ইঁদুর দমন

আজকের আলোচনার বিষয় ইঁদুর দমন—যা কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক। ইঁদুর হলো মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী প্রাণী। যুগ যুগ ধরে মানুষ ও ইঁদুরের সহাবস্থান থাকলেও, বাস্তবে এটি মানুষের অন্যতম ক্ষতিকর শত্রু হিসেবে পরিচিত। এরা মাঠ ও গুদামে ফসলের বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে ফসলের প্রায় ১০-২০% ক্ষতি হয়ে থাকে। এক জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ইঁদুরের কারণে ৩০০-৪৮০ কোটি টাকার ফসল ও অন্যান্য সম্পদ নষ্ট হয়।

 

ইঁদুর দমন

ইঁদুরের পরিচিতি ও আচরণ

ইঁদুরের মুখের উপরের পাটিতে একজোড়া ধারালো, তীক্ষ্ণ এবং সদাবর্ধিষ্ণু ছেদন দাঁত থাকে। এই দাঁত দিয়ে ইঁদুর নিয়মিত কিছু না কিছু কাটাকাটি করে, যাতে দাঁত ক্ষয় হয় এবং স্বাভাবিকভাবে খেতে পারে। দাঁত ক্ষয় না হলে দাঁতের বৃদ্ধি বন্ধ হয় না, ফলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাঘাত ঘটে।

শুধু কৃষি ক্ষতিই নয়, ইঁদুর মানুষের শরীরে মারাত্মক রোগ যেমন প্লেগ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।

 

বাংলাদেশে প্রচলিত ক্ষতিকর ইঁদুর প্রজাতি

নিম্নোক্ত ইঁদুর প্রজাতিগুলো কৃষিতে বিশেষভাবে ক্ষতিকর:

১. কালো মেঠো ইঁদুর
২. কালো মে (বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন)
৩. গেছো ইঁদুর
৪. মাঠের নেংটি ইঁদুর
৫. সোলাই বা ঘরের নেংটি ইঁদুর
৬. নরওয়ে বা বাদামী ইঁদুর
৭. নরম পশমযুক্ত ইঁদুর

 

প্রজনন ক্ষমতা ও বিস্তার

ইঁদুর যেকোনো সময় গর্ভধারণ ও বাচ্চা দিতে সক্ষম। তবে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম আবহাওয়ায় তাদের প্রজননের হার কিছুটা কমে যায়। অনুকূল পরিবেশে মাত্র এক জোড়া ইঁদুর থেকে এক বছরে ৮০০-১০০০ ইঁদুর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এদের গর্ভকাল মাত্র ২২ দিন, যা বিস্তারের দিক থেকে ভয়ংকর।

মা ইঁদুর বাচ্চা প্রসবের ২/৩ দিন পর আবার গর্ভধারণ করে। ইঁদুরের দর্শন শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। তবে এদের প্রবণ, ঘ্রাণ ও খান ইন্দ্রিয় খুব উন্নত। গর্ত করা, গাছে চড়া, লাক দেয়া ও সাঁতার কাঁটা অনেক ইঁদুরের অভ্যাস। কিছু কিছু ইঁদুর থেকে থেকে প্রায় ১ মিটার ঊর্ধ্বে লম্বভাবে লাফ দিতে সক্ষম।

এ জন্য এরা সব সময় পরিবেশের উপর নির্ভর করে বসবাসের স্থান পরিবর্তন করে। ইঁদুর যায় না এমন জিনিস কম। প্রতি রাতে এরা শরীরের ওজনের প্রায় ১০% মানা যায়। লুকিয়ে খেতে খুব পছন্দ করে। তাই আমরা সাধারণত এদের দেখতে পাই না। এদের উপস্থিতির লক্ষন দেখেই বুঝতে হয় ইঁদুর আছে কিনা।

 

ইঁদুরের উপস্থিতির চিহ্ন

ইঁদুরের গতিবিধি অনেক সময় সরাসরি চোখে পড়ে না, তবে কিছু লক্ষণ দেখে সহজেই বুঝা যায় তাদের উপস্থিতি। নিচে ইঁদুরের উপস্থিতি নির্ণয়ের কিছু সাধারণ চিহ্ন উল্লেখ করা হলো:

১. বাসা: ধানক্ষেত, ঝোপঝাড়, ছাদ কিংবা মাটির নিচে গোলাকৃতি বাসা তৈরি করে।
২. গর্ত: ঘরবাড়ি বা ক্ষেতে টাটকা গর্ত দেখা গেলে তা ইঁদুরের উপস্থিতির প্রমাণ।
৩. পায়ের ছাপ: কাদা বা বালির উপর ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখা গেলে তা ইঁদুরের।
৪. ক্ষতির চিহ্ন: কাটা শসা, ফল, কিংবা বস্তার তেরছা দাগ দেখে তাদের উপস্থিতি বোঝা যায়।
৫. চলার পথ: ইঁদুর সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পথ ব্যবহার করে এবং তা পরিষ্কার রাখে।
৬. মলমূত্র: বিভিন্ন জায়গায় ইঁদুরের পায়খানার চিহ্নও উপস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
৭. শব্দ: রাতে ঘরে দৌড়ঝাঁপ বা কুটকুট শব্দ শোনা গেলে ইঁদুর আছে বলেই ধরে নিতে হয়।

 

ইঁদুর দমন পদ্ধতি

ইঁদুর দমনের জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে সতর্কতা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতা। ইঁদুরের চলাফেরা লক্ষ্য করে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে বড় ক্ষতি এড়ানো যায়। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

১. অরাসায়নিক দমন পদ্ধতি

১. ধাতব পাত্রে খাদ্য সংরক্ষণ: ধান-চাল বা শস্য ধাতব পাত্রে রাখা এবং গুদামের ফাটল বন্ধ করা।
২. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: বাড়ির আশপাশ ও ক্ষেতের আইল পরিষ্কার রাখলে ইঁদুর নিরাপদ আশ্রয় পায় না।
3. মসৃণ টিনের প্রতিরোধ: ঘরের খুঁটির নিচে মসৃণ টিন লাগালে ইঁদুর উপরে উঠতে পারে না।
৪. গাছপালা পরিষ্কার: গাছের কাণ্ডে মসৃণ টিনের প্যাঁচ এবং গাছ ছাঁটাই করে প্রতিরোধ গড়া।
৫. ফাঁদ ব্যবহার: স্প্রিং টাইপ বা কেস টাইপ ফাঁদে শুঁটকি, ভাজা চাল ইত্যাদি দিয়ে ফাঁদ পাতা।
৬. গর্ত ধ্বংস: গর্তে পানি ঢালা, ধোঁয়া দেওয়া বা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ধোঁয়া প্রয়োগ করে ইঁদুর বের করা।
৭. প্রাকৃতিক শিকারি: বিড়াল, বেজি, চিল, পেঁচা, সাপ ইত্যাদি ইঁদুরের প্রাকৃতিক শিকারি। এদের রক্ষা করা প্রয়োজন।

 

 

 

 

ইঁদুর দমন

 

রাসায়নিক দমন পদ্ধতি

ইঁদুর দমনে রাসায়নিক বিষ অত্যন্ত কার্যকর হলেও এটি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সাধারণত দুই ধরনের রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়:

 

১. তীব্র বিষ (Acute Poison)

তীব্র বিষ হিসেবে জিংক ফসফাইড (Zinc Phosphide) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই বিষ গ্রহণ করলে ইঁদুর তৎক্ষণাৎ মারা যায়। তবে সমস্যা হলো, ইঁদুর সাধারণত বিষ মিশ্রিত টোপের প্রতি লাজুক হয় — প্রথমে একটু মুখে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে, এবং অপছন্দ হলে আর খায় না।

সমাধান:
ইঁদুরের এই বিষটোপ-লাজুকতা এড়াতে শুরুতে ২-৩ দিন টোপে বিষ না দিয়ে শুধু খাবার রাখা হয়। এরপর হঠাৎ করে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি ইঁদুরকে অভ্যস্ত করে তোলে এবং বিষ গ্রহণ নিশ্চিত করে। প্রতি ৪-৫ সপ্তাহ পরপর টোপের গঠন ও উপাদান পরিবর্তন করাও কার্যকর।

ঘরের ইঁদুরদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি দরকার হয়, তবে মাঠের কালো মেঠো ইঁদুর তেমন সতর্ক নয়।

 

২. দীর্ঘস্থায়ী বিষ (Chronic Poison)

রেকুমিন (Racumin) হলো দীর্ঘস্থায়ী বিষের একটি উদাহরণ। এই বিষ গ্রহণের পরে ইঁদুর সরাসরি না মরে ধীরে ধীরে ৬-৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। বিষ শরীরে প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, ফলে ইঁদুর দুর্বল হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

বিষটোপে মিশিয়ে এই বিষ প্রয়োগ করলে অধিকাংশ ইঁদুর ধরা পড়ে।

 

রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্কতা

রাসায়নিক বিষ অত্যন্ত বিষাক্ত হওয়ায় মানুষ ও প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ব্যবহারকালে নিচের সতর্কতাগুলো অনুসরণ করা উচিত:

১. নিরাপদ স্থানে টোপ তৈরি করুন — ঘরের বাইরে, বাচ্চা বা গবাদিপশুর নাগালের বাইরে।
২. বিষ ব্যবহারে সাবধানতা — টোপ তৈরি বা প্রয়োগকালে নাক কাপড় দিয়ে ঢেকে নিন।
৩. ব্যবহার শেষে ধোয়া — হাতমুখ ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৪. দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নিন — বিষক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত বমির ব্যবস্থা করুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫. অনুমতি সতর্কীকরণ — ঘরে বা মাঠে বিষ ব্যবহার করলে সবাইকে আগে থেকে জানিয়ে দিন।

 

সারমর্ম

ইঁদুর হলো মানুষের অন্যতম শত্রু, যা প্রতি বছর ফসলের ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিসাধন করে। এদের প্রজনন হার অত্যন্ত বেশি এবং চলাফেরা খুব চতুর। ইঁদুর বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে, যেমন— কালো মেঠো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, বাদামী ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর প্রভৃতি।

ইঁদুর দমনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো— পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অরাসায়নিক প্রতিরোধ, এবং রাসায়নিক বিষের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে ইঁদুর দমন করা সম্ভব।

Leave a Comment