আদা চাষ

আদা চাষ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “উদ্যান ফসল” বিষয়ের ৮ নং ইউনিটের, পাঠ নং ৮.৯। আদা একটি প্রয়োজনীয় মসলা ফসল যা খাবারকে সুস্বাদু করে। আদা বাড়ির পাশে পতিত জমি, পাহাড়ে  চাষাবাদ করা যায়। বিভিন্ন ফসলের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করা যায়। ১০০ গ্রাম আদায় রয়েছে – এনার্জি-৮০ ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট-১৭ গ্রাম, ফ্যাট-০.৭৫ গ্রাম, পটাশিয়াম-৪১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩৪ মিলিগ্রাম, আমিষ-২·৩%, শ্বেতসার ১২·৩%, আঁশ ২·৪%, খনিজ পদার্থ ১·২% এবং পানি ৮০·৮%। আদা মসলা হিসেবে খাওয়া ছাড়া ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়। সর্দিকাশি,আর্থারাইটিস, মাইগ্রেন, ডায়েরিয়া, গ্যাস, কনস্টিপেশন, হার্টের সমস্যা, ডায়বেটিস, হাই-কোলেস্টেরলের মতো বিবিধ রোগ প্রতিরোধে আদার জুড়ি নেই।

আদা চাষ

আদা

 

আদার জাত :

বাংলাদেশে আদার তেমন জাত নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কতৃর্ক উদ্ভাবিত বারি আদা—১ নামে একটি উফসী জাত রয়েছে। কৃষকরা সাধারণত স্থানীয় জাত চাষ করে থাকে। সব জাতের নাম, জীবন কাল ও উৎপাদন নিচের টেবিলে দেয়া হলো:

 

জাতের নামবৈশিষ্টজীবন কালউৎপাদন
বারি আদা-১১। এই জাতের গাছের গড় উচ্চতা ৭৯-৮২ সেন্টিমিটার।
২। প্রতি গাছে টিলার সংখ্যা ৩০-৩২ টি ও পাতার সংখ্যা ২১০-২১২টি।
৩। প্রতি গাছে প্রাইমারি রাইজোমের সংখ্যা ৫৪-৫৭টি ও সেকেন্ডারি রাইজোমের সংখ্যা ৩৯০-৩৯৫টি পর্যন্ত হতে পারে।
৪। জাতটির রোগ প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা ভাল।
২৭০-৩২০৩০-৩২ কেজি
বারি আদা-২১। এ জাতের জীবনকাল ৩০০-৩১৫ দিন।
২। গাছের গড় উচ্চতা ৯০.৪৯-৮৮.৪০ সে.মি ।
৩। গড় পাতার সংখ্যা ৫০২.৮৪-৪৯৫টি ।
৪। গড় কুশির সংখ্যা ৩০.৮৪-২৯ট…
৫। গড় প্রাইমারী রাইজোমের ওজন ৬৯.৯০-৬৬.৫০ গ্রাম ।
৬। গড় সেকেন্ডারী রাইজোমের ওজন ৫৫৬.৫৪-৫৫০.২০ গ্রাম ।
৭। জাতটির হেক্টর প্রতি ৩৭.৯৯ টন পর্যন্ত ফলন হয় ।
৮। জাতটি কান্ড পঁচা রোগ সহনশীল ।
৩০০-৩১৫৩৭.৯৯ কেজি
বারি আদা-৩১। এ জাতের জীবনকাল ৩০০-৩১০ দিন ।
২। গাছের গড় উচ্চতা ৭৯.৩০-৭৫.৪০ সে.মি. ।
৩। গড় পাতার সংখ্যা ৪২৯.২৪-৪২৫টি ।
৪। গড় কুশির সংখ্যা ২৫.৬৭-২৪টি ।
৫। গড় প্রাইমারী রাইজোমের ওজন ৬০.২৭-৫৮.৫০ গ্রাম ।
৬। গড় সেকেন্ডারী রাইজোমের ওজন ৫৫৬.৫৪-৫৫০.২০ গ্রাম ।
৭। জাতটির হেক্টর প্রতি ২৯.০৫ টন পর্যন্ত ফলন হয় ।
৮। জাতটি কান্ড পঁচা রোগ সহনশীল ।
২৭০-৩২০৩০-৩২ কেজি

 

 

আদা চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি  :

আদার বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া উপযোগী। আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানেও আদার চাষ ভালো হয়। আদার জন্য সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো ফলন হয়। তবে এটেল দোআঁশ মাটিতেও চাষ করা যায়। পানি নিকাশের ভাল ব্যবস্থা আছে এমন উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি এবং বেলে দো-আঁশ থেকে দো-আঁশ মাটিতে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিতে হবে। প্রথম চাষ গভীর হওয়া দরকার। আদার জন্য মার্চ—এপ্রিল মাসে জমি গভীরভাবে ৫—৬ টি চাষ দিতে হবে। আগাছা বা আবর্জনা পরিষ্কার করে মাটি ঝুর ঝুরে করে সমতল করে নিতে হবে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য (এপ্রিল- মে) আদা বপনের উপযুক্ত সময়।

 

আদা

 

আদা চাষের জন্য জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ :

আদার ভাল ফলন পেতে হলে জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে প্রতি হেক্টরে গোবর সার ৪-৬ টন, ইউরিয়া ২০০-২৪০ কেজি, টিএসপি ১৭০-১৯০ কেজি, এমওপি ১৬০-১৮০ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। জমি প্রস্তু’তির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি ও ৮০-৯০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। কন্দ লাগানোর ৫০ দিন পর ১০০-১২০ কেজি হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা হয়। লাগানোর ৯০ দিন ও ১২০ দিন পর যথাক্রমে ২য় ও ৩য় কিস্তি-র সার উপরি প্রয়োগ করা হয়।

ভেলা সামান্য কুপিয়ে ১ম কিস্তি-র সার প্রয়োগ করে আবার ভেলা করে দিতে হয়। ২য় ও ৩য় কিস্তি-র উপরি প্রয়োগের সময় প্রতি হেক্টরে প্রতিবারে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া ও ৪০-৪৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। ২য় ও ৩য় কিস্তি-র সার সারির মাঝে প্রয়োগ করে মাটি কোঁদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সামান্য পরিমাণ মাটি ভেলীতে দিতে হয়।

 

সারের নামশতক প্রতি সারহেক্টর প্রতি সার
কম্পোস্ট২০-৪০ কেজি১০ টন
ইউরিয়া১.২ কেজি৩০০ কেজি
টিএসপি১.১ কেজি২৭০ কেজি
পটাশ১ কেজি২৩০ কেজি
জিপসাম৫০০ গ্রাম১১০ কেজি
দস্তা১০০ গ্রাম২.৫ কেজি।

 

আদা

 

আদা রোপন:

আদার ১—২ কঁূড়ি বিশিষ্ট কন্দ মার্চ থেকে মে মাসে রোপন করতে হবে। সাধারণত ১৫—২০ গ্রাম ওজনের কন্দ প্রতি গর্তে ১টি করে ৪০—৫০ সে.মি. সারি থেকে সারি, গাছ থেকে গাছে ২৫ সে.মি. দূরত্বে ৫ সে.মি. গভীরে রোপন করতে হবে। বীজ রোপনের পর ঝুর ঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আদা রোপনের পর গাছ ও শিকড় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে মাতৃ আদা তুলে নিলে গাছের কোন ক্ষতি হয় না বরং আর্থিক লাভবান হওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে পিলাই তোলা বলে।

 

আদা চাষ পদ্ধতি

 

আদা ফসলের পরিচর্যা :

আদার জমি আগাছামুক্ত থাকা প্রয়োজন। আগাছা পরিষ্কার করার সময় মাটি ঝুর ঝুর করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে এবং সারে উপরি প্রয়োগও একসাথে করতে হবে। আদার জমিতে ১৫ দিন পরপর সেচ দেওয়া ভালো। তবে অতিরিক্ত পানি যাতে না দাড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আদার সাথে অন্যান্য ফসল অথবা ফলজ বৃক্ষ যেমন নারিকেল, সুপারি, কাঠাল বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করা যায়।

রোগ ও পোকা মাকড় দমন কন্দ পচন বা রাইজোম রট রোগ আদার মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ব্যাভিস্টিন বীজ কন্দ দিয়ে শোধন করে ও শুকিয়ে জমিতে লাগাতে হবে। একই জমিতে বার বার আদার চাষ না করা ভালো।

বর্ষার শুরুতে পাতা ঝলসানো রোগ দেখা যায়। প্রথমে পাতায় ডিম্বাকৃতি ফ্যাকাসে দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে দাগগুলি একত্রিত হয়ে বিস্তার লাভ করে এবং পাতা শুকিয়ে যায়। ডাইথেন এম—৪৫ ২.৫ গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আদার পোকা মাকড়ের মধ্যে কান্ড ছিদ্রকারী পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে সঠিক কীটনাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

 

আদার জন্য সেচ:

আদা লাগানোর পর বৃষ্টি হলে সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে বৃষ্টি না হলে ও মাটিতে রসের অভাব থাকলে নালাতে সেচ দিতে হবে এবং ২-৩ ঘন্টা পর নালার অতিরিক্ত পানি বের করে দিন। বৃষ্টির পানি যেন জমতে না পারে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখুন।

আদা চাষে আগাছার পরিচর্যা:

সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র আগাছা দমন করুন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৬০ টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০ টি চারা রাখা উত্তম।

আদা চাষে আবহাওয়া ও দুর্যোগ:

সারিতে বুনোট হবে, যাতে জমির অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করার নালা রাখুন। বাত্তি ফসল তুলে ফেলতে হবে। তাড়াতাড়ি অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করার ব্যবস্থা করুন।

 

আদা

 

আদার রোগ-বালাই ও আগাছা ব্যবস্থাপনা:

আদার কন্দপচা রোগ:

আদার কন্দপচা রোগ দমনের জন্য সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমনঃ কুমুলাস ৪০ গ্রাম বা গেইভেট ২০ গ্রাম বা মনোভিট ২০ গ্রাম) অথবা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমনঃ এমকজিম ২০ গ্রাম) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করুন। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাবেন না বা বিক্রি করবেন না।

রোগের রাইজম রট রোগ:

পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাক । এ রোগ রাইজমে আক্রমণ করে বলে আদা বড় হতে পারে না ও গাছ দ্রত মরে যায় ফলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ভেজা ও স্যাঁত স্যাঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বেশী দেখা যায়। বর্ষাকাল বা জলাবদ্ধতা থাকলে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ রোগ বীজ, পানি ও মাটির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।

রাইজম রট রোগে ক্ষতির নমুনা :

  • প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে যায় কিন্তু’ পাতায় কোন দাগ থাকে না।
  • পরবর্তীতে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মরে যায়।
  • রাইজম (আদা) পচে যায় ও ফলন মারাত্মক ভাবে কমে যায় ।

রাইজম রট ব্যবস্থপনায় যা করা দরকার :

  • অর্ধপচা মুরগীর বিষ্ঠা প্রতি হেক্টরে ১০ টন হারে আদা লাগানোর ২১ দিন পূর্বে মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।
  • অনুমোদিত ছত্রাক নাশক মাটি হালকা কুপিয়ে মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
আদা চাষে পোকামাকড়ঃ

আদার কান্ড ছিদ্রকারি পোকা দমনে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক (যেমন: ফাইফানন ২৫ ইসি বা কিলথিয়ন ৫৭ ইসি ২০ মিলি)প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার ভালভাবে স্প্রে করুন। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই ফসল উঠাবেন না। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আদার কন্দ ছিদ্রকারি পোকা দমনে ফেনিট্রথিয়ন জাতীয় কীটনাশক (যেমন সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন ২০ মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার ভালভাবে স্প্রে করুন।

আদা চাষে আগাছা দমন:

সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র আগাছা দমন করুন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৬০ টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০ টি চারা রাখা উত্তম।

আদা চাষে সতর্কতা:

বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবেনা। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫দিন পর বাজারজাত করুন।

 

আদা

 

আদা চাষে ফসল সংগ্রহ :

আদা লাগানোর ৭—১০ মাস পর পাতা ও গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে গেলে ফসল তোলার উপযোগী হয়। সাধারত: ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে আদা তোলা হয়। আদা তুলে শিকড় ও মাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে তারপর শীতল ও আলো পূর্ণ এলাকায় আদা সংরক্ষণ করতে হবে। ফলন হেক্টর প্রতি ১৫—৩০ টন হতে পারে।

 

Leave a Comment