মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৫ , সাধারণতঃ কীটপতঙ্গের নাম শুনলেই আমরা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকি। ধারণা করে থাকি এরা খুব ক্ষতিকর। ইহা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ অনেক পোকা আছে যা আমাদের প্রভৃত উপকার করে থাকে। এর মধ্যে মৌমাছি অন্যতম।
Table of Contents
মৗমাছি পালন ও মধু উৎপাদন , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৬
কারণ মধু ও মোমের জন্য মৌমাছি সকলের নিকট খুবই প্রিয়। এছাড়াও এরা ফসলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ফলন অনেক বাড়িয়ে দেয়। মধু ও মোম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে মৌমাছি পালন করার বিদ্যাকে মৌমাছি পালনবিদ্যা বলা হয়। সাধারণতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মৌমাছি সংগ্রহ করে এনে মৌবাক্সে মৌচাকের উপযোগী কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করাকে মৌমাছি চাষ বলা হয়। মৌমাছি একটি সামাজিক পোকা। এরা কলোনী তৈরি করে একসাথে বসবাস করে। এই পোকার মধ্যে শ্রমবিভাজন দেখা যায়। শ্রমবিভাজন অনুসারে এই পোকাদের ৩টি শ্রেণি বা কাস্টে বিভক্ত করা হয়। যথা :
(১) রাণী মৌমাছি
(২) কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি
(৩) পুরুস মৌমাছি।
১। রাণী মৌমাছি:
মৌমাছির যে কোনো কলোনীতে বা মৌচাকে প্রজনন কার্য সম্পন্ন করার জন্য একটি মাত্র স্ত্রী মৌমাছি দেখা যায়, একে রাণী মৌমাছি বলা হয়। রাণী মৌমাছি কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় আকারে বড়। সে কলোনীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং রাণী—প্রকোষ্ঠে বাস করে। যৌন সঙ্গম ও ডিম পাড়া ছাড়া রাণী অন্য কেনো কাজ করে না। সে তার জীবদ্দশায় পুরুষ মৌমাছির সাথে এক বা একাধিকবার মিলনে যেতে পারে। কলোনীর বাইরে কুমারী রাণীর সাথে পুরুষ মৌমাছির মিলন হয়। মিলনের বাসনায় কুমারী রাণী শুষ্ক আবহাওয়ায় মৌচাকের বাইরে এসে উড়তে শুরু করলে চাকের পুরুষ মৌমাছিরা তার পিছু ছুটতে থাকে।
পুরুষদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ চলার পর যে পুরুষটি যুদ্ধে জয়লাভ করে সর্বপ্রথম রাণীর কাছে পেঁৗছাতে পারে সে পুরুষ মৌমাছিটির সাথেই কুমারী রাণী মিলনে লিপ্ত হয়। মিলনের পর পুরুষ মৌমাছিটি মারা যায়।
মিলনের পর রাণী মৌমাছি গর্ভবতী হয়ে কলোনীতে ফিরে আসে এবং সময়মত ডিম দিতে শুরু করে। দেখা গেছে যে, একটি রাণী মৌমাছি তার দেহের জনন থলির মধ্যে প্রায় ২ কোটি শুক্রাণু জমা করে রাখতে পারে। একটি রাণী মৌমাছি গড়ে প্রতিদিন ৩০২১ টি করে ডিম দিতে পারে। এই রাণী মৌমাছি দু’ধরনের ডিম পেড়ে থাকে ক) নিষেককৃত ডিম ও খ) অনিষেককৃত ডিম। নিষেককৃত ডিম থেকে কর্মী মৌমাছি এবং অনিষেককৃত ডিম থেকে পুরুষ মৌমাছি তৈরি হয়ে থাকে। মৌচাকের মধ্যে রয়েল জেলী থাকে।
এই রয়েল জেলী মৌমাছির লার্ভাকে ৬—৭ দিন খাওয়ালে তা রাণী মৌামাছি এবং ৩ দিন খাওয়ালে তা কর্মী মৌমাছিতে পরিণত হয়। একই মৌচাকে একাধিক রাণী মৌমাছি থাকলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধে জয়ী রাণীই একমাত্র বেঁচে থাকে, বাকীরা মারা যায়। যে রাণী বেঁচে থাকে, কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিরা তার নির্দেশ মেনে এবং তাকে অনুসরণ করে অন্যত্র কলোনী তৈরি করে। তবে স্বাভাবিকভাবে একটি রাণী মৌমাছি নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম দেওয়ার পর সে মারা যায় এবং নতুন রাণীর উদ্ভব ঘটে।
২। কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি:
কলোনীর সব মৌমাছির তুলনায় এরা আকারে সবচেয়ে ছোট। তবে খুবই শক্তিশালী ও পরিশ্রমী এবং এদের পেটের শেষ খন্ডাংশে একটি হুল থাকে। একটি কলোনীতে প্রায় ২০,০০০—৩০,০০০ কর্মী মৌমাছি থাকে। এরা বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি। এই মৌমাছির গায়ে লোম থাকে যা দেখতে চিরুনীর মত যা মধু ও পরাগ সংগ্রহে সহায়তা করে এবং এদের পিছনের দু’পায়ে পরাগ থলে থাকে। এদের কাজ হলো মৌচাক তৈরি করা, মৌচাক রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা, মৌচাক পরিস্কার করা ও পাহারা দেয়া, মধু অনুসন্ধান ও সংগ্রহ করা, রাণীকে খাওয়ানো ও রাণীর পরিচর্যা করা, বাচ্চাদের খাওয়ানো ও তাদের লালন পালন করা, মোম প্রস্তুত করা ইত্যাদি। একটি কর্মী মৌমাছি ৪২—১৮০ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
৩। পুরুষ মৌমাছি:
এরা আকারে কর্মী মৌমাছির চেয়ে বড়, কিন্তু রাণী মৌমাছির তুলনায় ছোট। এরা সাধারণতঃ কালচে রঙের হয় এবং এদের শরীর বেশ শক্ত ও মজবুত হয়। তবে এরা অত্যন্ত অলস প্রকৃতির। খাবারের জন্য এরা কর্মী মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল। জীবনের অধিকাংশ সময়ই এরা মৌচাকের মধ্যে ঘুমিয়ে সময় কাটায়। বাকী সময় উজ্জ্বল রোদে মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়িয়ে জীবনকে উপভোগ করে। প্রতিটি কলোনীতে স্বল্পসংখ্যক পুরুষ মৌমাছি থাকে। মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে কর্মী মৌমাছিরা আক্রমণ করে এদেরকে মেরে ফেলে। পুরুষ মৌমাছির প্রধান কাজই হলো রাণীর সাথে যৌন সঙ্গমে মিলিত হয়ে রাণীকে গর্ভধারণ করানো। রাণীর সঙ্গে যৌন মিলন হওয়ার পর পরই পুরুষ মৌমাছিটি মরে যায়। একটি পুরুষ মৌমাছি সাধারণতঃ ৯০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন পৃথিবীতে প্রায় ২০,০০০ বিভিন্ন প্রকার ভ্রমর জাতীয় মাছি (নবব) আছে। এদের মধ্যে সারাবিশ্বে চার প্রজাতির মৌমাছি অর্থনৈতিকভাবে পরিচিত। তা হলো— ভারতীয় মৌমাছি (অঢ়রং রহফরপধ), ইউরোপীয় মৌমাছি (অঢ়রং সবষষরভবৎধ), বৃহদাকার বা পাহাড়ী মৌমাছি ও ক্ষুদে বা ক্ষুদ্রাকৃতির মৌমাছি (অঢ়রং ভষড়ৎবধ)। ইউরোপীয় মৌমাছি ছাড়া বাকী তিন প্রজাতির মৌমাছি বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে মধু উৎপাদনের জন্য ভারতীয় মৌমাছি সবচেয়ে বেশি উপযোগি।
এরা বেশ শান্ত স্বভাবের এবং খুব সহজে পোষ মানে। ফলে মৌমাছি পালকরা অনায়াসে এদের নিয়ে কাজ করতে পারে। কাঠ বা প্যাকিং বাক্স, কেরোসিনের টিন অথবা দেয়ালের কুঠুরীতে এদেরকে পালন করা হয়ে থাকে। এদেরকে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে কৃত্রিম বাসস্থান তৈরি করে সেখানে তাদের উপযোগি পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে পালন করাকেই আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করা বোঝায়। নিচে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালনের ধাপসমূহ বর্ণনা করা হলো।
১। রাণী মৌমাছি সংগ্রহ :
চার উপায়ে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করা যায়। যথা—
(ক) রাণী, বেশ কিছু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিসহ মৌবাক্স কিনতে পাওয়া যায়। (খ) মাঠ ফসল বা উদ্যান ফসলে ফুল ধরার সময় জাল দ্বারা রাণীসহ কর্মী মৌমাছি ধরা যায়। জালে আটকানো রাণী মৌমাছিকে কাপড় বা ন্যাকড়া দ্বারা আস্তে করে ধরে কৃত্রিম মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে ঢুকিয়ে আটকিয়ে দিতে হয়। রাণী মৌমাছি চেনার উপায় হলো— আকারে সবচেয়ে বড়, খয়েরী বর্ণের ছোট হুল যা দেখতে ছুরির মত, ডানা ছোট এবং বুক বড় হয়।
(গ) গাছের ডাল, বাড়ী—ঘর বা দালান—কোঠার আনাচে কানাচে, মাঠির গর্ত বা গুহায় প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছি কলোনী বা চাক তৈরি করে। কোনো জ্বালানী দ্বারা আগুনের ধুঁয়া তৈরি করে মৌচাকে ধঁুয়া লাগাতে হবে। কারণ মৌমাছিকে ধঁুয়া দ্বারা কাবু করা যায়। এতে পুরুষ ও কর্মী মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে কাছাকাছি স্থানে সরে যাবে, কিন্তু রাণী মৌমাছি সরবে না। এই অবস্থায় মৌচাক থেকে সাবধানে রাণী মৌমাছিকে ধরে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকাতে হয়। সাধারণতঃ কম বা মাঝারী বয়সের মৌচাক থেকে রাণী সংগ্রহ করলে সহজে পোষ মানে। কিন্তু পুরাতন মৌচাকের রাণী সহজে পোষ মানে না।
(ঘ) আগুনের ধঁুয়া দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মৌচাকের মৌমাছিকে সরাতে হয় অথবা শান্ত করতে হয়। পরে মৌচাকের অবস্থান বুঝে একটি কাঠি ঢুকিয়ে ছুরি বা চাকু দ্বারা মৌচাকের গোড়া কেটে দিয়ে চাককে আলাদা করা হয়। চাকের অপ্রয়োজনীয় ও পচা অংশ কেটে ফেলা হয়। চাকটি কাঠিতে এমনভাবে রাখতে হয় যেন ঝুলে থাকে। এই সময় রাণী মৌমাছি ঝাঁক হয়ে বসে থাকা মৌমাছিদের উপরে বা বাইরের দিকে থাকে। সেখান থেকে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে বসাতে হয়। কোনো কারণে রাণী মৌমাছিকে খঁুজে পাওয়া না গেলে ধঁুয়া বা হাত দ্বারা সকল মৌমাছিকে মৌবাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়।
এতে সকল মৌমাছির সাথে রাণীর যাওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকে। রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে না ঢুকে থাকলে কর্মী মৌমাছিরা রাণীকে নিয়ে ঝাঁক বেঁধে বসে থাকে। সেখান থেকেও রাণী মৌমাছিকে সংগ্রহ করে মৌবাক্সের রাণীর কুঠুরীতে আটকানো যায়।
২। সংগ্রহকৃত রাণী মৌমাছি মৌবাক্সে স্থাপন :
উপরে বর্ণিত যে কোনো পদ্ধতিতে রাণী মৌমাছি সংগ্রহ করে রাণীকে কুঠুরী বা খাঁচায় আটকিয়ে মৌবাক্সের ফ্রেমের ভিতর রেখে কুঠুরীর ঢাকনা বা মুখ খুলে দিলে কুঠুরী থেকে বের হয়ে রাণী ফ্রেমের ভিতর থাকে, কিন্তু মৌবাক্স থেকে বের হতে পারে না। কারণ মৌবাক্সের ছিদ্র তার জাল দিয়ে আটকানো থাকে। রাণী মৌমাছির আকার বড় বলে তারজালের ছিদ্র দিয়ে বের হতে পারে না। কিন্তু কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি রাণীর চেয়ে আকারে ছোট বলে তারা তারজালের ছিদ্র দিয়ে মৌবাক্সের ভিতর সহজে আসা—যাওয়া করতে পারে। রাণী মৌমাছির দেহ থেকে এক ধরনের সুগন্ধ নিঃসৃত হয়।
এই সুগন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি ঝাঁকে ঝাঁকে মৌবাক্সের ভিতর প্রবেশ করে। এভাবে মৌবাক্সে রাণীকে ৪—৫ দিন আটকিয়ে রাখার পর কর্মী মৌমাছিরা কলোনী বা মৌচাক তৈরি করা শুরু করে। তারপর মৌবাক্সের ঢাকনা খুলে দিলেও রাণী মৌমাছি কোথাও চলে যায় না। মৌবাক্সের প্রবেশ পথে একটি পাত্রের মধ্যে চিনির সিরা রেখে দিলে তা খেয়ে মৌমাছিরা স্বাভাবিক ও শান্ত থাকে।
৩। মৌবাক্স উদ্যান বা ফসল মাঠে স্থাপন :
উদ্যান বা মাঠ ফসলের জমিতে ফুল ধরার আগে মৌবাক্সগুলোকে লোহা বা কাঠের তৈরি ৪ পায়া বিশিষ্ট ১.৫—২.০ ফুট উঁচু টুলের উপর স্থাপন করতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ফুলের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও সরিষা, তিল, তুলা, পিঁয়াজ, আম, জাম, লিচু, ভূট্টা প্রভৃতি ফুলের প্রতি মৌমাছির আসক্তি একটু বেশি। প্রতি হেক্টর সরিষার জমিতে ১০টি মৌবাক্স ১০০ মিটার দূরত্বে উত্তর—পূর্বমুখী করে বসাতে হয়। কারণ পূর্ব বা পশ্চিমমুখী করে বসালে রোদে মৌচাক নষ্ট হবে। আবার সোজা উত্তরমুখী করে বসালে শৈত্যপ্রবাহ এবং দক্ষিণমুখী করে বসালে বৃষ্টির পানিতে মৌচাকের ক্ষতি হবে। মৌবাক্সে স্থাপনের সময় মৌমাছি প্রবেশ পথের সামনে যাতে ফাঁকা জায়গা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে মৌমাছি সহজে চলাফেরা করতে পারে।
একটি উন্নত মৌবাক্স দু’টি অংশ নিয়ে গঠিত। মৌবাক্সের নিচের বড় কক্ষটি হলো বাচ্চার ঘর এবং উপরের ছোট কক্ষটি হলো মধু সঞ্চয়ের ঘর। বাক্সের সবার উপরে ঢাকনা ও সবার নিচে তলা থাকে। ঘর দুটোতে ৫—৭টি ফ্রেম থাকে এবং এই ফ্রেমেই মৌমাছিরা মৌচাক বাঁধে। বাচ্চা ঘরে ৭টি খোপ থাকে। এক খোপ থেকে পরবর্তী খোপের মাঝখানে ৮ মিলিমিটার ফাঁকা থাকে। খোপগুলোতে কাঠের ফ্রেম বসানো থাকে। রাণী মৌমাছি এই ফ্রেমে তৈরি করা চাকে ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার ঘটায়। বাচ্চা ঘর সবচেয়ে বড় ঘর।
মৌবাক্সটি এক ফালি পুরু কাঠের ওপর বসাতে হয়। বাক্সটি কাঠের ওপর বসানোর পর উক্ত কাঠের সামনের দিকে কিছুটা জায়গা বাড়ানো থাকে যাকে পাটাতন বলা হয়। এই পাটাতনের ওপর মাঝে মাঝে মৌমাছিদের কৃত্রিম খাবার দেয়া হয়।
৪। মৌবাক্স রক্ষণাবেক্ষণ :
কমপক্ষে প্রতি ৭ দিন পর পর মৌবাক্স পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তবে ঘন ঘন বাক্স খুললে বিশেষ করে বাচ্চার ঘর খুললে মৌমাছিদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। যদি শত্রু মথের আক্রমণ হয় তবে মৌচাক খুলে রোদে শুকাতে হয়। মৃত লার্ভা বা পিউপা বা বাক্সের তলায় মৌচাকের অন্য কোন ময়লা থাকলে তা পরিস্কার করে ফেলা উচিত। রাণীর ঘর তৈরি হলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। নচেৎ মৌচাক ছেড়ে মৌমাছিদের চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বংশবৃদ্ধিকালে বাচ্চা ঘরে নতুন ফ্রেম লাগাতে হবে। কোনো পুরনো অকেজো চাক বাক্সে থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
প্রয়োজনে বয়স্ক রাণীকে সরিয়ে নতুন রাণীর সংযোজন করতে হবে। তা না হলে মৌমাছিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যেতে পারে। মৌচাকে নবনির্মিত রাণী মৌমাছি, বাচ্চা ও পুরুষ মৌমাছিদের কঠুরীগুলো কেটে নষ্ট করে দিতে হবে। মৌমাছির বংশবিস্তার খুব বেশি হলে তাদেরকে একাধিক বাক্সে ভাগ করে দিতে হবে। আবার খাদ্য সংকটের কারণে মৌমাছির সংখ্যা কমে গেলে একাধিক বাক্সের মৌমাছি একত্র করে এক বাক্সে স্থানান্তর করা উচিত। প্রচুর ফুলযুক্ত স্থানে বাক্স স্থানান্তর করতে হয়। খাদ্য সংকট হলে চিনির সিরা তৈরি করে সরবরাহ করা উচিত।
সিরা কোনো পাত্রে রেখে এর ওপর একটি পাতা বা কাঠি স্থাপন করতে হয় যাতে পাতা বা কাঠির ওপর বসে মৌমাছিরা সিরা খেতে পারে। চিনির সিরা রাতের বেলায় দেয়া উচিত যাতে এক বাক্সের মৌমাছি অন্য বাক্সে গিয়ে মারামারি করতে না পারে। ঝড়—বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে মৌবাক্সটির প্রবেশ পথ বৃষ্টি ও বাতাসের বিপরীতমুখী করে শুষ্ক ও নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত। বাক্সের ওপর পলিথিন শীট দিয়েও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। প্রচন্ড শীতে মৌমাছিদের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য শীতের রাতে চট বা ছালা দিয়ে বাক্স ঢেকে রাখতে হয়। বাক্সে মৌমাছি পালনের সবচেয়ে খারাপ সময় হলো বর্ষাকাল।
এজন্য এসময় খুব খেয়াল রাখতে হয়। বহু শত্রু আছে যারা মৌমাছির বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় অবস্থাতেই ক্ষতি করে। ওয়াক্স মথ, ওয়াক্স বিটল, বোলতা, পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, ব্যাঙ, ইঁদুর, টিকটিকি, রক্তচোষা ইত্যাদি মৌচাকের ক্ষতি করে থাকে। এছাড়াও নসিমা, একারাইন, সেপ্টিসিমিয়া ও প্যারালাইসিস রোগে মৌমাছিদের প্রচুর ক্ষতি হয়। এজন্য সময়মত যে কোনো কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ নিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
৫। মধু আহরণ :
মৌচাকের শতকরা ৭৫ ভাগ কুঠুরী মধু দ্বারা ভরে গেলে মৌমাছিরা মোম দ্বারা কুঠুরীর মুখ বন্ধ করে দেয়। এজন্য মৌচাকের উপর সাদা মোমের স্তর পড়লে বা সাদা চিক চিক করলে বুঝতে হবে মৌচাক মধু দ্বারা পরিপূর্ণ হয়েছে। এবার জ্বালানী দিয়ে আগুনের ধঁুয়া মধু ঘরে লাগালে সব মৌমাছি চাক থেকে সরে পাটাতনের ওপর আসবে। তখন পুরো মৌচাকটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এরপর কাপড় একটু একটু করে সরিয়ে মধুঘর থেকে ফ্রেমসহ মৌচাক বের করতে হয়। চাকে মৌমাছি থাকলে ব্রাশ দিয়ে তাদেরকে বাচ্চা ঘরে ঢুকিয়ে দিতে হয়।
কোনো কোনো সময় মধু ঘরে মৌমাছি থেকে গেলে রাণীর কুঠুরীর সামনে মধু ঘর রেখে একটু নাড়াচাড়া বা বাতাস দিলে মৌমাছিরা বাচ্চা ঘরে ঢুকে যাবে। এই অবস্থায় মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে মধু আহরণ করা হয়। মধু ভর্তি চাক বালতি বা গামলায় রেখে চাকু দিয়ে মৌাচাকের মধু কোষের উপর থেকে মোমের সাদা স্তরটি কেটে ফেলতে হয়। এবার ফ্রেমসহ চাকটি মধু নিষ্কাশন যন্ত্রে রেখে আস্তে আস্তে যন্ত্রটির হাতল ঘুরালে ঐ যন্ত্রে মধু জমা হবে। এবার পরিষ্কার ছাকনি দিয়ে ছেঁকে মধু সংরক্ষণ করতে হবে। মৌমাছিরা তাদের প্রয়োজনে ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে লালার সঙ্গে মিশিয়ে মধু থলিতে করে মৌচাকে নিয়ে আসে।
কর্মী মৌমাছিরা তাদের পাখা নেড়ে বাতাস সৃষ্টি করে সংগৃহীত রস থেকে পানি বাষ্পায়িত করে দেয়। খাঁটি মধু তৈরি হওয়ার পর সেগুলোকে চাকের নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে জমা করে এবং মোম দিয়ে ঐ সমস্ত প্রকোষ্ঠের মুখ বন্ধ করে দেয়। এক পাউন্ড মধু উৎপাদন করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে চাক থেকে বের হয়ে ৪০০০০—৮০০০০ বার ফুল থেকে ফুলে বিচরণ করতে হয়। হিসেবে দেখা গেছে যে, এজন্য একটি কর্মী মৌমাছিকে ৩২০০০—৪২০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়।
মধু উৎপাদনের গুরুত্ব :
১। মধু মহৌষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাশয়, কানপাকা, জিহবার ঘা, জন্ডিস, অর্শরোগ, সর্দি, কাশি, শ্বাসরোগসহ বিভিন্ন রোগের উপশম ছাড়াও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
২। মধু বলবৃদ্ধিকারক, পুষ্টিকর ও মিষ্টিদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
৩। মধুতে ভিটামিন—এ, ভিটামিন—বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন—সি রয়েছে।
৪। মধুতে বিদ্যমান ডেক্সট্রোজ শরীরের দীর্ঘস্থায়ী শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
৫। মধু দেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে।
৬। দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ক, ঈধ, গম, ঝ, ঋব, ঈঁ, চ ইত্যাদি উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করে।
৭। বর্তমানে অনেক লোক মৌমাছি চাষের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়াও বনাঞ্চলের বহু মানুষ প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা চালাচ্ছে।
৮। মৌচাক থেকে প্রসেস করে মোম তৈরি করা হয়। এই মোম ক্রীমজাতীয় প্রসাধনীর প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৯। দরজা, জানালা, প্রাচীরের পুডিং তৈরিতে মোমের ব্যবহার হয়।
১০। জুতার কালি ও কার্বন পেপার তৈরিতে মোম ব্যবহৃত হয়।
১১। রৌপ্যকাররা বিভিন্ন কাজে মোম ব্যবহার করে থাকেন।
১২। বিভিন্ন শিল্প কর্ম ও বাটিকের কাজে মোম ব্যবহৃত হয়।
১৩। বিভিন্ন আসবাবপত্র, জ্বালানী তেল ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরিতেও মোমের ব্যবহার হয়।
১৪। রঙ, বার্ণিশ, সেভিং ক্রীম ও লিপস্টিক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে মোম ব্যবহৃত হয়।
১৫। মৌমাছি পালনে মধু উৎপাদনের পাশাপাশি ফসলের পরাগায়ন ভালভাবে হওয়ায় ফলন প্রায় ২০—৩০% বেশি হয়।
১৬। মধু উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়। একবার মৌবাক্স স্থাপন করলে সারা বছর মধু পাওয়া সম্ভব। একবার তৈরি করা বাক্স দিয়ে কয়েক বছর মধু পাওয়া যায়।
১৭। অন্য যে কোনো পেশার পাশাপাশি মধু উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করা সম্ভব।
১৮। মধু উৎপাদনে কম পঁুজি খাটিয়ে বেশি লাভ করা সম্ভব।
১৯। বেকার লোকেরা মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে আত্ম—কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করে অনায়াসে স্বাবলম্বী হতে পারে।
২০। শস্য শ্যামল বাংলাদেশে মৌচাষ করে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।
আরও দেখুন :
- মাশরুম চাষ , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৫
- রেশম চাষ , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৪
- পাটের রিবন রেটিং , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৩
- রাইজোবিয়াম, এ্যাজোলা ও ট্রাইকোডার্মা সার , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.২
- বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা