কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি – যা বনায়ন এর অন্তর্ভুক্ত। কাঠ সংরক্ষণ মানুষের জীবন যাত্রার ধরনের উপর নির্ভরশীল। আসলে সৃজনশীলভাবে কাঠ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভাবে কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল। যখন কাঠ সিজনিং ও ট্রিটমেন্ট পদ্ধতি ছিলনা তখন মানুষকে কাঠ সংরক্ষণের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হত।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আমাদেরকে কাঠ সংরক্ষণের জন্য এখন এত কষ্ট করতে হয় না। কাঠের স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করার জন্য কাঠকে ব্যবহার উপযুক্ত করা বা সিজনিং করা হয় । বাঁশের স্থায়ীত্ব দীর্ঘায়িত করার জন্যও সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় কাঠ বা বাঁশকে সিজিনিং করে কর্তিত কাঠ বা বাঁশের গুণগতমান ও স্থায়ীত্বকাল বেশ কয়েকগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ পাঠে আপনি কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি ও কাঠ সংরক্ষণের উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা লাভ ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন ।

কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি

কাঠ সিজনিং ও টিটমেন্ট

ভিজা বা কাঁচা কাঠ থেকে আর্দ্রতা অপসারণ অথবা কাঠ করণ হল কাঠ সিজনিং ও ট্রিটমেন্ট। আর্দ্রতা কাঠের অভ্যন্তরে যুক্ত পানি হিসেবে অথবা কোষপ্রাচীরে রাসায়নিকভাবে আবদ্ধ পানি হিসেবে থাকে। আর্দ্রতার পরিমাণ ৩০ শতাংশের বেশি হলে সে কাঠকে সাধারণত কাঁচা কাঠ বলা হয়। জীবন্ত অবস্থায় বৃক্ষের জন্য পানি অপরিহার্য হলেও কাটার পর কর্তিত বৃক্ষে পানির পরিমাণ যত কম থাকবে কাঠ তত বেশি টিকবে।

পানির পরিমাণ যদি কাঠ ওজনের ১২% এ নামিয়ে আনা যায় তাহলে ধরে নিতে হবে কাঠের গুণগত মান সর্বোত্তম হবে। সিজনিং বা টেকসইকরণে কাঠের গুণগত মান ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। উপযুক্ত সিজনিং কাঠের আয়ুষ্কাল বাড়ায় এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এ অণুজীবের আক্রমণ থেকে কাঠকে বাঁচায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সিজনিংয়ের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বায়ু সিজনিং বাষ্প ও পানি সিজনিং এবং বাষ্পীয় রাসায়নিক, সৌরভাঁটি ও ভাঁটি দ্বারা শুষ্ককরণ আর বুলটন সিজনিং মূলত: সিজনিংকে দুইভাবে করা যায়-

১. এয়ার ডাইং

বায়ু সিজনিং পদ্ধতিতে কাঠ প্রাকৃতিক বায়ু ও তাপে খোলা জায়গায় বা ছায়ায় দীর্ঘ সময় রেখে দেওয়া হয়। এটি একটি চিরাচরিত পদ্ধতি এবং এতে বাংলাদেশের জলবায়ুতে ২৫ মিলিমিটারের অধিক চগুড়া গোলাকার ও চেরাই কাঠ পুরো একটি শীত ঋতুসহ কমপক্ষে এক বছরের জন্য ফেলে রাখতে হয়। পাতলা কাঠ, তা, বোর্ড, জ্বালানি কাঠ সাধারণত কেবল ভাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য সরাসরি রোলে রাখা হয়।

অত্যন্ত টেকসই ও শক্ত কাঠের জন্যই বায়ু সিজনিং লাভজনক, পক্ষান্তরে হালকা কাঠ প্রায়ই ছত্রাক, পোকা ও মোন্ড দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সমানভাবে সিজনিং সম্ভব হয় না। তবে হালকা পাতলা চেরাই করা কাঠ প্রখর রোদে শুকালে কাঠ ফেটে বা বেঁকে যেতে পারে। তাই এগুলোকে মাটি থেকে ৩০- ৪০ সেমি উঁচুতে ছায়ায় স্তরে স্তরে শুকাতে হয় ।

 

কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি
চিত্রা ১২.৭.১ এয়ার ডাইং

২. কিলন পদ্ধতি

কিলন পদ্ধতিতে একটি বড় পাকা বায়ুনিরপেক্ষ কক্ষে কাঠের তক্তার গায়ে না লাগে এবং দুটো তক্তার মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। অতপর বায়ুনিরপেক্ষ কক্ষে প্রথমে জলীয়বাষ্প প্রবেশ করিয়ে কাঠের পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।

পরবর্তীতে ভাপ প্রয়োগ করে সে কক্ষ থেকেও একই সাথে কাঠ থেকে পানি বের করে নেয়া হয়। সাধারণত বেশি কাঠ একসাথে সিজন করার জন্য কিলন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে কাঠকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সিজনিং করে পানির পরিমাণ ১২% এ নামিয়ে আনা যায়। তবে প্রজাতিভেদে সিজনিং এর সময় কম বেশি হতে পারে।

কাঠ সংরক্ষণ

রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে কাঠ, কাঠজাত দ্রব্যাদি ও আসবাবের কাঠের ক্ষণ, পচন বা ক্ষতি রোধ করা যায়। কাঠ সাধারণত ছত্রাক (সাদা পচন, বাদামি পচন ও কোমল পচন চত্রাক), কীটপতঙ্গ (উইপোকা, বিটল, ঘুণপোকা), সামুদ্রিক এক ধরনের ঝিনুক এবং অন্যান্য নানা প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এমন কোনো একক সংরক্ষর নেই যা সংরক্ষণে সবগুলি চাহিদা মেটাতে পারে। কাঠসংরক্ষক হতে পারে তৈলজ, তরল বস্তু অথবা একটি মিশ্রণ। ক্রিয়োসোট, পেন্টাক্লোরোফেনল ও তৈলজ জৈবসংরক্ষক একসময় বাংলাদেশে কাঠের খুঁটি, খাদ্য ও রেলওয়ে স্লিপার সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতো। আজকাল ক্রিয়োসেটি শুধুই রেলওয়ে স্লিপার সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। সিসিএ নামের রাসায়নিক দব্যটি সংরক্ষণী হিসাবে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

সিসিএ সংরক্ষণটি ৩টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত । এর মধ্যে রয়েছে ক্রোমিক অক্সাইড ৪৭.৫%, কপার অক্সাইড ১৮.৫%, আর্সেনিক পেন্টা অক্সাইড ৩৪। উপাদানগুলো পৃথক পৃথকভাবে কিনেও আনুপাতিক হারে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা যায়। পানিতে মিশ্রণটি ২.৫% দ্রবণ তৈরি করা হয়। প্রবণটি বিশেষ চাপ পদ্ধতিতে কাঠের মধ্যে ঢুকানো হয়। প্রতি ঘনফুট কাঠে সাধারণভাবে ০.৪ পাউন্ড সংরক্ষণী প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়।

এ পদ্ধতিতে কাঠ সংরক্ষণের ৭ দিন পর ব্যবহারযোগ্য হবে। সিসিএ সংরক্ষণী দিয়ে সংরক্ষিত কাঠ পচন প্রতিরোধ করতে পারে। উইপোকার আক্রমণও প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এছাড়াও বাংলাদেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ধৌতকরণ, প্রলেপন, ছিটানো ও তরলে ডুবানো, ভিজানো, গরম-ঠাণ্ডা প্রবাহ, ব্যানক্রিয়া ও চাপপ্রযোগ।

গোটা কাঠের উপর চাপপ্রয়োগ সংরক্ষেকের ভেদ্যতা বা রক্ষণক্ষমতার দিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে কাঠের অভ্যন্তর প্রথমে বায়ুশূণ্য করে সংরক্ষক দ্রবণে চাপ দিয়ে তা কাঠের শূণ্য কোষগুলিতে ভরাট করা হয়।

 

কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি
চিত্র:১২.৭.২: চুবানো পদ্ধতি

 

কাঠ সংরক্ষণ পদ্ধতি
চিত্র- ১২.৭.৩: প্রাণরস বিচ্যুতি পদ্ধতি

 

বৃক্ষ কর্তন সংরক্ষণের উপযোগিতা

গাছ লাগানো ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিচর্যার মাধ্যমে সেগুলো বড় করে তোলার পিছনে নানা উদ্দেশ্যে থাকে। তবে যে উদ্দেশ্যেই গাছ লাগানো হোক না কেন সুনির্দিষ্ট আবর্তনকাল শেষে পরিপক্কতা লাভ করলে গাছ কর্তন করাই শ্রেয়। কারণ নির্দিষ্ট সময় পরে গাছের কাঠের মান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া অনেক সময় গাছের বাকল ফেটে বা রোগাক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে কাজের অভ্যন্তর ভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। তাছাড়া গাছ কখন কাটতে হবে তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর। যেমন-

১। কাঠ দিয়ে কী করা হবে?

২। কোন পরিমাপের কাঠ প্রয়োজন?

৩। কী মানের কাঠ প্রয়োজন?

৪।  এখনই টাকার প্রয়োজন কিনা।

৫। গাছ আরও বড় হয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা ডালপালায় ছেয়ে যেতে পারে কিনা?

৬। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে বা গাছ উপড়ে স্থাপনা বা জানমালের ক্ষতির কারণ হতে পারে কিনা?

৭। গাছ কোন বিশেষ রোগে আক্রান্ত হয়েছে কিনা? গাছের আবর্তন কাল শেষ হয়েছে কিনা?

৮। যে কারণেই গাছ কাটা হোক না কেন নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে কাটতে হবে।

গাছ ও সঠিক নিয়মে কর্তন এবং মন্ডিত করণের মাধ্যমে অপচয় রোধ করা যায়। আর ব্যবহারের আগে বিজ্ঞান সম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী করা যায়। বৃক্ষ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। কোনো বন এলাকায় বছরে কী পরিমাণ কাঠ বৃদ্ধি পায় সব সময় তার চেয়ে কম কাঠ আহরণ করতে হবে। এর ফলে বনজ সম্পদ সংরক্ষিত হয়।

কাঠের পোকা

কাঠের পোকার ক্ষতিসাধন থেকে প্রতিরোধের উপায় হল কাঠে সংরক্ষণমূলক ঔষুধ প্রয়োগ, কীটনাশক, ছিটানো, পালিশ লাগিয়ে ভৌত বাধা সৃষ্টি, কাঠ দ্রুত কেঁটে দিয়ে শুকানো, পানিতে জাগ দেওয়া, কীট প্রতিরোধক কাঠ ব্যবহার ইত্যাদি। ঘুণপোকা (Heterobostrychus Sinoxylon, Dinoderus) (Bostrychidae: Coleoptera) শুষ্ক কাঠ আক্রমণ করে।

এগুলি শুধু শ্বেতসারপ্রধান কোমলকাঠ ছিদ্র করে এবং কাঠ ময়দার মতো মিহি গুঁড়োয় পরিণত করে। Hoplocerambyx spinicornis 1 Batocera (Cerambycidae: Coleoptera) নামের লম্বা অ্যানটিনাবিশিষ্ট কতিপয় পোকা কাঠের ভিতরে ছিদ্র করে এবং এ ছিদ্র করা সুড়ঙ্গগুলি সাধারণত কাঠের গুঁড়োয় ভরে থাকে। কার্পেন্টার বাঁ (Carpenter bee) নামে পরিচিত Xylocopa (Sylocopidae: Hymenoptera) বাসা তৈরীর জন্য কাঠে সুড়ঙ্গ বানায়। বেশ কিছু প্রজাতির উইপোকা মাটিতে ফেলে রাখা, গুদামজাত অথবা ব্যবহৃত হচ্ছে এমন কাঠ আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষতি করে।

সারসংক্ষেপ

কাঠ টিটমেন্টের অন্যতম উদ্দেশ্য হল কাঠকে পচন ও নষ্টের হাত হতে রক্ষা করা। এক্ষেত্রে সিসিএ রাসায়নিক দ্রবটি আমাদের দেশে অতি পরিচিত। এর মাধ্যমে কাঠকে আপনি ঘুনপোকা, কার্পেন্টার বাঁ, ক্ষতিকর আর্থোপোড়া ও কীটপতঙ্গ ইত্যাদি হতে সহজে মুক্ত রেখে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারবেন ।

 

Leave a Comment