বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র । HSC” বিষয় এর ইউনিট ১ এর পাঠ-১.২ নং পাঠ।

Table of Contents

বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

 

গ্লাডিওলাস ফুল চাষ

ফসল:

যে সমস্ত উদ্ভিদ মাঠে পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত মূল দ্রব্য অথবা উপজাত দ্রব্যের আর্থিক মূল্য আছে তাদেরকে ফসল বলা হয়। যেমন, ধান, গম, সবজি ইত্যাদি। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যে সকল গাছপালার চাষাবাদ করে তাকেই আমরা ফসল বলতে পারি। এই ফসল বা শস্য সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা ও সুষ্ঠুভাবে জ্ঞানার্জন আবশ্যক।

 

মাঠ ফসল (Field Crop):

মাঠ ফসল বলতে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত ফসলকে বোঝায় সেগুলো বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করা হয়। মাঠ ফসলকে কৃষিতাত্ত্বিক (অমৎড়হড়সরপ ঈৎড়ঢ়) ফসলও বলা হয়। মাঠ ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একই জমিতে একই ফসল চাষ করা হয়। যেমন—ধান, গম, পাট, সরিষা, ছোলা, ভুট্টা, মসুর, খেসারী, চীনা ও কাউন ইত্যাদি। মাঠ ফসলের জন্য জমিতে একইভাবে প্রস্তুত করা হয় এবং এর বীজ একসাথে ছিটিয়ে বা লাইনে বপন বা রোপন করা হয়। সাধারণত একই জমিতে বছরে এক বা দুইবার মাঠ ফসল উৎপাদন করা হয়।

বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা যেমন—পানি সেচ, আগাছা দমন, পানি নিস্কাশন, সার ও বালাই নাশক ইত্যাদি এক সাথে করা হয়।

 

মাঠ ফসলের শ্রেণিবিভাগ :

ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে মাঠ ফসলকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়।

যেমন-

দানা জাতীয় ফসল (Cereal grain crops ) :

গ্রামিণী ( Gramineae) পরিবারভুক্ত যেসব দানা জাতীয় ফসল প্রধানত কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাদেরকে দানা জাতীয় ফসল বলে। যেমন ধান, গম, ভুট্টা, চীনা, জোয়ার, সরগাম ইত্যাদি।

 

ভাল জাতীয় ফসল (Pulse Crops ) :

লিগুমিনোসি পরিবারের অন্তর্গত যে সব দানা ফসল ভালের জন্য উৎপাদন করা হয় তাদের ডাল ফসল বলে । যেমন মুগ, মসুর, ছোলা, মাসকালাই এবং মটর ইত্যাদি। ডাল জাতীয় ফসল আমিষের অন্যতম
উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

গাঁজা গাছ চাষ পদ্ধতি

 

তেলবীজ ফসল (Oilseed crop ) :

যে সব ফসল তেল উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ করা হয় তাদেরকে তেলবীজ ফসল বলে। যেমন-সরিষা, সয়াবিন, তিল, তিসি ইত্যাদি। তেলবীজ ফসল স্নেহজাতীয় উপাদানের প্রধান উৎস ।

 

চিনি ফসল (Sugar Crop ) :

যে সকল ফসল চিনি উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয় তাদেরকে চিনি ফসল বলা হয়। যেমন- আখ, সুগার বিট ইত্যাদি ।

 

আঁশ জাতীয় ফসল (Fiber Crop) :

যে সব ফসল আঁশ আহরনের জন্য উৎপাদিত হয় তাদেরকে আঁশ জাতীয় ফসল বলে। যেমন- পাট, কেনাফ, মেতা, তুলা ইত্যাদি।

 

পশু খাদ্য ফসল (Fodder Crops ) :

যে সব ফসল পশু খাদ্যের উৎস হিসেবে চাষ করা হয় তাদেরকে পশু খাদ্য ফসল বলে। যেমন- নেপিয়ার ঘাস, দুর্বা ঘাস, ক্লোভার ইত্যাদি।

 

পানীয় ফসল (Beverage Crops) :

পানীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যেসব ফসল চাষ করা হয় তাদেরকে পানীয় ফসল বলা হয় যেমন চা, কফি, কোকো ইত্যাদি ।

 

নেশা জাতীয় ফসল :

নেশাজাতীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যেসব ফসল চাষাবাদ করা হয় তাদেরকে নেশাজাতীয় ফসল বলা হয়। যেমন—তামাক, গাঁজা ইত্যাদি।

 

সবুজ সার ফসল  :

যে সকল ফসল সবুজ সার উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয় তাদেরকে সবুজ সার ফসল বলে। যেমন ধৈঞ্চা, ইপিল ইপিল, কাউন ইত্যাদি।

 

শিল্প ফসল:

শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের জন্য যেসব ফসল চাষ করা হয় তাদেরকে শিল্প ফসল বলে। যেমন—পাট, আখ, রাবার, তুলা ইত্যাদি।

 

মাঠ ফসলের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাঠ ফসলের গুরুত্ব সর্বাধিক। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য ধান হলো মাঠ ফসলের একসাথে। চাষযোগ্য জমির অধিকাংশটি ব্যবহৃত হয় মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য এবং ধান সবচেয়ে বেশি জমিতে চাষ করা হয়। এছাড়াও গম, অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল, তেলবীজ ফসল ও চাষ করা হয়।

দানাজাতীয় ফসলের ৮০—৮৫% আসে ধান থেকে এবং ৬—৮% আসে গম থেকে। ধান ও গম শর্করা জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডাল জাতীয় ফসল যেমন মসুর, মুগ, খেসারী ইত্যাদি উদ্ভিদজাত আমিষের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তৈল বীজ ফসল স্নেহজাতীয় খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এ সকল উদ্ভিদজাত স্নেহ বা চর্বির পুষ্টিমান প্রাণিজ তেল থেকেও বেশি। এছাড়াও পশু পাখি, হাঁস মুরগী ও মাছের খাদ্যের অন্যতম উৎস হিসেবে ও মাঠ ফসলের অবদান রয়েছে।

মাঠ ফসল যেমন, পাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত এবং এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।

 

মাঠ ফসলের বৈশিষ্ট্য:

১। সাধারণত একসাথে বি¯ীর্ণ এলাকা জুÍ ড়ে চাষ করা হয়।
২। প্রতিটি গাছ/চারার আলাদা যত্ন নিতে হয় না।
৩। মাঠ ফসলের জমিতে সাধারণত বেড়া দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
৪। মাঠ ফসলের বীজ একসাথে ছিটিয়ে বা সারিতে রোপন বা বপন করা হয়।
৫। সাধারণত সমস্ত ফসল একসাথে কর্তন সংগ্রহ করা হয়।

 

krishi 6 বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

 

উদ্যান ফসল (Horticulture crop):

উদ্যান ফসল বলতে সেসব ফসলকে বোঝায় যেগুলো অনেক সময় বেড়া দিয়ে উৎপাদন করা হয়। সাধারণত: উদ্যান ফসলের চাষ স্বল্প পরিসরে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদা মিটাতে বি¯ৃÍত এলাকায়ও উদ্যান ফসলের চাষ করা হয়। উদ্যান ফসল বন্যামুক্ত উঁচু জমিতে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়।

সাধারণত বসতবাড়ির আশে পাশে উর্বর জমিতে উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। রাস্তার ধারে, পতিত জমিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট কথা ছোট উঁচু জমি যেখানে আছে সেখানেই উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। এছাড়া ঘরের বারান্দায়, ছাদে টবের মধ্যেও চাষ করা হয়। উদ্যান ফসল চার প্রকার। যথা—

(১) ফল জাতীয় ফসল:

যেমন, আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, লিচু, আনারস, পেঁপে, কুল ইত্যাদি।

(২) ফুল জাতীয় ফসল :

যেমন—গোলাপ, গাঁদা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি।

(৩) শাক সবজি জাতীয় ফসল :

বেগুন, টমেটো, বাধাঁ কপি, ফুলকপি, ডাটা শাক ইত্যাদি। (৪) মসলা জাতীয় ফসল: যেমন, পেঁয়াজ, রসুন হলুদ, আদা, এলাচ ইত্যাদি।

 

গ্লাডিওলাস ফুল চাষ

 

উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য:

১। সাধারণত স্বল্প জমিতে চাষ করা হয়।

২। জমি উঁচু হতে হবে, জমির চারপাশে অনেক সময় বেড়া দিতে হয়।

৩। প্রতিটি গাছের আলাদা যত্ন নিতে হয়।

৪। তুলনামূলক বেশি যত্ন নিতে হয়।

৫। ফসলের মূল্য মৌসুমের শুরুতে বেশি হয়। ফসল উৎপাদন খরচ কম হয় এবং লাভ বেশি হয়।

৬। ফসল উৎপাদনে ঝঁুকি কম।

৭। একই জমির সব ফসল একই সময়ে পরিপক্ক হয় না তাই কয়েকবার ফসল সংগ্রহ করতে হয়।

৮। আন্তঃপরিচর্যা বেশি করতে হয় এবং নিয়মিত পানি সেচ দিতে হয়।

৯। এরা স্বল্প সময়ের, একবর্ষজীবী, দ্বিবর্ষজীবী ও বহুবর্ষজীবী হতে পারে।

১০। ফসল সাধারণত তাজা বা রন্ধন অবস্থায় ব্যবহার করতে হয়।

১১। বেশিরভাগ উদ্যান ফসলই দ্রুত পচনশীল।

১২। উদ্যান ফসলের বীজ বা চারা সাধারণত সারিতে বপন বা রোপন করা হয়।

 

উদ্যান ফসলের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্যে বি¯ৃÍত মাঠে উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। তবে স্বল্প পরিসরে পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই মূলত উদ্যান ফসল চাষ করা হয়। পরিবারের ফল ও শাকসবজির চাহিদা যোগান দেয়ার পাশাপাশি বাড়তি ফসল বিক্রয় করে নগদ অর্থ উপার্জিত হয়। এছাড়া গৃহপালিত পশুর খাদ্যের উৎস হিসেবে ফল গাছের পাতা ব্যবহৃত হয়। বয়ষ্ক ফল গাছ থেকে উন্নত জাতের কাঠ ও জ্বালানি পাওয়া যায়। এছাড়া ফুল চাষের মাধ্যমে যেমন বিনোদন পাওয়া যায় তেমন ফুল চাষ করে অনেক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হচ্ছে।

ফল, শাকসবজি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং এগুলো বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে।

 

Capture 4 বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়নCapture 1 1 বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

 

সামাজিক বনায়ন (Social Afforestration):

আদিমকাল থেকেই বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু। প্রাচীনকালে মানুষের যখন ঘরবাড়ি ছিল না তখন মানুষ গাছেই বাস করত। আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন সেটিও বৃক্ষই যোগান দেয়। মানুষসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। প্রতিটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বৃক্ষ বা বনভুমি থাকা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বনায়ন ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে থেকে বনায়ন কর্মসুচী গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে ‘সামাজিক বনায়ন হলো এমন বন ব্যবস্থাপনা বা কর্মকান্ড যার সাথে পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠি ওতপ্রোতভাবে জড়িত’।

এর মাধ্যমে উপকারভোগী জনগণ কাঠ ও জ্বালানি, খাদ্য, পশু খাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকে।

Capture 5 বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

সুতরাং বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রমকে সামাজিক বনায়ন বলে। অর্থাৎ যে বনায়ন বা বন ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সরাসরি জড়িত থাকে বা অংশগ্রহণ করে অর্থাৎ জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে এবং জনগণ দ্বারা সৃষ্ট বনকে সামাজিক বনায়ন বা বন বলে।

 

সামাজিক বনায়নের প্রকারভেদ (Classification) :

সামাজিক বনায়ন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন:

(১) কমিউনিটি বনায়ন
(২) গ্রামীণ বনায়ন
(৩) অংশীদারিত্ব বনায়ন
(৪) স্বনির্ভর বনায়ন

 

সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তা (ঘNecessity of Social Afforestration):

ক. প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ ও মরু প্রক্রিয়া থেকে দেশকে রক্ষা করা।
খ. ভুমির সুষ্ঠু ও উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা।
গ. দেশের বিরাজমান গাছ ও জ্বালানি কাঠের ঘাটতি নিরূপণ করা।
ঘ. গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাঁচামাল ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
ঙ. পতিত, অনাবাদী ও প্রান্তিক জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা।

krishi 5 বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মাঠফসল, উদ্যান ফসল ও সামাজিক বনায়ন

 

বাংলাদেশের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী :

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদের আর্থ—সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র—বিমোচনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সে সাথে সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক বনায়নের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। বন বিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচী বনাঞ্চলের বাইরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের বন বিভাগ ১৯৮১—৮২ সালে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) আর্থিক সহযোগীতায় উত্তরাঞ্চলের ২৩ টি জেলার জনগণকে অংশীদার করে প্রথম সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এরপর ১৯৯৫—৯৭ সালে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করে সম্প্রসারিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৯৫২০০২ সালে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সরকার ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা প্রবর্তন করে।

যা আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় সরকারী বন ভূমিতে বনায়নের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠিীর বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

 

সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব :

১। সামাজিক বনায়নের উৎপাদিত বনজ দ্রব্য: ১৯৯৯—২০০০ থেকে ২০০৫—০৬ সাল পর্যন্ত সামাজিক বনায়ন থেকে বিপুল পরিমাণ বনজ দ্রব্য আহরিত হয়। এসব বনজ দ্রব্য বিক্রয় হয়েছে ২৩৭ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭৫৫ টাকা যা দেশের অথনীতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।

২। পরিবেশ রক্ষায়: পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে সামাজিক বনায়ন ভূমিকা রাখছে।

৩। উপকুলীয় বনাঞ্চল: ১৯৬০ সাল থেকে বন বিভাগ সামুদ্রিক ঝড়—ঝঞ্চা ও জলোচ্ছাসের ক্ষতি মোকাবেলা করতে উপকুলীয় ১০ জেলার বাঁধের উপর বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১.৫১ লাখ হেক্টর ভূমি উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সমুদ্র গর্ভ থেকে পুনুরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এতে দেশের প্রায় ১% ভূমি বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪। মরুময়তারোধে বনায়ন: দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তা রোধ করার জন্য বনবিভাগ ব্যাপক বনায়ন করেছে। বনায়নের ফলে উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ার যথেষ্ট অনুকুল ও কৃষিবান্ধব হয়েছে যার ফলে এটি দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে।

৫। শিল্প বনায়ন: চট্ট্রগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও পাবর্ত্য চট্ট্রগ্রামে ১৯৯৭—৯৮ থেকে ২০০৬—০৭ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের হস্তক্ষেপে ২৪ হাজার ৪০১ হেক্টর শিল্প বনায়ন হয়েছে। এসব বনায়ন থেকে কম মূল্যে বিভিন্ন মিল কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

৬। ঔষধি বনায়ন: সামাজিক বনায়নের আওতায় বন বিভাগ স্বাস্থ্য সেবা ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে ঔষধি বনায়ন শুরু করেছে যা দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলের ৬ শত একর ভূমি নিয়ে বিস্তৃত।

 

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের সুযোগ :

সরকারী বনভূমি ব্যতীত বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচুর সুযোগ রয়েছে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ, অফিস অঙ্গন, রাস্তার ধার, পতিত জমি, কৃষি জমির আইল, সড়কের ধার, নদী ও খালের পাড়, বাঁধের পাড়, জলাশয় ও পুকুরপাড়, মসজিদের অঙ্গন, গোরস্থান, উদ্যান, বসতবাড়ির আশেপাশে, শিল্প এলাকায়, শহরের প্রধান সড়কের পাশে, গো—চারণ ভূমি, বাণিজ্যিক ভূমি, বাণিজ্যিক এলাকা, উপকূলীয় এলাকা। মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বনায়নের বিকল্প নেই। সেজন্য আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, নতুন নতুন সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে এবং বর্তমান যে বনাঞ্চল রয়েছে সেটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

সারাংশ :

মাঠ ফসল সাধারণত বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করা হয় এবং একই ধরণের জমিতে একই ফসল চাষ করা হয়। যেমন ধান, গম ইত্যাদি। উদ্যান অনেকসময় ফসল বেড়া দিয়ে স্বল্প পরিসরে চাষ করা হয় এবং একই জমিতে বিভিন্ন ফসল যেমনফুল, ফল ও শাকসবজি চাষ করা হয়। আবার কোন অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহনে সৃষ্ট বনায়নই সামাজিক বনায়ন। দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সামাজিক বনায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

 

Leave a Comment