়ির ওপর সৃষ্ট ধকল বা চাপের (Stress) কারণে দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যাওয়া এবং রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়াকে বুঝায় যা বিশেষ কিছু লক্ষণ, চিহ্ন বা আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মাহ বা চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী প্রধান উপাদান বা নিয়ামক ৩টি।
মাছের রোগ সৃষ্টিকারী নিয়ামকসমূহ ও তাদের আন্তঃক্রিয়া , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৪ , পাঠ -৪.১
যথা :
(১) পরিবেশগত ধকল বা চাপ
(২) পোষক মাছ/চিংড়ির সংবেদনশীলতা
(৩) কার্যকর রোগজীবাণু/পরজীবী
উল্লেখিত কার্যকারণ ছাড়াও মাছ ও চিংড়ির রোগ সংগঠনের জন্য নিম্নোক্ত নিয়ামগুলোকেও দায়ী করা যায়
(১) বংশানুক্রম |
(২) পুষ্টিমান
(৩) অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ
(৪) ক্রটিপূর্ণ পরিবহণ এবং হ্যান্ডেলিং
(৫) উল্লিখিত সবগুলো কারণের আন্ত:ক্রিয়া।
এখানে মাছ ও চিংড়ির রোগসৃষ্টিকারী উপাদান বা কারণগুলোকে আরো বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো—
(১) পরিবেশগত ধকল বা চাপ : চাপ সৃষ্টিকারী এবং অস্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশের জন্য দায়ী কারণগুলো নিম্নরূপ— (ক) পানির ভৌত—রাসায়নিক গুণাগুণের অবনতি * পানির অধিক তাপমাত্রা এবং শীতল অভিঘাত
* পানির ঘোলাত্ব
* পানির কটু গন্ধ বা গন্ধযুক্ত পানি
* হাইপো*িয়া/অ্যানো*িয়া/হাইপারো*িয়া
* এসিডোসিস/ অ্যালকালোসিস
* বিষাক্ত গ্যাস যেমন— অ্যামোনিয়া (ঘঐ৩), নাইট্রাইট (ঘঙ২), হাইড্রোজেন সালফাইড (ঐঝ২) এর উপস্থিতি।
* মাত্রাতিরিক্ত জৈব তলানি
* এগ্রোকেমিক্যাল দূষণ (কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার)
* কল—কারখানার বর্জ্যজনিত দূষণ
* পয়: নর্দমাবাহিত ময়লার কারণে দূষণ * পানিতে ভারী ধাতুর ঘনত্বজনিত দূষণ
(খ) পানির জৈবিক গুণাগুণের অবনিত
জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদের যারা একই পরিবেশে মাছ ও চিংড়ির সংগে অবস্থান করে তাদের আধিক্যজনিত কারণে জলাশয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। যেমন—
* জলাশয়ে সাপ, ব্যাঙ, উদবিড়াল ইত্যাদি রাক্ষুসে প্রাণির উপদ্রব
* বিভিন্ন মৎস্যভূক পাখি যেমন— বক, মাছরাঙা, পানকৌড়ির উপদ্রব
* বিভিন্ন পরজীবীর মাধ্যমিক পোষক যেমন— শামুক, ঝিনুক ইত্যাদির আধিক্য
* জলজ আগাছার আধিক্য
* নীলাভ সবুজ শৈবাল এর আনাধিক্যজনিত ব্লুম
(২) রোগ—জীবাণুর সংক্রমণ :
(ক) এককোষী ও বহুকোষী পরজীবী (খ) ভাইরাস (গ) ব্যাকটেরিয়া (ঘ) ছত্রাক
(৩) পুষ্টিজনিত কারণ :
(ক) প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব (খ) সুষম সম্পূরক খাদ্যের অভাব (গ) পুষ্টির আধিক্য
(৪) উৎপাদন উপকরণ এবং ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কারণ :
(ক) ত্রুটিপূর্ণভাবে বড় মাছ বা পোনা পরিবহণ ও হ্যান্ডেলিং
(খ) ত্রুটিপূর্ণভাবে পুকুর/জলাশয় প্র¯তকরণ‘
(গ) আঘাতপ্রাপ্ত মাছ/মাছের পোনা মজুদকরণ
(ঘ) অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদকরণ
(ঙ) অন্য জলাশয়ে ব্যবহৃত জাল বা উপকরণ শোধন না করে ব্যবহার
রোগ সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোর আন্ত:ক্রিয়া :
মাছ/চিংড়ির রোগ সংগঠনে আন্ত:ক্রিয়াশীল তিনটি উপাদান প্রধান ভূমিকা রাখে। উপাদান তিনটি হলো— (ক) পরিবেশের ধকল/চাপ (খ) পোষকের সংবেদনশীলতা এবং (গ) কার্যকর রোগজীবাণু। এদের আন্ত:ক্রিয়া নিচের রেখাচিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়।
কান জীবের পরিবেশ হলো তার অবস্থানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা। মাছ/চিংড়ি হলো জলজ প্রাণি। কাজেই, মাছ/চিংড়ির পরিবেশ হলো পানি এবং এর ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক অবস্থা। জলজ পরিবেশে মাছ/চিংড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণুও বসবাস করে। একই জলজ পরিবেশে বসবাসকারী মাছ/চিংড়ি এবং রোগজীবাণুর মধ্যে একটি দূর্বল ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান। এ অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত জলাশয়ে মাছ/চিংড়ির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ বজায় থাকে। অর্থাৎ পানির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক অবস্থা মাছ/চিংড়ির বসবাসের জন্য অনুকূল থাকে।
যখন জলাশয়ে মাছ/চিংড়ির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ বিঘ্নিত হয় বা অনুপস্থিত থাকে, তখন পরিবেশগত একটা ধকল/চাপের সৃষ্টি হয়। এরকম ধকলপূর্ণ অস্বাভাবিক পরিবেশ রোগজীবাণুর বসবাসের জন্য অনুকূল হলেও মাছ/চিংড়ির জন্য তা মোটেও সুখকর হয় না। এরূপ অবস্থায় মাছ/চিংড়ির শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে,শরীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয় এবং এরা অধিকতর সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।
এই সুযোগে সুযোগ—সন্ধানী রোগজীবাণু মাছ/চিংড়িকে আক্রমণ করার প্রয়াস পায়। পারিবেশিক ধকলে পিষ্ঠ মাছ/চিংড়ি এসব রোগজীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না এবং রোগাক্রান্ত হয়। একটি উদাহরনের সাহায্যে ব্যাপারটিকে সহজে বুঝানো যায়।
যখন কোন জলজ পরিবেশে জৈব পদার্থের পচনক্রিয়া বৃদ্ধি পায়, তখন মাছ/চিংড়ির জন্য অনুকল পরিূ বেশ বিঘ্নিত হয়; কিন্তু রোগজীবাণুর জন্য অনুকল পূ ারিবেশ সৃষ্টি হয়। এরূপ অস্বাভাবিক পরিবেশিক পরিস্থিতিতে মাছ/চিংড়ির জীবন যখন বিপর্যন্ত ঠিক তখনই তারা রোগজীবাণুর আক্রমণের শিকার হয। ফলে মাছ/চিংড়ির রোগ দেয়া দেয়।
রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া : প্রাথমিকভাবে পোষক (মাছ/চিংড়ি) তার বাহ্যিক প্রতিবন্ধক (যেমন—ত্বক, অঁাইশ, খোলস, মিউকাস মেমব্রেন দ্বারা সংক্রামক রোগজীবাণুকে দেহে প্রবেশে বাধা দেয়। তবে যখন কোন রোগজীবাণু/পরজীবী তার অনুকূল পরিবেশে পোষকের দেহের ভিতরে প্রবিষ্ট হয় বা বহিঃরাঙ্গে আবদ্ধ হয়, তখন রোগ সংক্রামণ নিম্নোক্ত তিনটি ধাপে হতে পারে—
আরও দেখুন :
- ব্যবহারিক : মাছের সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৩ , পাঠ -৩.৫
- চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৩ , পাঠ -৩.৪
- মাছ ও চিংড়ির খাদ্য প্রস্তুতকরণ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৩ , পাঠ -৩.৩
- চিংড়ির খাদ্য , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৩ , পাঠ -৩.২
- বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা