আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – মাটি ও মাটির গঠন। মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ। ভূ-ত্বক প্রথমে শিলা দ্বারা গঠিত ছিল। পরে তা শিলা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে ছোট খণ্ডে বা এককে রূপান্তরিত হয়। মাটির এই অংশ বালি, পলি ও কর্দম কণা দ্বারা গঠিত। আসুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
Table of Contents
মাটি ও মাটির গঠন
মাটি
মাটি একটি মিশ্র পদার্থ বিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবী প্রথমে একটি জলন্ত অগ্নিগোলকের পিন্ড ছিল। দীর্ঘকাল ধরে তাপ বিকিরণ করতে করতে এর বাহিরের অংশ ঠাণ্ডা হয়ে শিলাময় শক্ত ভূত্বকেরা সৃষ্টি করে। তাপ, পানি, বাতাস ইত্যাদির নৈসর্গিক প্রভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ক্ষয়ীভূত হয়ে কালক্রমে এ মৃতকের বাহিরের স্তর কোমল হয়ে আসে এবং মাটির সৃষ্টি হয়।
জীবজন্ত ও গাছপালার দেহাবশেষও মিশে মাটির আশে পরিণত হয়। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে, ভস্মীভূত শিলা ও নানা প্রকারের জৈব পদার্থের সংমিশ্রণে গঠিত ভূ-ত্বকের বাইরের যে করে গাছপালা জন্মে এবং যে স্তর থেকে গাছপালা পুষ্টি উপাদান শোষণ করে বেঁচে থাকে তাকে মাটি বলে। বিভিন্ন প্রকার জৈব পদার্থ, অজৈব পদার্থ, পানি ও বায়ু যারা গঠিত মাটি এক অন্য মাধ্যম। এ মাটিতেই চাষাবাদ করে মানুষ শস্য ফলায়, আর মাটিতেই বাড়িঘর করে মানুষ জীবন কাটায়।
মাটি গঠনের উপাদান
মাটি প্রধানত চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত। এগুলো হলো:
(১) অজৈব পদার্থ বা পার্থ
(২) জৈব পদার্থ
(৩) পাি
(৪) বায়ু
(১) অজৈব পদার্থ বা খনিজ পদার্থ
ভূপৃষ্ঠ প্রকৃতপক্ষে শিলা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রাকৃতিক শক্তি তথা তাপ, বৃষ্টিপাত বায়ুপ্রবাহ, তুষারপাত, বায়ু ও পানি প্রবাহ ইত্যাদির প্রভাবে সময়ের ব্যবধানে আদি শিলা পূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মাটির অজৈব বা খনিজ পদার্থ সৃষ্টি করেছে।
অ্যালুমিনিয়াম, লৌহ, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য ধাতব পদার্থের অক্সিজেন মিশ্রিত যৌগিক পদার্থ এবং সিলিকা জাতীয় যৌগিক পদার্থের সমন্বয়ে মৃত্তিকার অজৈব বা শনি অংশ গঠিত। বালিকণা, কদমকণা, পলিকণা ইত্যাদি হচ্ছে অনিতা পদার্থ।
এসব পদার্থ বিভিন্নভাবে মিশে মাটির বুনট সৃষ্টি করে। মাটির বুনট ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাটির অজৈব বা নিজ পদার্থগুলো পরস্পর মিশে যৌগিক কণা গঠন করলে তাকে মাটির সানাবন্ধন বা গঠন বলে। মাটিতে খনিজ পদার্থের পরিমাণ শতকরা প্রায় ৪৫
(২) জৈব পদার্থ
উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের পচনশীল ধ্বংসাবশেষই মৃত্তিকার জৈব পদার্থের প্রধান উৎস। এসব অবশেষ প্রায় সব সময়ই পচনত্রিনার মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মাটিতে প্রায় শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকে। এ জৈব পদার্থের কাজ হলো মাটির ভৌত গুণাবলীর উৎকর্ষ ঘটানো এবং মাটির আঠালোভাব কমানো।
ভারি কাদা মাটিতে অধিক পরিমাণে জৈব পদার্থের মিশ্রণ ঘটালে মাটি হালকা হয় এবং মাটির গঠন উন্নতমানের হয়। জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। কেননা জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে মাটির অণুজীবগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় যা উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান সৃষ্টির জন্য সহায়ক।
এছাড়া জৈব পদার্থ মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ বাড়িয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে জৈব পদার্থ উদ্ভিদের খাদ্যোপাদানসমূহ সরবরাহ মাটিতে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মাটির মধ্য দিয়ে বায়ু চলাচলে সহায়তা করে। এছাড়া মাটির গঠন ও সংযুক্তির উন্নতি ঘটায়।
(৩) পানি
মাটির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি। মাটির মধ্যে কিছু না কিছু পানি বিদ্যমান থাকে। বৃষ্টিপাত, বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প ভূ-মধ্যস্থ পানি ও সেচ ব্যবস্থা থেকে মাটি পানি লাভ করে। মাটির পানিই গাছের খাদ্য উপাদানগুলোকে দ্রবীভূত রাখে এবং মাটিকে রসালো করে। ফলে গাছপালা সহজেই পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত অবস্থায় শোষণ করে নেয়। মাটিতে সাধারণত শতকরা ২৫ ভাগ পানি থাকে।
(৪) বায়ু
গাছপালার জীবন ধারণের জন্য বায়ু একা প্রয়োজন মাটির কণার ফাঁকে ফাঁকে বায়ু থাকে। ভূমি প্লাবিত হলে মাটিতে বায়ুর পরিমাণ হ্রাস প্রায় এবং পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। জমি চাষ করলে মাটিতে বায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। স্কুল ক্যাবিশিষ্ট মাটির সূক্ষ্মকণাবিশিষ্ট মাটির চেয়ে বায়ুর ধারণ ক্ষমতা বেশি। মাটিতে বায়ুর মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড ছাড়াও থাকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস। মাটিতে বাহুর পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি মাটিস্থ পানির পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। মাটিতে শতকরা ২৫ ভাগ বায়ু থাকে।
মাটির প্রকারভেদ
মাটির অজৈব বা খনিজ অংশ বিভিন্ন আকারের ও আয়তনের কণা সহযোগে গঠিত। মাটির কণা বলতে মাটিতে উপস্থিত বালি, পলি ও কর্নম কণাকে বুঝায়। কোন কোন মাটির কণা স্কুল ও মোটা, মাবার কোন কোন মাটির কণা সূক্ষ্ম। আকার অনুসারে মাটির একক কণার পারস্পরিক সমস্যয়কে বুনট বলে। কণার ভিন্নতার জন্য মাটির গুণাবলী বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। কণার আয়তন ভেলে মাটির কণাগুলোর নাম ও আয়তন নিচে উল্লেখ করা হলো।
মাটি কণার নাম মোটা বালিকণা
আয়তন (মি.মি. ব্যাস)
2.0-0.2
0.2-0.02
পলিকণা
0.02 0.002
করুণা
০.০০২ এর কম
মাটির বুনটের উপর ভিত্তি করে মাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
(১) বেলে মাটি
(২) দো-আঁশ মাটি ও
(৩) এঁটেল মাটি
(১) বেলে মাটি
যে মাটিতে শতকরা ৭০ ভাগ বা তার ও বেশি বালিকণা থাকে তাকে বেলে মাটি বলে। বেলে মাটিতে পলি ও কর্দম কণার পরিমাণ কম থাকে। এ মাটি চিলা ও ঝুরঝুরে পানি ধারণ ক্ষমতা কম এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকায় এ মাটি অনুর্বর।
মোটা কণাযুক্ত বেলে মাটি কৃষি কাজের অনুপোযগী। তবে সূক্ষ্ম কণাযুক্ত বেলে মাটিতে প্রচুর কম্পোস্ট, গোবর ও সবুজ সার প্রয়োগ করে চিনা, কাউন, ফুটি, আলু, তরমুজ ইত্যাদি চাষ করা সম্ভব। দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার কিছু অঞ্চলে ও অন্যানা জেলার প্রধান নদীর চনা ও তীরে এ মাটি দেখা যায়।
(২) দো-আঁশ মাটি
যে মাটিতে বালিকণার পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগের কম কিন্তু ২০ ভাগের বেশি তাকে নো- আঁশ মাটি বলে। তবে আদর্শ দো-আঁশ মাটিতে অর্ধেক বালিকনা এবং বাকি অর্ধেক পলি ও কদম কণা থাকা আবশ্যক। এ মাটির পানি শোষণ ও ধারণ ক্ষমতা বেলে মাটির তুলনায় বেশি।
চাষ আবাদের জন্য এ মাটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী। এ জন্য সব ধরনের ফসল এ মাটিতে ভাল জন্যে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মাটি দো-আঁশ প্রকৃতির। কৃষিক্ষেত্রে দো-আঁশ মাটিকে আদর্শ মাটি বলা হয়।
দো-আঁশ মাটিকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
(ক) বেলে দো-আঁশ মাটি
(খ) পলি দো-আঁশ মাটি;
(গ) এঁটেল দো-আঁশ মাটি ।
(ক) বেলে দোআঁশ মাটি
যে মাটিতে বালিকণার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি সে মাটিকে বেলে দো-আঁশ মাটি বলে। এ মাটিতে বালির পরিমাণ সাধারণত শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ থেকে ৬৫ ভাগ পর্যন্তহতে পারে। তিার পলি অঞ্চলে এ মাটি পাওয়া যায়। এ মাটিতে আলু, মূলা, তামাক, মরিচ ইত্যাদি ফসল ভাল জন্যে।
(খ) পলি দো-আঁশ মাটি
যে মাটিতে পলিকণার পরিমাণ বেশি থাকে সে মাটিকে পলি দো-আঁশ মাটি বলে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পলি দো-আঁশ মাটি অধিকহারে পরিলক্ষিত হয়। এ মাটিতে ধান, পাট, ইক্ষু ও শাকসবজি ভাল জনে।
(গ) এঁটেল দো-আঁশ মাটি
যে দো-আঁশ মাটিতে কম ও পলিকণার পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি তাকে এঁটেল দো-আঁশ মাটি বলে। এ মাটিতে সাধারণত শতকরা ৩৫ ভাগ কর্ণন ও প্রায় সম পরিমাণ পলিকণা থাকতে পারে। গঙ্গার বিধৌত সমভূমি অঞ্চলে এ মাটি বেশি দেখা যায়। এ মাটিতে ধান, গম, তুলা সরিষা, ডাল প্রভৃতি ফসল ভাল জন্মে।
(৩) এঁটেল মাটি
যে মাটিতে কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ কর্নমকণা থাকে তাকে এঁটেল মাটি বলে। এ মাটিতে পলিকনা ও বেশি থাকে। ভেজা অবস্থায় এ মাটি খুব নরম ও শুদ্ধ অবস্থায় অত্যন্ত শক্ত ও কঠিন হয়ে পড়ে। এঁটেল মাটিকে ভারী মাটিও বলা হয়।
এ মাটিতে ছিদ্র কম থাকায় পানি শোষণ ক্ষমতা কম কিন্তু পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি। ঢাকা জেলার উত্তরাংশ টাঙ্গাইল জেলার পূর্বাংশ ও ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এ মাটি দেখা যায়। এ মাটিতে চাষ করা খুব কষ্টকর। প্রচুর জৈব সার প্রয়োগ করে চাষ উপযোগী করা সম্ভব। ধান, পাট, ইক্ষু, শাকসবজি এ মাটিতে ভাল জন্যে।
সারমর্ম
ক্ষয়ীভূত শিলা ও নানা প্রকারের জৈব পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত ভূত্বকের বাইরের দিকের স্তরে গাছপালা জন্মে এবং যে স্তর থেকে গাছপালা পুষ্টি উপাদান শোষণ করে। বেঁচে থাকে, তাকে মাটি বলে।
• মাটি প্রধানত চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত। যথা- খনিজ পদার্থ বা অজৈব পদার্থ, জৈব পদার্থ, পানি ও বায়ু। মাটির কণা বলতে মাটিতে উপস্থিত বালি, পলি ও কর্নম কণাকে বুঝায়।
• মাটির একক কণার পারস্পরিক সমন্বয়কে বুনট বলে।
• বুনট অনুসারে মাটি তিন প্রকার। যথা- বেলেমাটি, দো-আঁশ মাটি ও এঁটেল মাটি।