কৃষি মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও মৌলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। শিকার ও আহরণের যুগ থেকে মানুষ যখন প্রথম শস্য বপন ও প্রাণী গৃহপালন শুরু করল, তখন থেকেই কৃষির ইতিহাসের সূচনা। কৃষি কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আজকের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, মেকানাইজেশন, এবং স্মার্ট ফার্মিং-এর পিছনে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তন।
কৃষির ইতিহাস
প্রাগৈতিহাসিক যুগে কৃষির সূচনা
মানব ইতিহাসের প্রথম দীর্ঘ অধ্যায় ছিল শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের যুগ। প্রায় ১২,০০০ বছর আগে, শেষ বরফযুগের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করে। তখন মানুষ ধীরে ধীরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শস্য যেমন গম, যব, ও ধানের দানা সংগ্রহ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।
পরে তারা লক্ষ্য করে—বীজ মাটিতে ফেললে আবার অঙ্কুরোদ্গম হয়। এভাবেই মানুষ প্রথম সচেতনভাবে বীজ বপন শুরু করে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অব্দেই মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে কৃষির সূচনা হয়েছিল। এটিই “Neolithic Revolution” বা কৃষি বিপ্লব নামে পরিচিত।
প্রাচীন সভ্যতায় কৃষি
মেসোপটেমিয়া
মেসোপটেমিয়া নদী উপত্যকা (টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস) ছিল কৃষির প্রথম কেন্দ্র। এখানে গম, যব ও খেজুর গাছের চাষ হতো। সেচ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, যা কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
মিশর
নাইল নদীর তীরবর্তী মিশরে কৃষি ছিল সভ্যতার প্রাণশক্তি। প্রতিবছর নাইলের বন্যা মাটিকে উর্বর করে তুলত। গম ও যব ছিল প্রধান ফসল।
সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতায় (আজকের পাকিস্তান ও ভারতের পাঞ্জাব) ধান, গম, খেসারি, তুলা চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে প্রথমবার তুলা উৎপাদন হয়।
চীন
চীনে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে ধান ও বাজরার চাষ শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সিল্ক রোডের মাধ্যমে এ কৃষিজ পণ্য বিশ্বের নানা প্রান্তে পৌঁছায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষির বিকাশ
বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষির ইতিহাস প্রায় ৪০০০ বছরের পুরোনো। এ অঞ্চলের উর্বর নদীভূমি (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু) কৃষির জন্য আদর্শ ছিল।
- ধান চাষ: বাংলাদেশসহ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় প্রাচীনকাল থেকেই ধান চাষ প্রচলিত ছিল।
- আখ ও গুড় উৎপাদন: আখের চাষ ও গুড় উৎপাদনের ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে।
- তুলা ও পাট: ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকেই তুলা ও পাটের চাষ প্রচলিত ছিল। পাটকে বলা হয় “Golden Fiber of Bengal।”
মধ্যযুগে কৃষি
মধ্যযুগে কৃষি আরও উন্নত হয়। ইসলামী বিশ্বে কৃষি জ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।
- আরবরা সেচ প্রযুক্তি, খেজুর, কমলা, আখ ও ধানের বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে।
- ইউরোপে মধ্যযুগে তিন ফসলি ব্যবস্থা চালু হয় (Three-field system), যাতে এক জমিতে পর্যায়ক্রমে তিন ধরণের ফসল চাষ হতো।
- বাংলাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলে কৃষিকে অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ধরা হতো। মোগল আমলে নতুন সেচ ব্যবস্থা, খাল কাটার প্রকল্প ও নতুন জমি আবাদ হয়।
আধুনিক কৃষির সূচনা
১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপে কৃষি বিপ্লব (Agricultural Revolution) শুরু হয়। নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজ নির্বাচন, পশুপালন কৌশল কৃষিকে বদলে দেয়।
- জেথ্রো টালের উদ্ভাবিত সিড ড্রিল (Seed Drill) ছিল কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা।
- ফসলের ঘূর্ণন ব্যবস্থা (Crop Rotation) মাটির উর্বরতা বজায় রাখে।
- শিল্প বিপ্লবের সাথে কৃষিও পরিবর্তিত হয়। কৃষি যন্ত্রপাতি, ট্রাক্টর, রাসায়নিক সার কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব আনে।
উপনিবেশিক যুগে ভারতীয় কৃষি
ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে ভারতীয় কৃষি অনেকটা রপ্তানিমুখী হয়ে ওঠে।
- আফিম, নীল, তুলা, চা ও পাট চাষে জোর দেওয়া হয়।
- কৃষকরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে রপ্তানিযোগ্য নগদ ফসল উৎপাদনে বাধ্য হয়।
- বাংলার নীলচাষ কৃষকদের দুঃসহ অভিজ্ঞতা আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।
স্বাধীনতার পর কৃষি
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- উচ্চ ফলনশীল ধান (HYV Rice) চালু হয়।
- কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI, BRRI) প্রতিষ্ঠিত হয়।
- কৃষি ঋণ, ভর্তুকি, আধুনিক সার ব্যবস্থাপনা চালু হয়।
ভারতেও সবুজ বিপ্লব (Green Revolution) ঘটে, যা খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপুল সাফল্য আনে।
আধুনিক কৃষি: প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন
২১শ শতকে কৃষি এখন বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে।
- কৃষি প্রযুক্তি: ড্রোন, সেন্সর, AI ও IoT কৃষি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হচ্ছে।
- হাইড্রোপনিক্স ও অ্যাকুয়াপনিক্স: মাটিবিহীন কৃষি প্রযুক্তি দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।
- জৈব কৃষি: স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে জৈব কৃষির গুরুত্ব বাড়ছে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: আধুনিক কৃষি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিযোজিত।
বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য
- ধাননির্ভর সমাজ: বাংলাদেশে কৃষি ধানকেন্দ্রিক ছিল এবং এখনও ধানই প্রধান খাদ্যশস্য।
- পাট উৎপাদন: ২০শ শতকে পাটই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস।
- আধুনিকায়ন: স্বাধীনতার পর কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, সেচ, উন্নত বীজ কৃষিকে বদলে দিয়েছে।
- রপ্তানি: আম, কাঁঠাল, চা, সবজি ও সামুদ্রিক মাছ এখন বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় অবদান রাখছে।
কৃষির ইতিহাস মূলত মানব সভ্যতার ইতিহাস। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে আধুনিক বাংলাদেশ পর্যন্ত কৃষি কেবল খাদ্য সরবরাহ করেনি, বরং সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তম্ভকে গড়ে তুলেছে। আজকের আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ কৃষি সেই দীর্ঘ বিবর্তনের ফল।
ভবিষ্যতের কৃষি হবে স্মার্ট, পরিবেশবান্ধব, এবং টেকসই। কিন্তু এর মূল শেকড় প্রোথিত রয়েছে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কৃষকের হাতে, যিনি প্রথমবারের মতো বীজ মাটিতে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।