মৃত্তিকার জৈবিক উপাদান নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান – ১২০৪ কোর্সের ইউনিট ৪ এর, ৪.১ নম্বর পাঠ।
Table of Contents
মৃত্তিকার জৈবিক উপাদান
মৃত্তিকা জৈবিক উপাদানসমূহ প্রধানত দু’ধরনের। যথা : বিভিন্ন ধরনের বড় ও ক্ষুদ্র জীব এবং প্রাণহীন বিভিন্ন জৈব অবশেষ যা জৈব পদার্থ, হিউমাস ইত্যাদি নামে পরিচিত। জৈব পদার্থ ও হিউমাস বিভিন্ন জীবের দেহ বা দেহাংশের পচনশীল অবশেষ।
জৈব পদার্থের উপাদান বা গঠন:
জৈব পদার্থ নিম্নলিখিত উপাদান সমূহ বিভিন্ন অনুপাতে ধারণ করে।
নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার জৈব পদার্থ রূপে থাকলেও সহজে নষ্ট হয় না। জৈব পদার্থে কাইটিন, নিউক্লিক এসিড ও নিউক্লিওটাইড নামক ফসফরাসের যৌগ থাকে। বিয়োজনের ফলে এগুলো থেকে ক্যাটায়ন, অর্থোফসফেট বেরিয়ে আসে। এমাইনো এসিড, সিস্টাইন ও সিস্টিন নামক সালফার ঘটিত যৌগও জৈব পদার্থে থাকে।
কালক্রমে এরা সালফার এর অজৈব যৌগরূপে দেখা যায় । মৃত্তিকার হিউমাস কণিকায় কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস ও অন্যান্য মৌলিক পদার্থ থাকে । দেখা যায় জৈব পদার্থে কার্বন শতকরা ৫০-৬০ ভাগ, নাইট্রোজেন ৩-৬ ভাগ, অক্সিজেন ৩৫ ভাগ, হাইড্রোজেন ৫ ভাগ ও ক্ষার (ছাই) ৫ ভাগ (আনুমানিক) থাকে।
হিউমাসের সংজ্ঞা:
মৃত্তিকার জৈব পদার্থ সম্পূর্ণ বিয়োজনের পর অবশিষ্ট দ্রব্য যা তুলনাম লকভাবে স্থায়ী, বিয়োজন প্রতিরোধী, গাঢ় কাল থেকে বাদামী বর্ণের এবং প্রোটিন ও লিগনিন সমন্বয়ে গঠিত, তাকে হিউমাস বলা হয়। জীবাণুর উৎসেচকের অনুঘটক প্রক্রিয়ার ফলে জৈব পদার্থের বিয়োজন ঘটে থাকে। এ বিয়োজনের উপজাত হলো বাদামী বা গাঢ় বাদামী রংয়ের জটিল অনিয়তাকার অসমসত্ব (Heterogeneous) এক প্রকার মিশ্রণ। লিগনিন, প্রোটিন, ও প্রোটিন কাদা জাতীয় উপরোক্ত পদার্থগুলোই এ মিশ্রণের উপাদান। এ মিশ্রণই হিউমাস।
হিউমাসের বৈশিষ্ট্য:
১। গাঢ় বাদামী থেকে কালো বর্ণের।
২। পানিতে অদ্রবণীয় তবে ক্ষারে দ্রবণীয়।
৩। রাসায়নিক গঠন বড়ই জটিল।
8। শতকরা আনুমানিক ৩০ ভাগ আমিষ, ৩০ ভাগ লিগনিন ও ৩০ ভাগ জটিল চিনি ধারণ করে।
৫ । শতকরা ৫৫-৫৮ ভাগ কার্বন, ৩-৬ ভাগ নাইট্রোজেন এবং সিলিকন, এলুমিনিয়াম ও লৌহ ধারণ করে।
৬। কার্বন নাইট্রোজেন অনুপাত ১২৪১ ।
৭। সংকোচন ও প্রসারন গুণে সমৃদ্ধ।
৮। ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা বেশি।
৯। জৈব পদার্থের শতকরা ৮৫-৯০ ভাগই হিউমাস।
হিউমাস ও জৈব পদার্থের পার্থক্য:
কার্বন-নাইট্রোজেন অনুপাত (CN):
মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের মোট কার্বন ও নাইট্রোজেনের অনুপাতকে কার্বন-নাইট্রোজেন (সি-এন) অনুপাত বলে। চাষের জমিতে জৈব পদার্থে সি এন অনুপাত ৮:১ হতে ১৫ঃ১ হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১০ঃ১ থেকে ১২৪১ থাকে। বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও জৈব পদার্থের গুণাগুণ সি-এন অনুপাতের তারমত্য ঘটায়। এখানে একটি তালিকায় বিভিন্ন ধরনের জৈব পদার্থের সি-এন এর অনুপাত সাজানো হলো।
সি এন অনুপাতের গুরুত্ব:
কোন জৈব পদার্থের সি-এন অনুপাত অধিক হলে বুঝা যায় তাতে কার্বনের পরিমাণ বেশি ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম এবং তা পুনরায় বিয়োজিত হবে। কোন মাটিতে অধিক সি এন অনুপাত যুক্ত জৈব পদার্থ প্রয়োগ করলে তার হেটারোট্রফিক (Heterotrophic) জীবাণু যথাঃ ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও একটিনোমাইসিটিস অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠে এবং ঐ জৈব পদার্থের বিভাজন/বিশেষণ ঘটায়। এতে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা অণুজীবরা তাদের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে এবং দ্রুত বংশ বিস্তার করে।
দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৩৫% কার্বন অণুজীবরা জৈব পদার্থ হতে গ্রহণ করে এবং বাকী ৬৫% কার্বন বায়বীয় অবস্থায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং জলাবদ্ধ অবস্থায় H2CO3 এবং CH, এ পরিণত হয়।
এই অধিক সংখ্যক জীবাণু দেহগঠনের জন্য মাটির অজৈব NH, NO 3 গ্রহণ করে এবং নিজেদের দেহে জৈব অবস্থায় রূপান্তরিত করে। কিছু নাইট্রোজেন গাছ গ্রহণ করে এবং বাকীটুকু NO3 অবস্থায় চুয়ানের মাধ্যমে অপচয় হয়। এই চুয়ানোর ফলে সি-এন অনুপাত কমে ১০ঃ১ অনুপাতে নেমে আসে যা সমস্ত কৃষি শস্যের জন্য উপযোগী।
এ সময়ে কার্বনের পরিমাণ কমে যাওযায় অণুজীবসম হ মারা যায় এবং তাদের দেহ পুনরায় বিয়োজিত হয় এবং মাটিতে নাইট্রোজেন মুক্ত হয় যা গাছের জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, অধিক সি-এন যুক্ত জৈব পদার্থ মাটিতে প্রয়োগ করলে অণুজীবের কার্যকারীতা ও নাইট্রোজেনর সহজলভ্যতা বেড়ে যায়।
হিউমিক এসিডের বৈশিষ্ট্য:
১। হিউমিক এসিড শতকরা ৫০-৬০ ভাগ কার্বন, ৪ ভাগ হাইড্রোজেন, ৪০ ভাগ অক্সিজেন ধারণ করে এবং কার্বন ও নাইট্রোজেন অনুপাত ১৪ঃ১।
২। ইহা উচ্চ আণবিক ওজন ( ৩০,০০০-৫০,০০০) সম্পন্ন যৌগ।
৩। ইহা উচ্চ ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা সম্পন্ন (৫৪৯ মিঃতুঃ / ১০০ গ্রাম মাটি)।
8। সংযুক্তিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ পরিবর্তনশীল ।
৫ ৷ পড়জল ও চারনোজেম মাটি থেকে নিষ্কাশিত হিউমিক এসিড হাইড্রোফিলিক।
ফালভিক এসিডের বৈশিষ্ট্য:
১। ক্রিণিক এসিড ও এপোক্রিনিক এসিড যৌথভাবে ফালভিক এসিড বলে পরিচিত।
২। ফালভিক এসিড শতকরা ৪০-৪৭ ভাগ কার্বন ও ৪২-৫০ ভাগ অক্সিজেন ধারণ করে।
৩। উচ্চ আণবিক ওজন সম্পন্ন যৌগ।
8। পানি, এলকোহল ও ক্ষারে দ্রবণীয়।
৫ ৷ অল্প ঘনত্বের ফালভিক এসিড হালকা হলুদ, তবে অধিক ঘনত্বের হলে কমলা হলুদ রঙের হয়।
৬ ।ক্রিনিক এসিড হলদে ও এপোক্রিনিক এসিড বাদামী রংয়ের হয়ে থাকে।
৭। ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা ৩০০-৪০০ মিঃতুঃ /১০০ গ্রাম মাটি।
৮। এতে কার্বোক্সিল, মিথোক্সিল ও হাইড্রোক্সিল গ্রুপ বিদ্যমান, ফলে পার্শ্ব বিক্রিয়ার প্রভাব অধিক।
হিউমিন ও এলমিনের বৈশিষ্ট্য:
১। এরা যথাক্রমে হিউমিক ও এলমিক এসিড, তবে অণু ছোট।
২। এরা প্রকৃত হিউমিক এসিড তবে মাটির খনিজ অংশের সাথে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলায় ক্ষারে অদ্রবণীয়।
৩। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার ও অন্যান্য মৌল ধারণ করে।
হেমাটোমেলানিক এসিডের বৈশিষ্ট্য:
১। আণবিক ওজন প্রায় ৮০০।
২। কার্বনের পরিমাণ অন্যান্য এসিডের তুলনায় বেশি।
৩। ইহা পানি, এলকোহল ও ক্ষারে দ্রবণীয়।
8। হিউমিক এসিডের ডেরিভেটিভ।
৫ । এতে কার্বোক্সিল, ফেনোলিক ও মিথোক্সিল গ্রুপ বিদ্যমান।
সূত্র:
- মৃত্তিকার জৈবিক উপাদান – পাঠ ৪.১, ইউনিট ৪ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
আরও দেখুন: