মৃত্তিকা পার্শচিত্র নিয়ে আজকের আলোজনা। আমরা জানি, পঙ্গুলিকরণ, ল্যাটেরাইজিকরণ ও চুনীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। পুকুর খনন, খাল খনন কিংবা নির্মাণ কাজের জন্য ভূমি খনন আপনারা নিশ্চয় দেখে থাকবেন। এসব খন কাজের সময় লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, ভূপৃষ্ঠে উপর থেকে যতই গভীরে যাওয়া যায় মাটির বর্ণ ততই পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ উপরের স্তরের মাটির বর্ণ নিচের স্তরের মতো নয়। গভীরতার সাথে সাথে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বর্ণের মাটি দেখা যায়। সূতরাং মাটিকে লম্বচ্ছেদ করলে উপর থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নানা বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পন্ন বিভিন্ন গভীরতা বিশিষ্ট অনেকগুলো স্তর দেখা যায়। এ স্তরগুলোকে একত্রে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Soil Profile) বলে।
Table of Contents
মৃত্তিকা পার্শচিত্র
একটি মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রে সাধরণতঃ ২-৩ টি স্তর দেখা যায়। এরা ভূ-পৃষ্ঠের সমান্তরালে একটির পর একটি বিন্যস্ত থাকে। স্তরগুলো একটি হতে অপরটি এক বা একাধিক ধর্ম যেমনঃ বুনট, সংযুক্তি, বৰ্ণ, স্তরের পুরুত্ব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পৃথকীকৃত। বুনট হলো কোন মৃত্তিকায় অবস্থিত বালি, পলি ও কর্দম কণার আপেক্ষিক অনুপাত। আর মৃত্তিকার দলা গঠনের ক্ষমতাকে সংযুক্তি বলে। মৃত্তিকার বুনট ও সংযুক্তি নিয়ে পরবর্তী ইউনিটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্রে বিভিন্ন স্তরের বুনট, গভীরতা, বর্ণ ও রাসায়নিক প্রকৃতি প্রভৃতি মৃত্তিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ করে। এসব বৈশিষ্ট্যাবলীর ওপর ভিত্তি করে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মৃত্তিকার গুরুত্ব নির্ধারিত হয়। মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে মৃত্তিকা সম্পদের সুষ্টু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
হরাইজন কী (What is Horizon):
মৃত্তিকাকে লম্বচ্ছেদ করলে নানা বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পন্ন এবং বিভিন্ন গভীরতাবিশিষ্ট কতগুলো স্তর দেখা যায় যারা ভূ-পৃষ্ঠের সমান্তরালে একটির পর একটি বিন্যস্ত থাকে, এ সকল স্তরের প্রত্যেকটিকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে হরাইজন (Horizon) বলে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে হরইজনগুলো একটি অন্যটি থেকে পৃথক থাকে।
ক) স্তরের বুনট
খ) সংযুক্তি
গ) বর্ণ
ঘ) স্তরের পুরুত্ব
একটি আদর্শ মৃত্তিকা প্রোফাইলের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা :
আলোচনা ও বর্ণনার সুবিধার্থে মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন স্তরগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ O, A, B ও C স্তর। নিম্নে এদের বর্ণনা করা হলো :
(১) o স্তর বা জৈব স্তর :
এটি খনিজ স্তরের উপরের স্তর। কোন কোন প্রোফাইলে এ স্তর দেখা যায়, আবার কোন কোন প্রোফাইলে দেখা যায় না। উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের অবশেষ জমা হয়ে স্তর সৃষ্টি হয়। সাধারণতঃ বন অঞ্চলে এই স্তর দেখা যায়। কিন্তু তৃণ ভূমিতে তা দেখা যায় না। এ স্তরের আবার দু’টি উপস্তর আছে। উপস্তর গুলো নিম্নরূপ ঃ
(ক) 0, উপস্তর : একে Aoo স্তরও বলা হয়। এ জৈব স্তরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষের প্রকৃত গঠন খালি চোখে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
(খ) O2 উপস্তর : একে Ao স্তরও বলা হয়। O স্তরের সংলগ্ন এবং কিছুটা নিচে অবস্থিত। এখানে প্রাণী ও উদ্ভিদ দেহবাশেষের প্রকৃত গঠন ততটা আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না।
(২) A স্তর :
একে ‘এলুভিয়েল স্তর’ ও (Eluvial layer) বলা হয়। একটি খনিজ স্তর যাহা ভূপৃষ্ঠে অথবা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি। অবস্থান করে। এ স্তর হতে বিভিন্ন প্রকার খনিজের চুয়ানী বা এলুভিয়েশন’ ঘটে। খনিজ স্তরের উপরের দিক হতে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে স্তরকে যথাক্রমে A1, A2, A3 ইত্যাদি উপস্তরএ বিভক্ত করা যায়। যেমনঃ
(ক) A উপস্তর :
খনিজ স্তরের সবচেয়ে উপরের স্তর। ইহা প্রচুর হিউমাস মিশ্রিত জৈব পদার্থ ধারণ করে। ফলে এই উপস্তর নিচের স্তরগুলো অপেক্ষা গাঢ় বর্ণ ধারণ করে।
(খ) A, উপস্তর ঃ
এই উপস্তর হতে কদম, লৌহ,, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি সবচেয়ে বেশি। পরিমাণে চুয়ানী বা এলুভিয়েশন ঘটে। A2 উপস্তর সাধারণত Ar অপেক্ষা হালকা বর্ণের হয়।
(গ) A3 উপস্তর :
এটি A ও B স্তরের সংযোগকারী একটি স্তর। তথাপি ইহা B স্তর অপেক্ষা A ও A2 উপস্তরের ধর্মাবলী বেশি প্রদর্শন করে। কোন কোন প্রোফাইলে এই উপস্তরটি অনুপস্থিত থাকে।
(৩) B স্তর :
একে ইলুভিয়েল স্তর (Illuvial layer) ও বলা হয়। স্তরের Fe, A1 এর যৌগ কাদা ও হিউমাসের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। যৌগগুলো সাধারণত A স্তর হতে চুয়ানীর মাধ্যমে আসে। অনেক সময় শুকনো ও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে CaCO3, CaSO ও অন্যান্য লবণ এ স্তরের নিচের দিকে জমতে দেখা যায়। স্তর আবার B1, B2 ও B3 উপস্তরে বিভক্ত।
(ক) B, উপস্তর :
এটি A ও B স্তরের সংযোগকারী স্তর এবং ধর্মাবলী A স্তরের এর তুলনায় B স্তরের সাথে বেশি সাদৃশ্য বহন করে। কোন কোন প্রোফাইলে এই স্তরটি অনুপস্থিত থাকে।
(খ) B2 উপস্তর :
A2 ও তার নিচের স্তর হতে নেমে আসা কর্দম কণা, লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের অধিকাংশই এ স্তরে জমা হয়। জৈব বস্তু ধারণ ক্ষমতা A2 স্তরের তুলনায় অধিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের সংযুক্তি ব্লকী অথবা প্রিজমেটিক অথবা উভয়ই হয়ে থাকে।
(গ) B3 উপ স্তর : এ স্তর B এবং C স্তরের মাঝামাঝি। এর ধর্ম C স্তর অপেক্ষা অনেকটা B ও B2 স্তরের কাছাকাছি।
(8) C স্তর :
এটি বিকৃত শিলা দ্বারা গঠিত সোলামের (Solum) [ A ও B স্তর] নিচের স্তর। এটি উৎস বস্তুর অনুরূপ হতে অথবা নাও হতে পারে। এ স্তরে অণুজৈবিক কার্যাবলী অনুপস্থিত এবং আয়তনী ঘনত্ব বেশি। ইহার উপরের স্তর শিলাক্ষয় প্রক্রিয়ায় কালক্রমে সোলামের (প্রকৃত মাটি) অংশ তৈরি করে।
(৫) D স্তর / R স্তর :
একে ভূগর্ভস্থ শিলা স্তরও বলা হয়। এই স্তরের উৎস বস্তুর (Parent material) যেমন : বেলে পাথর, চুনা পাথর, গ্র্যানাইট প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত। সব মৃত্তিকা প্রোফাইলে সব স্তর নাও থাকতে পারে। কারণ ভূমিক্ষয়ের দরুন উপর হতে দু’একটি স্তর বা উপস্তর ক্ষয় হয়ে যেতে পারে।

সোলাম কী? (What is Solum):
উৎস দ্রব্যের (Parent material) উপরে অবস্থিত মৃত্তিকা প্রোফাইলের উপরের অংশ যেখানে মৃত্তিকা গঠনের প্রক্রিয়া গুলো সংঘটিত হয় তাকে সোলাম (Solum) বলে। উন্নত মাটিতে এটি A ও B স্তর নিয়ে গঠিত। একে প্রকৃত মাটিও বলা হয়। শিলাক্ষয় প্রক্রিয়ায় উৎস বস্তুর বা C স্তরের উপরের অংশ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে এ সোলামের অংশ তৈরি হয়।
রিগোলিথ কী (What is regolith):
মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রে A, B ও C স্তর মিলে যে গঠন প্রাপ্ত হয় তাকে রিগোলিথ বলে। C স্তর সামান্য বিকৃত শিলা দ্বারা গঠিত বলে রিগোলিথে বিকৃত শিলা দেখা যায়। সেজন্য একে উৎসদ্রব্য বা আদি উপাদানের স্তরও বলা হয়৷
সোলাম ও রিগোলিথের মধ্যে পার্থক্য (Differences between solum and regolith) সোলাম ও রিগোলিথের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হয়।
সূচি:
- মৃত্তিকা পার্শচিত্র ,পাঠ ১.৬, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
আরও দেখুন: