কলা চাষ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কলা চাষ – যা কৃষিজ উৎপাদন: সবজি, ফুল, ফল চাষ এর অন্তর্ভুক্ত ।

কলা চাষ

 

কলা চাষ

 

ভূমিকা

কলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। শুধু বাংলাদেশকেই নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও অন্যতম একটি ফল। কলা জনপ্রিয়, সস্তা ও সুস্বাদু ফল। এতে মানবদেহের প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান রয়েছে। কলার অনেক জাত সেগুলো সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কলা গাছের গুড়ি কন্দ মাটির নীচে থাকে এটিই আসল কান্ড। পাতার পাতাগুলি শক্ত ও ঘনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভূয়াকাণ্ডে পরিণত হয়।

কলার জমি নির্বাচন

কলার জন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি কলা চাষের জন্য উপযোগী । তবে পর্যান্ত আর্দ্রতা আছে এমন জমি উত্তম ।

জাত নির্বাচন

পৃথিবীতে অনেক চাষযোগ্য জাত রয়েছে। বাংলাদেশে কলার জাত সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় ।

১. পাকা অবস্থায় খাওয়ার উপযোগী কলা
২. আনাজী বা সবজি কলা

১। পাকা অবস্থায় কলার জাত হল- অমৃত সাগর, সবরী, অগ্নীসর, মেহের সাগর, চাম্পা, চিনি চাম্পা, কবরী, এঁটে কলা (বীজযুক্ত কলা)।
২। আনাজী কলা গুলো হল- ভেড়ারভোগ, চোয়াল পউশ, বেহুলা, মন্দিরা ইত্যাদি ।

জমি তৈরি

কলার মূল ততটা গভীর না হলেও বিস্তারশীল। মাটিতে শিকড় যাতে ভালোভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে সেজন্য ভালো করে তৈরি করে নিতে হবে। এরপর ২ মি. x ২ মি. দূরত্বে কাঠি পুঁতে রোপণের অবস্থান ঠিক করে নিতে হবে। কাঠিকে কেন্দ্র করে ৫০ সে.মি. x ৫০ সে.মি. গভীর করে গর্ত খুঁড়তে হয়। ১০-১৫ দিন গর্ত উন্মুক্ত রাখতে হবে। উপরের মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে গর্তে দিতে হবে।

সার প্রয়োগ

কলা গাছে প্রতি বছরে ১২ কেজি গোবর সার, ইউরিয়া ১২০ গ্রাম, টিএসসি ২৫০ গ্রাম, এমপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১১০ গ্রাম এবং জিংক সালফেট ২৫ গ্রাম দেয়ার জন্য বলা হয়ে থাকে। জমি তৈরি শেষ হলে অর্ধেক গোবর জমিতে ছিটিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ২ মি. ×২ মি. দূরত্বে চারা রোপণ করলে ২৫০০ গাছের জন্য হেক্টরে ৩০ টন গোবর সার প্রয়োজন। বাকি অর্ধেক গোবর সার, সম্পূর্ণ টিএসপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট চারা রোপণের আগে মাটির সাথে মিশাতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস থেকে চার মাস পরে অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমপি উপরি প্রয়োগ করতে হবে । অবশিষ্ট ইউরিয়া ফুল আসার আগে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।

বংশ বিস্তার

কলার বংশ বৃদ্ধি সাধারণত অযৌন উপায়ে মাটির নীচ থেকে উৎপন্ন চারা বা সাকার দ্বারা হয়ে থাকে। দুই প্রকারের সাকার উৎপন্ন হয়-

১। সোর্ড বা অসি সাকার: এটি প্রশস্ত গুড়িকন্দ, পাতাগুলি সরু বা তরবারি আকৃতির। এগুলো মাতৃ গুড়িকন্দ থেকে উৎপন্ন হয়। ২। পানি বা ওয়াটার সাকার এর পাতাগুলি চওড়া, গুড়িকন্দ ছোট। এটি মাতৃ গুড়িকদের গুড়িকন্দের গভীরে পার্শ্বমুকুল থেকে উৎপন্ন হয়।

 

কলা চাষ
চিত্র: ৮.৮.১: সোর্ড সাকার

 

কলা চাষ
চিত্র: ৮.৮.২: পানি বা ওয়াটার সাকার

 

চারা নির্বাচন

বংশ বৃদ্ধির জন্য সোর্ড সাকার ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। কারণ সোর্ড সাকারে গাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট খাদ্য জমা থাকে।

চারা রোপণ পদ্ধতি

যে কোন সময় চারা রোপণ করা যায় তবে সেপ্টেম্বর নভেম্বর পর্যন্ত চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। কারণ এ সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে । পূর্বে তৈরিকৃত গর্তের ঠিক মাঝখানে চারা রোপণ করতে হবে। রোপণের গভীরতা ১৫-২০ সে.মি. এবং মধ্যে ভালো। তবে চারাটি মাতৃ গুড়িকদের সাথে মাটিতে যত গভীরে ছিল, ঠিক ততটুকু গভীরে রোপণ করা ভালো ।

আগাছা দমন

গাছের বৃদ্ধির প্রথম পর্যায় বিশেষ করে ৩-৪ মাস কলা বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। যেহেতু মূল মাটির অল্প গভীরে থাকে সেজন্য আগাছা গাছের বৃদ্ধিকে ব্যহত করে।

পানি সেচ ও নিষ্কাশন

শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর সেচ দিতে হবে। কলার জমি একেবারে শুকিয়ে যেতে দেয়া উচিত নয়। প্লাবন বা নালা যে কোন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা বর্ষার সময় পানি জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

রোগ দমন

কলার পানামা রোগ (Fusarium wilt) একটি মারাত্মক রোগ। অমৃতসাগর ও সবরিতে এ রোগের আক্রমণ বেশী । এটি মাটি বাহিত রোগ। এ রোগে প্রথমে নিচের পাতা হলুদ হয়ে যায়, দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ মারা যায়। আক্রান্ত গাছ মাটিসহ উপড়ে পুরে ফেলতে হবে। একই জমিতে ৩-৪ বছর কলাগাছ না করাই ভালো।

পোকা দমন

কলার পাতা এবং ফলের বিটল এর পূর্ণাঙ্গ পোকা কচি পাতা বা কচি ফল এর উপরে নরম অংশ চেঁচে খেয়ে ফেলে। সুতরাং কাদি বের হওয়ার পরপর সবুজ পলিথিন দ্বারা বা অন্য কোন স্বচ্ছ ব্যাগ দ্বারা কাদি ঢেকে দিতে হবে। এতে সূর্যালোকে গরম বাতাস-ধুলোবালি পোকার হাতে থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং ঘোড় কেটে দিতে হবে। এছাড়া ১০ গ্রাম কার্বোফুরান গাছের চারদিকের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।

সাথী ফসল চাষ

চারা রোপনের ১ম ৪/৫ মাস বলতে গেলে জমি ফাকাই থাকে। এ সময় কলাবাগানে অন্তবর্তী ফসল হিসেবে মিষ্টি কুমড়া শসা ও বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি (মূলা, পালং শাক, মরিচ, ছোলা, মসুর, বরবটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাল শাক, ডাটা) চাষ করা যেতে পারে ।

খুঁটি/ ঠেস দেওয়া

কলা গাছে ছড়া আসার পর বাতাসে গাছ ভেঙ্গে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাঁশ বা গাছের ডাল দিয়ে খুঁটি বেঁধে দিলে হুড়া ভেঙ্গে পড়া রোধ হয় ।

অতিরিক্ত চারা (সাকার) কর্তন

কলাগাছের গোড়া হতে নতুন সাকার/চারা বের হয়ে থাকে। কলাগাছে ছড়া বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই সাকার রাখা উচিত নয়। সাধারণত: দু’এক মাস পরপর এসব চারা মাটির সমান করে কাটা দরকার। কাদি সম্পূর্ণ বের হওয়ার পর মুড়ি ফসলের জন্য গাছ প্রতি মাত্র একটি চারা রেখে বাকিগুলো কাটতে হবে ।

ফল সংগ্রহ

ফুল বের হবার ৯০ থেকে ১৩০ দিনে কলা সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। কলা পরিপক্ক হলে এর শিরাগুলো সমান হয়ে যায় এবং ফ্যাকাশে সবুজ রং ধারণ করে। এরকম অবস্থায় কাদি কেটে নামানো হয়। কাদি বা ফানাগুলোকে ঘরে উপর রেখে তারপর খড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এতে কলা সমানভাবে পাকে ও রং চমৎকার হয় ।

 

ফলন: হেক্টর প্রতি সাধারণত ২০-২৫ টন ফলন হতে পারে।

সারসংক্ষেপ

কলার মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। কলা গাছের গুড়ি কন্দ মাটির নীচে থাকে এটিই আসল কাজ। বাংলাদেশে কলার জাত সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। (১) পাকা অবস্থায় খাওয়ার উপযোগী কলা (2) আনাজী বা সবজি কলা অযৌন উপায় মাটির নীচ থেকে উৎপন্ন চারা বা সাকার দ্বারা হয়ে থাকে। ফুল বের হবার ৯০ থেকে ১৩০ দিনে কলা সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।

 

Leave a Comment