রেশম চাষ

রেশম চাষ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি ” বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” বিষয়ের, ৫ নং ইউনিটের ৫.৪ নং পাঠ।

রেশম চাষ

রেশম চাষ

রেশম পোকার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে ইড়সনুী সড়ৎর রেশম চাষে বেশি ব্যবহার করা হয়। এ পোকা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে বিধায় রেশম চাষীকে তুঁত গাছ চাষ করতে হয়। রেশম চাষ এর ইংরেজি হলো Sericulture। ল্যাটিন শব্দ ‘Serio’ থেকে Sericulture শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

রেশম পোকার খাদ্যের জন্য তুঁত গাছ চাষ করে এই পোকার লার্ভা পালন করে তাদের সৃষ্ট গুটি বা কোকুন থেকে রেশম সুতা আহরণ করার পদ্ধতিকে রেশম চাষ বলা হয়। তুঁত গাছ চাষ ও রেশম পোকার লার্ভা পালন ছাড়াও এ পোকার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে অধিক উৎপাদনশীল রেশম পোকা উদ্ভাবন করা আধুনিক রেশম চাষের অন্তভুর্ক্ত। আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু রেশম চাষের জন্য বেশ উপযোগী।

রেশম চাষ , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.৪

 

রেশম চাষের ধাপসমূহ :

১। তুঁত গাছ:

চাষ বন্যামুক্ত ও সুনিষ্কাশিত দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি তুঁত গাছ চাষ করার জন্য উত্তম। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং পতিত জমিতে তুঁত গাছ চাষ করা হয়। এস ১, এসভি ৫, সি ৭৭৬, এস ৭৯৯ ইত্যাদি জাতের তুঁত গাছের চারা রোপণ করা যেতে পারে। কারণ উন্নত জাতের চারা থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বীজ, শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও কঁুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে তুত গাছের বংশবিস্তার করা যায়।

তবে বাংলাদেশে শাখা কলমের মাধ্যমে তৈরি চারাই বেশি ব্যবহৃত হয়। আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে ও আগাছা পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি টিএসপি ও ১৫ কেজি এমপি সার শেষ চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। তবে পুকুর পাড়, রাস্তা ও রেল লাইনের পাশে গর্ত পদ্ধতিতে লাগানোর বেলায় সারগুলোকে একত্রে মিশিয়ে পরিমাণমত প্রতিটি গর্তের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়।

সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬—৬.৫ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩—৪ ফুট রাখতে হয়। তুঁত গাছ লাগানোর আসল উদ্দেশ্যই হলো পাতা সংগ্রহ। ভালো জাতের তুঁত গাছ থেকে অধিক পাতা সংগ্রহ করা যায়। রেশম পোকার লার্ভা তুঁত গাছের কচি বা নতুন পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। একবার লাগালে তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর পর্যন্ত পাতা দিতে থাকে।

নিয়মিত ডাল ছাঁটাই করা হলে নতুন ডাল ও পাতা গজায়। ধারালো দা বা চাকু দিয়ে পুরনো ডালের এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক অংশ কেটে ফেলতে হয়। সাধারণত চারা লাগানোর এক বছর পর বর্ষার শেষে তুঁত গাছের ডালপালা প্রথম ছাঁটাই করতে হয়। দুই থেকে আড়াই বছর পর নিয়মিতভাবে রেশম লার্ভার জন্য নতুন পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুঁত গাছের গোড়ায় প্রতি বছর অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়। বৃষ্টি না হলে মাঝে মাঝে সেচ দিতে হয়। আবার কোনো কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হয়। আগাছা বেশি হলে তা দমন করতে হয়।

তুঁত গাছে পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পোকার মধ্যে উইপোকা, বিছাপোকা, লিফ হপার এবং রোগের মধ্যে লিফ স্পট, পাউডার মিলডিউ, মরিচা রোগ, শিকড় পচা রোগ ও নেমাটোড রোগ দেখা যায়। উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এসব পোকা ও রোগ দমনের ব্যবস্থা নিতে হয়।

Capture 57 রেশম চাষ

২। তুঁত পাতা সংগ্রহ

সকালে অথবা বিকালে তুঁত গাছের পাতা সংগ্রহ করতে হয়। সকালে এমন সময় পাতা সংগ্রহ করতে হয় যেন ভেজা না থাকে। প্রখর রৌদ্রের সময় পাতা সংগ্রহ করা উচিত নয়। নতুন বা কচি পাতা তোলার পর তা পলিথিন ব্যাগে রেখে ঠান্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রয়োজনে পলিথিন ব্যাগে ভেজা স্পঞ্জ ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাগের ভিতর যাতে তাপ সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চব্বিশ ঘন্টায় লার্ভাকে বর্ষা মৌসুমে ৩ বার এবং শুষ্ক মৌসুমে ৫ বার পর্যন্ত খাবার দিতে হয়। লার্ভার বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়।

 

৩। রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট:

রেশম পোকার লার্ভা বা পলু বা শুককীট সংগ্রহ সাধারণত রেশম বীজাগার থেকে রেশম পোকার লার্ভা সংগ্রহ করতে হয়। ৪—৫ দিন বয়সী সুস্থ ও স্বাভাবিক লার্ভা চাষিদের মধ্যে বিতরণ বা সরবরাহ করা হয়। সকালে বা বিকেলে অথবা দিনের যে কোনো ঠান্ডা সময় হার্ডবোর্ডের তৈরি ছিদ্রযুক্ত বাক্স বা নেটের বাক্সে লার্ভা পরিবহণ করতে হয়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকলে বাক্সের চারিদিকে ভেজা কাপড় বা ন্যাকড়া জড়িয়ে লার্ভা পরিবহণ করা আবশ্যক।

এছাড়াও রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সংগ্রহ করেও লার্ভা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিলে ১০—১২ দিন পর গুটি কেটে প্রতিটি কোকুন থেকে পুরুষ বা স্ত্রী মথ বের হয়ে আসবে। বের হবার পর পুরুষ ও স্ত্রী মথ যৌন সঙ্গমে মিলিত হবে। মিলনের ঘন্টা তিনেক পর পুরুষ মথটিকে সঙ্গমরত অবস্থা থেকে আলাদা করে নিতে হবে এবং স্ত্রী মথটিকে একটি কৌটার ভিতরে সাদা কাগজের ওপর রেখে তা ঢেকে দিতে হবে। স্ত্রী মথটি এ অবস্থায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাদা কাগজের ওপর ৩৫০০—৫০০০ টি পর্যন্ত ডিম পাড়বে।

এবার কৌটার ভিতরকার ডিম সম্বলিত সাদা কাগজ বের করে তা ডালাতে রাখতে হবে এবং অন্য একটি ডালা দিয়ে তা ঢেকে রাখতে হবে। ডিমের ঘরে ২৫০ সে. তাপমাত্রা ও ৭৫—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকা উত্তম। বর্ণিত অবস্থায় রেখে দিলে ৮—৯ দিনের মাথায় ডিমে কালো ছিট দাগ পড়বে এবং ৯—১০ দিনের মাথায় পুরো ডিম কালো রং ধারণ করবে। এ ডিমগুলো শোধন করার জন্য ২% ফরমালিন দ্রবণের মধ্যে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পানি দ্বারা ধুঁয়ে নিতে হয়। ডিম ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে থাকলে ২৪ দিনের মধ্যেই ৯০—৯৫ ভাগ ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে আসবে।

 

৪। রেশম পোকার লার্ভা পালন:

নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করে রেশম পোকার লার্ভা পালন করা যায়।

(ক) লার্ভা ঘর তৈরি :

মুক্ত আলো বাতাসযুক্ত উঁচু স্থানে লার্ভা ঘর তৈরি করতে হয়। এ ঘরের ক্ষেত্রফল ২২ ফুট  ১৬ ফুট হলে ভালো হয়। ঘরের দেয়াল মাটির ও ছাউনি খড়ের হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। বায়ু চলাচল নিশ্চিত করার জন্য ঘরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দরজা ও জানালা রাখতে হয়। মাছি যাতে রেশম পোকার লার্ভাকে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য দরজা ও জানালায় তার জাল বা বাঁশের চিক লাগাতে হয়। লার্ভা ঘর যাতে সঁ্যাতস্যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

(খ) লার্ভা পালনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি :

লার্ভার ছোট অবস্থায় বাঁশের ছোট ডালা, বড় অবস্থায় বাঁশের বড় ডালা, ডালা রাখার জন্য কাঠ বা বাঁশের তাক, লার্ভার বেড বা ডালা পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত ছোট লার্ভার জন্য ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জাল ও বড় লার্ভার জন্য বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল, তাকের পায়ায় দেয়ার জন্য আলকাতরা বা পানির বাটি, তুঁত পাতা কাটার জন্য চাকু বা ছুরি, লার্ভার গা থেকে ছোপ পোকা ঝাড়ার জন্য পাখির পালক, গুটি করার জন্য বাঁশের চন্দ্রকী, ঘরের আর্দ্রতা বাড়ানোর স্পঞ্জ, শীতে ঘর গরম করার জন্য হিটার বা চুলা, ঘরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার, আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাপার জন্য আর্দ্রতা মাপক যন্ত্র, শোধন করার জন্য ফরমালিন, চুন ইত্যাদি সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়।

Capture 58 রেশম চাষ

 

(গ) লার্ভা ঘর ও সরঞ্জামাদি শোধন :

রেশম পোকার লার্ভা পালন শুরুর ২—৩ দিন আগেই যে সব জিনিসপত্র ব্যবহৃত হবে তাসহ লার্ভা ঘর শোধন করে নিতে হয়। ঘরের মেঝেসহ সকল সরঞ্জামাদি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া উত্তম। এরপর ফরমালিন অনুমোদিত মাত্রা অনুযায়ী পানির সঙ্গে মিশিয়ে ে¯প্র মেশিন দিয়ে মেঝেসহ ঘরের ভিতর সব স্থানে ও সরঞ্জামাদির ওপর ে¯প্র করতে হয়। ে¯প্র করার পর উক্ত ঘর ২৪ ঘন্টা বায়ুরোধী করে বন্ধ রাখতে হয়।

 

(ঘ) লার্ভার পরিচর্যা :

রোগমুক্ত ও ভালো মানের লার্ভা সংগ্রহ করে রেশম চাষ শুরু করতে হয়। লার্ভা দেখতে পশমবিহীন ছাইয়া—ধূসর বা ক্রীম বর্ণের। লার্ভা প্রায় ৭—৯ সে.মি. লম্বা হয়। রেশম বা গুটি পোকার অনেকগুলো রেস (ৎধপব) আছে। বছরে একবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে একচক্রী (ঁহরাড়ষঃরহব), বছরে দু’বার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে দ্বিচক্রী (নরাড়ষঃরহব) এবং বছরে বহুবার ডিম ও গুটি উৎপন্ন করলে তাদেরকে বহুচক্রী (সঁষঃরাড়ষঃরহব) রেস বলা হয়। আমাদের দেশে বহুচক্রী রেস চাষ হয়। পালনের সময় ডালাতে লার্ভার ছোট অবস্থায় তুঁত পাতা কেটে টুকরো করে দিতে হয় এবং লার্ভার বড় অবস্থায় আস্ত পাতা দিলেও কোনো সমসা হয় না। পালনের সময় লার্ভার পায়খানা ও পাতার অবশিষ্টাংশ ডালা অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা করে ফেলে।

এজন্য লার্ভার ছোট অবস্থায় ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট জালের ওপর টুকরো টুকরো তুঁত পাতা দিয়ে ঐ জালটি ডালার ওপর বিছিয়ে দিলে লার্ভাগুলো জালের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে জালের ওপর খাবার খাওয়ার জন্য চলে আসবে। এমতাবস্থায় লার্ভাসহ ঐ জালটি অন্য ডালায় রেখে নোংরা ডালাটি পরিস্কার করা সম্ভব হয়। এমনিভাবে বড় ছিদ্রবিশিষ্ট জাল দিয়েও বড় লার্ভাগুলো স্থানান্তর করে নোংরা ডালা পরিষ্কার করা যায়। লার্ভাগুলো এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার সময় দেহের খোলস বদলায়। এই খোলস বদলানোকে মোল্টিং (সড়ঁষঃরহম) বলা হয়।

খোলস বদলানোর সময় লার্ভাগুলো খাওয়া—দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এই লার্ভাগুলোতে পাঁচটি ইনস্টার (রহংঃধৎ) পরিলক্ষিত হয়। ডিম থেকে বের হবার পর থেকে ১ম খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ১ম ইনস্টার, ১ম খোলস বদলানোর পর থেকে ২য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ২য় ইনস্টার, ২য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৩য় খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৩য় ইনস্টার, ৩য় খোলস বদলানোর পর থেকে ৪র্থ খোলস বদলানোর আগ পর্যন্ত সময়কে ৪র্থ ইনস্টার এবং ৪র্থ খোলস বদলানোর পর থেকে পিউপা বা পুত্তলী বা গুটি বা কোকুন তৈরির আগ পর্যন্ত সময়কে ৫ম ইনস্টার বলা হয়।

রেশম পোকা সাধারণত ২২—২৩ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। ১ম ইনস্টারে ৩ দিন ও ১ম খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ২য় ইনস্টারে ২ দিন ও ২য় খোলস বদলাতে ২০ ঘন্টা সময় লাগে। ৩য় ইনস্টারে ৩ দিন ও ৩য় খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থ ইনস্টারে ৪ দিন ও ৪র্থ খোলস বদলাতে ১ দিন সময় লাগে। ৪র্থবার খোলস বদলানোর পর কোকুন বা গুটি তৈরির পূর্বে ৬—৭ দিন লার্ভা অবস্থায় থাকে। লার্ভার ১ম তকে ৩য় ইনস্টার পর্যন্ত ঘরের তাপমাত্রা ২৭০ সে. ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০—৮৫% রাখতে হয়।

আবার ৪র্থ ইনস্টার থেকে গুটি তৈরির আগ পর্যন্ত সময়ে ২৫—২৬০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০—৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা রাখা বাঞ্চনীয়। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ বা খোলা রেখে এবং ডালার চার পাশে পানিতে ভেজানো স্পঞ্জ রেখে ঘরের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে।

 

(ঙ) রেশম পোকার রোগ, পোকা, মাকড় ও কমি দমনৃ :

বিভিন্ন রোগ রয়েছে, যেমন— পেব্রিন রোগ, ফ্লাচারি রোগ, জন্ডিস রোগ, প্যাটিন রোগ, মাসকারডাইন রোগ ইত্যাদি। এছাড়া উজি মাছি, ডার্মাস্টিক বিটল, মাকড়, কৃমি ইত্যাদিও রেশম পোকার শত্রু। তবে এগুলোর মধ্যে প্রধান শত্রু হলো উজি মাছি। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী উজি মাছি লার্ভার গায়ে ডিম পাড়ে। ১—২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ম্যাগট বের হয়। এই ম্যাগটগুলো লার্ভার দেহের ভিতরে ঢুকে পেশিকলা খেয়ে ফেলে। ফলে লার্ভা মারা যায়। এভাবে একটি উজিমাছি প্রায় ২০০—৩০০ টি রেশম লার্ভা মেরে ফেলতে পারে। অনুমোদিত মাত্রায় ঔষধ ব্যবহার করে বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ সমস্ত রোগ, পোকা, মাকড় ও কৃমি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

রশম চাষ 2 রেশম চাষ

 

৫। রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ :

রেশম গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পঞ্চম ইনস্টার শেষ হবার পর লার্ভা যখন চুপচাপ ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে, তখন ঐ লার্ভাগুলোকে বাঁশের চন্দ্রকীতে স্থানান্তর করতে হয়। ৬ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি চন্দ্রকীতে প্রায় এক হাজার লার্ভা রাখা যায়। চন্দ্রকীতে রাখার পর এক পর্যায়ে লার্ভার মুখ থেকে তরল রেশমের ফোটা নিঃসৃত হয় যা সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে চন্দ্রকীতে আটকে যায়। শেষ পর্যায়ে লার্ভা নিজ দেহের চারিদিকে একটি আবরণ তৈরি করে যাকে কোকুন বা গুটি বলা হয়। চন্দ্রকীতে লার্ভা দেয়ার পর ঐ চন্দ্রকী লার্ভা ঘরের বাইরে বারান্দায় হেলানো অবস্থায় রাখতে হয়।

এতে করে রেশম গুটির গুণগত মান ভালো হয়। লার্ভা ঘরে চন্দ্রকী রাখা উচিত নয়। কারণ ঘরের অবশিষ্ট লার্ভার ক্ষতি হয়। ২৩—২৪০ সে. তাপমাত্রা ও ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ভালো ও উন্নতমানের রেশম গুটি পাওয়া যায়।

রেশম পোকার লার্ভা রেশম গ্রন্থি থেকে যে লালা নিঃসরণ করে তা থেকে রেশম তৈরি হয়। রেশম গ্রন্থি দেহের দু’পাশে অবস্থিত দুটো লম্বা ও পুরু প্রাচীরের থলে দ্বারা গঠিত যাদের সাধারণ একটি ছিদ্রপথে রেশম লালা নিঃসৃত হয়। রেশম পোকার লার্ভা যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় তখন থলে দু‘টো আঠালো তরল পদার্থে পূর্ণ হয়ে যায়। আর এই আঠালো তরল পদার্থ যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন বাতাসের সংস্পর্শে তা শক্ত হয়ে গুটি বা কোকুনে পরিণত হয়। গুটি করা শেষ হলে লার্ভা পিউপায় বা মুককীটে রূপান্তরিত হয়।

পিউপায় রূপান্তরিত হবার ২/১ দিনের মধ্যেই চামড়া শক্ত হয়ে বাদামি রং ধারণ করে। পিউপার চামড়া শক্ত হবার পর চন্দ্রকী থেকে রেশম গুটি ছাড়াতে হয়। রেশম গুটি ছাড়ানোর আগে চন্দ্রকী ১ দিন রোদে ও বাতাসে রেখে দিলে ভালো হয়। এতে করে গুটির শেল শক্ত হয় এবং নষ্ট কম হয়। গুটি ছাড়ানোর পর তা পরিষ্কার করে সুতা তৈরি বা রিলিং  এর জন্য বিক্রি করা হয়।

 

৬। সুতা তৈরি:

রেশম গুটির ভিতরে পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হলে মথটি গুটির একদিকে কেটে বের হয়ে আসে। ফলে গুটির লম্বা সুতাটি অসংখ্য টুকরোয় পরিণত হয় এবং ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এজন্য গুটির অক্ষত লম্বা সুতাটি পাওয়ার জন্য পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ বের হবার আগেই গুটিগুলো ৯০—৯৫০ সে. তাপমাত্রার প্রায় ফুটন্ত পানিতে ৩—৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এর ফলে গুটির ভিতরের পিউপা বা মুককীট মারা যায় এবং গুটিতে রেশম সুতার সাথে লেগে থাকা আঠালো পদার্থ গলে যায়।

এতে সুতা রিলে জড়ানোর উপযোগী হয়। এরপর গুটির মুখের সুতার প্রান্ত সুতা কাটা চরকি বা রিলের সাথে আটকিয়ে নিয়ে চরকির ঘূর্ণন অব্যাহত রাখলে গুটি থেকে সুতা মুক্ত হয়ে চরকি বা রিলের সাথে পেচাতে থাকে। চরকি বা রিলের মাধ্যমে গুটি থেকে সুতা উত্তোলনের এই পদ্ধতিকে রিলিং  বলে।

চরকি বা রিলের মাধ্যমে উৎপাদিত এ সুতাকে কাঁচা রেশম বলা হয়। পরবর্তীতে এ কাঁচা রেশমকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রসেস করে রেশম বস্ত্র বয়ন করা হয়। পূর্ণতার শেষ পর্যায়ে এসে একটি রেশম লার্ভা প্রতি মিনিটে প্রায় ছয় ইঞ্চি সুতা তৈরি করতে পারে এবং সম্পূর্ণ গুটি বা কোকুন তৈরি করতে ৩ দিন সময় নেয়। একটি রেশম গুটি থেকে প্রায় ১০০০—৩০০০ ফুট সুতা পাওয়া যায় এবং ১ পাউন্ড রেশম সুতা পেতে প্রায় ২৫ হাজার গুটির প্রয়োজন হয়।

 

রেশম পোকার জীবনচক্র:

রেশম পোকার জীবনে চারটি দশা বা ধাপ রয়েছে, যথা— ১। ডিম ২। লার্ভা বা শুককীট ৩। পিউপা বা মুককীট ও ৪। পূর্ণাঙ্গ মথ। এগুলো সম্পর্কে পূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

রশম চাষ 3 রেশম চাষ

 

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

রেশমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১। রেশম পোকা থেকে রেশমি সুতা পাওয়া যায়। এই রেশমি সুতা দ্বারা উন্নতমানের অতি মূল্যবান ও আরামদায়ক রেশমি কাপড় তৈরি হয়।

২। রেশম কাপড়ের দেশে ও বিদেশে যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনি এর দামও বেশি।

৩। রেশম কাপড় বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব।

৪। জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫। রেশম বস্ত্র কোমল ও নমনীয়। এই বস্ত্রে শতকরা ১১ ভাগ আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকে। ফলে শীত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত সব ঋতুতেই এ কাপড় পরিধান করা আরামদায়ক হয়।

৬। অল্প মূলধন ও কম জায়গা কাজে লাগিয়ে রেশম চাষ করে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। এত কম মূলধন ও জায়গা দিয়ে অন্য কোন ফসল চাষ বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড করা সম্ভব হয় না।

৭। আত্মকর্মসংস্থান তথা বেকারত্ব দূরীকরণের একটি সহজ উপায়। রেশম চাষ করলে পরিবারের বেকার সব লোকের কর্মসংস্থান হয়। এতে পরিবার তথা সমাজের ওপর একটা পজিটিভ প্রভাব পড়ে।

৮। রেশম চাষে ঝঁুকি কম। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দূর্যোগ, দাম কম হওয়া বা অন্য কোনো কারণে আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

৯। অধিক কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না বিধায় যে কেউ রেশম চাষ করে রেশম সুতা উৎপাদন করতে পারে।

১০। রেশম চাষে রেশম সুতার উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি হয়।

১১। রেশম গুটি সিদ্ধ করে সুতা বা তন্তু ছাড়িয়ে নেয়ার পর মৃত পিউপা বা মুককীট হাঁস—মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

১২। রেশম গুটি থেকে সুতা আহরণের পর উচ্ছিষ্ট ছোবড়া থেকে সার্টিন তৈরি করা যায়। এছাড়াও কোর্সি কাটা দ্বারা বিশেষ বুনন প্রক্রিয়ায় গুটি থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। বয়নকালের বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করে কার্পেট তৈরি করা যায়।

১৩। রেশম চাষে একই জমির তুঁত গাছ থেকে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময় ৪—৫ বার তুঁত পাতা (তুঁত ফসল) পাওয়া যায় এবং তুঁত গাছ ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে এক নাগাড়ে রেশম চাষ করে অনেক অর্থ উপার্জন করা যায়।

১৪। বাড়ির চারিদিকে, পুকুর পাড়ে, রাস্তা ও রেললাইনের পাশে এবং অনাবাদী ও পতিত জমিতে তুঁত গাছ আবাদ করে রেশম’ চাষ করা যায়। এতে ফসলী জমি নষ্ট হয় না।

১৫। তুঁত গাছ একবার লাগালে ২০—২৪ বছর বাঁচে বলে রেশম’ চাষে এর উৎপাদন খরচ কম হয়।

১৬। রেশম চাষের জন্য তুঁত গাছ আবাদে অধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, রেশম’ চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে তুঁত বৃক্ষ আবাদ করলে বছরে ১২—১৩ জন লোকের কর্মসংস্থান হয় অথচ অন্য ফসলে বছরে ৪—৫ জন লোক হলেই চলে।

১৭। মরা তুঁত গাছ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তুঁত গাছের অতিরিক্ত পাতা গবাদি—পশুকেও খাওয়ানো যায়।

১৮। রেশম কীট থেকে আহরিত তেল সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও রেশম সুতা অপারেশনের পর সেলাই কাজে ব্যবহার করা হয়।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment