উপকূলীয় এলাকায় ও লবণক্ষেতে বাগদা চিংড়ি চাষ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-২ , পাঠ -২.৩ , উপকূলীয় এলাকায় এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ লোনা পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। বাগদা চিংড়ি এদের মধ্যে অন্যতম। এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। উপকূলীয় এলাকায় যেখানে জোয়ার—ভাটার প্রভাব থাকে সেখানেই বাগদা চিংড়ির চাষের স্থান নির্বাচন করা সম্ভব। বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য লোনা পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ প্রয়োজন এবং সমুদ্র থেকে তা পাওয়া সম্ভব।
উপকূলীয় এলাকায় ও লবণক্ষেতে বাগদা চিংড়ি চাষ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-২ , পাঠ -২.৪
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাগদা চিংড়ির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ভাল পেতে হলে হালকা চাষ পদ্ধতি ভালভাবে প্রয়োগ করে ঘেরের উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। উন্নত হালকা চাষ পদ্ধতির চারটি পর্যায়ের বর্ণনা নিম্নরূপ :
১. চাষ পুকুর বা ঘের।
২. পোনা মজুদপূর্ব পুকুর বা ঘের প্রস্তুতি।
৩. পোনা নির্বাচন, খাপ—খাওয়ানো ও মজুদ।
৪. পোনা মজুদ—পরবতীর্ ব্যবস্থাপনা।
১. চাষ পুকুর বা ঘের :
সুষ্ঠু ঘেরের নিম্ন ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে পুকুর বা ঘেরের আয়তন ১—১০ হেক্টর বা ২.৫—২৫ একরের মধ্যে হলে ভাল হয়। পুকুর বা ঘের বর্গাকার বা আয়তাকার, চারদিকে বাঁধ মজবুত, ফাঁক—ফেঁাকরমুক্ত এক মিটার পানি রাখার ব্যবস্থা আছে এমন পুকুর বা ঘের। পুকুরের তলদেশে সমতল, পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে এমন পুকুর। অমাবস্যা ও পুর্ণিমার জোয়ারে ৭৫—১০০ সেন্টিমিটার পানি তোলার ব্যবস্থা আছে এমন পুকুর বা ঘের হতে হবে। নতুবা পাম্পের সাহায্যে পানি সরবরাহ করতে হবে।
পুকুরের স্লুইচ গেটের সংখ্যা, সাইজ ও অবস্থান এমন হবে যেন পূর্ণিমার জোয়ার—ভাটার সময় কমপক্ষে ৫০ ভাগ পানি নদীর টাটকা পানির সাথে পরিবর্তন করা যায় এবং পানি পরিবর্তনের সময় সারা পুকুরে ভালো ে¯্রাতের সৃষ্টি হয়। বাগদা চিংড়ি চাষের সময় পানির লবণাক্ততা ৮—১৫ পি.পি.টি—এর মধ্যে
থাকতে হবে। ঘেরের মাটির পি—এইচ ৫—এর ওপর হলে ভাল হয়। ঘের জলজ আগাছা ও শেওলামুক্ত থাকতে হবে।
২. পোনা মজুদ—পূর্ব পুকুর বা ঘের প্রস্তুতি :
* ঘেরের সমস্ত পানি ভাটার সময় অপসারণ করে দিতে হবে।
* ঘেরের তলদেশ ভালভাবে রোদে শুকাতে হবে এবং তলদেশের জলজ আগাছা মূলসহ অপসারণ করতে হবে।
* বাঁধ, স্লুইচ গেট, বাঁশের বানা বা ছাঁকটি জাল সবকিছু মেরামত করতে হবে।
* ঘেরে জোয়ারের পানির সাথে যেন কোন ক্ষতিকর প্রাণী ঢুকতে না পারে সেজন্য স্লুইচ গেটের মুখে বাঁশের বানা বা ছাঁকনি জাল স্থাপন করতে হবে।
* বানা বা ছাঁকনি জালের উচ্চতা ঘেরের পানির সর্বাধিক উচ্চতা হতে কমপক্ষে আধামিটার হতে হবে।
* ঘেরের কোথাও কোন ক্ষতিকর প্রাণী বা মাছ থাকলে তা বিনাশ করতে হবে। চুন প্রয়োগ বা রোটেনন প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে। চুন বা রোটেনন প্রয়োগ করে মাছ মারা নিরাপদ। উপরের কাজগুলো প্রথম তিন সপ্তাহে করতে হবে।
* চতুর্থ সপ্তাহে মাটির পিএইচ পরীক্ষা করতে হবে। মাটির পিএইচ অনুযায়ী চুনের পরিমাণ ঠিক করা যেতে পারে।
* ঘেরের তলদেশ ভালভাবে শুকানোর পর পাথুরে চুন (ঈধঈঙ৩) পরিমাণ মত লোহার ড্রামে বা মাটিতে গর্ত করে টুকরা করে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে। চুন ফুটে ঠাণ্ডা হওয়ার পর তা প্রয়োগ করা উচিত।
* পঞ্চম সপ্তাহে চুন ছিটানোর ৭দিন পর ৬০—৮০ সে.মি. জোয়ারের পানি ছেঁকে ঘেরের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে।
* ঘেরে পানি সরবরাহের সময় প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি টি.এস.পি একত্রে একটি পাত্রে সারারাত ভিজিয়ে গুলিয়ে তা দিনের বেলায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করার সময় স্লুইসের মুখে ছিটিয়ে দিতে হবে।
* সার প্রয়োগের পর ঘেরের পানি কয়েক দিনের মধ্যে সবুজ বর্ণ ধারণ করে থাকে। পানির স্বচ্ছতা ২৫—৪০ সে.মি. হলে বুঝতে হবে পানিতে চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার উৎপন্ন হয়েছে।
* পানির রং যদি সবুজ না হয় তাহলে পূর্ণমাত্রায় আবার সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অতঃপর একটি পাত্রে সার পানি দ্বারা গুলে ঘেরের সমস্ত জায়গায় ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৩. পোনা নির্বাচন, খাপ খাওয়ানো ও মজুদ :
ঘেরের গুণগত মান অনুযায়ী প্রতি হেক্টর জলায়তনের জন্যে ১৫,০০০—৩০,০০০ টি হিসাবে সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত বাগদা পোনা নির্বাচন করতে হবে। বাগদার ভাল পোনার বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
ক) পোনার দেহ বেশ স্বচ্ছ কোথাও ঘোলাটে ভাব বা দাগ থাকে না। খ) দেহে বেশ সোজা কোথাও কোন কেঁাকড়ানো ভাব দেখা যায় না। গ) দেহের লম্বালম্বি কালচে বা খয়েরি দাগটি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। ঘ) সাঁতার কাটার সময় পুচ্ছ পাখনা বেশ ছড়ানো অবস্থায় থাকে। ঙ) ঘেরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার সঙ্গে যত্ন ও ধৈর্যে্যর সাথে ভালো করে খাপ খাইয়ে নিয়ে পোনা ঘেরে মজুদ করতে হয়।
৪. পোনা মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা :
* পোনা মজুদের পর প্রথম ৫ সপ্তাহ প্রয়োজন না হলে ঘেরের পানি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে পানির উচ্চতা কমে গেলে পানি সরবরাহ করে ৬০—৮০ সে.মি. করার প্রয়োজন হবে। পানির স্বচ্ছতা ৪০ সে.মি.—এর বেশি হলে পূর্ণমাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে এবং ২৫ সে.মি.—এর নিচের হলে ঘেরের এক—তৃতীয়াংশ পানি বের করে নতুন পানি প্রবেশ করাতে হবে।
পোনা মজুদের ৫ সপ্তাহ পর পানির গভীরতা বৃদ্ধি করে ৭০—১০০ সে.মি. করতে হবে। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ার—ভাটার চক্রে ঘেরের শতকরা ৫০ ভাগ করা উচিত। বর্ষা মৌসুমে চিংড়ির অল্প পরিমাণ কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
ত্রিশ গ্রাম বা এর বেশি ওজনের চিংড়িগুলো ধরে ফেলতে হবে। ধরার পর সাথে সাথে ছায়াযুক্ত স্থানে প্লাস্টিকের বা* বা তাপপরিবাহী কোন পাত্রে বরফ ও চিংড়ির স্তর পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রেখে চিংড়ি সংরক্ষণ করতে হবে। বরফজাতকৃত চিংড়িগুলো অতিদ্রুত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পোনা মজুদের ৬ মাসের মধ্যে ভাটার সময় ঘেরের সমস্ত পানি বের করে দিতে হতে এবং সমস্ত চিংড়ি আহরণ করে পূর্বের নিয়মে বরফ দ্বারা সংরক্ষণ করতে হবে।
লবণ ক্ষেতে বাগদা চিংড়ি চাষ বাংলাদেশে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অনেক জমিতে লবণের চাষ করা হয় বহু পূর্ব থেকেই। বর্তমানে লবনের সাথে অধিক লাভের প্রত্যাশায় লবণ ক্ষেতে চিংড়িও চাষ করা হচ্ছে। ফলে চিংড়ি চাষীরা অধিক লাভবান হতে পারেন। সঠিক পদ্ধতিতে সর্তকতার সাথে চাষ করলে লবণের জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ লাভজনক হবে যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
চাষ পদ্ধতি :
বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতি বাগদা চিংড়ি চাষ এবং লবণ ক্ষেতে বাগদা চাষের সাধারণ কার্যাবলী একই ধরনের। সন্তোষজনকভাবে ফলন পেতে হলে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় যা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
ক. জমি প্রস্তুতকরণ : বাগদা চিংড়ির জন্য জমি প্রস্তুতে সময় যে সব বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. জমির আয়তন ১ — ২ হেক্টর হলে ভালো হলে ভালো যাতে ভালোভাবে সমতল করে তৈরি করা যায়।
২. পানির শ্যাওলা ও আগাছা ভালোভাবে পরিস্কার করতে হবে এবং জমির আইল শক্তভাবে বাঁধতে হবে।
৩. পানির গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে।
৪. লবণাক্ততার মাত্রা ১৭ পিপিটি পর্যন্ত রাখতে হবে।
৫. জৈব সার ১.০ — ১.৫ কেজি, ইউরিয়া ১৭৫ — ২২০ গ্রাম টিএসপি ১৫০ — ২০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
৬. চিংড়ির পোনা ছাড়ার পূর্বে রাক্ষুসে ও আগাছা দুর করে চুন প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতকে ১.০ — ১.৫ কেজি চুন গুড়া করে পানিতে গুলিয়ে ঠাণ্ডা করে ছিটিয়ে দিতে হবে।
৭. লবণের জমির কিছু অংশে বা নিচু অংশে জলজ গাছ বা গাছের শক্ত পাতা বা শাখা রেখে চিংড়ির আবাসস্থল তৈরি করতে হবে।
৮. মাটির পিএইচ মেপে চুন প্রয়োগ করে ৭.০ এর উপরে রাখতে হবে।
খ. পানি ঢুকানো ও পোনা ছাড়া : জমি প্রস্তুত ও চুন প্রায়োগের ৭ — ১০ দিন পর ৬০ — ৭০ সে. মি. জোয়ারের পানি ঢুকাতে হবে। পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হলে পোনা ছাড়তে হবে। প্রতি শতকে ১০০ — ১৫০টি পোনা ছাড়াতে হবে।
গ. সার প্রয়োগ : প্রতি মৌসুমে পোনা ছাড়ার ১ সপ্তাহ পর প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য প্রতি শতকে ৭০ — ৯০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০ — ২৫ গ্রাম টিএসপি ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ. চিংড়ি আহরণ : সকল চিংড়ি একসাথে বা মাসে মাসে আহরণ করা যায়। পোনা মজুদের ৫ — ৬ মাস পর থেকে বড় বড় চিংড়ি আহরণ করা যায়।
ঙ. ফলন বা উৎপাদন :লবন জমিতে উপরোক্ত পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করলে সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত প্রতি হেক্টরে ৪০০ — ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়।
আরও দেখুন :
- পুকুরে ও ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-২ , পাঠ -২.২
- ধান ক্ষেতে গলদা চিংড়ি চাষ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-২ , পাঠ -২.৩
- বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-২ , পাঠ -২.১
- ব্যবহারিক : প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ, কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-১ , পাঠ -১.৭
- বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা