বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ, আর কৃষির অগ্রগতি নির্ভর করে আধুনিক ও উপযোগী কৃষি উপকরণের যথাযথ ব্যবহারের উপর। কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি উপকরণের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই এসব উপকরণ ব্যবহারে নানা সমস্যা, অসচেতনতা ও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
আজকের পাঠে আমরা “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের ইউনিট ১-এর ১.৫ নম্বর পাঠ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষি উপকরণের বর্তমান ব্যবহারিক অবস্থা, এর সুবিধা-অসুবিধা, কৃষকের সচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিয়ে আলোচনা করব। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব, কীভাবে কৃষি উপকরণের কার্যকর ব্যবহার কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
Table of Contents
কৃষি উপকরণ ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা
কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশে, উপকরণ বলতে সেই সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রকে বুঝানো হয় যা কোনো বস্তু তৈরি বা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। কৃষি ক্ষেত্রে, ফসল উৎপাদনের জন্য সরাসরি যে সকল জিনিসপত্র প্রয়োজন, সেগুলোকে কৃষি উপকরণ বলা হয়। কৃষি উপকরণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
১. অবস্তুগত উপকরণ
২. বস্তুগত উপকরণ
অবস্তুগত উপকরণ হলো শ্রমিক বা মানুষ, গরু-মহিষ, এবং যান্ত্রিক শক্তি। আর বস্তুগত উপকরণ হলো বীজ, সার, পানি, ও আপদনাশক। এখানে আমরা বিশেষভাবে বস্তুগত উপকরণ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ফসল উৎপাদনের জন্য নিজেরা সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করেন। তবে উন্নত জাতের বীজ সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বি.এ.ডি.সি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বি.এ.ডি.সি তাদের বীজবর্ধন খামার থেকে বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিক্রয় করে থাকে। প্রয়োজন অনুসারে তারা বিদেশ থেকেও বীজ আমদানী করে থাকে, যদিও সরবরাহ এখনও চাহিদার তুলনায় কম।
বি.এ.ডি.সি কর্তৃক বিক্রয়কৃত বিভিন্ন বীজের পরিসংখ্যান (ছক-১) থেকে দেখা যায়, ধান (আউশ, আমন, বোরো), গম, গোল আলু, সরিষা এবং শীতকালীন শাকসবজির বীজ প্রধানত সরবরাহ করা হয়। ১৯৯২-৯৩ সালের মধ্যে আউশ ধানের বীজ বিক্রয় কিছুটা কমলেও আমন ধানের বীজ বিক্রয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, গম, গোল আলু, সরিষা ও শীতকালীন শাকসবজির বীজ বিক্রয় পূর্বের তুলনায় কম। এ থেকে ধারণা করা যায় যে কৃষকেরা নিজেদের উৎপাদিত বীজই বেশি ব্যবহার করছেন।
ছক–১: বি.এ.ডি.সি কর্তৃক বিক্রীত উন্নত বীজের পরিমাণ (১৯৯২–৯৩)
ফসলের নাম | বীজ বিক্রয়ের পরিমাণ (কেজি) | পূর্ববর্তী বছরের তুলনা |
আউশ ধান | ৫১৮,০৮৪ | কম হয়েছে |
আমন ধান | ৩,৫৯,৪৩,৪৩১ | বৃদ্ধি পেয়েছে |
বোরো ধান | ৭,৪৫,৭৪০ | বৃদ্ধি পেয়েছে |
গম | ৯৬ | কম হয়েছে |
গোল আলু | ৬৭,৫৯৬ | কম হয়েছে |
সরিষা | ৫০,২৯৬ | কম হয়েছে |
শীতকালীন শাক-সবজি | ৫১৯ | কম হয়েছে |
সার
ফসলের জমিতে আমরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করি, যেমন ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট, সুপার ফসফেট, মিউরেট অব পটাশ, জিঙ্ক সালফেট, সালফার ইত্যাদি। এসব সারের মধ্যে কিছু আমাদের দেশের কারখানায় উৎপাদিত হয়, আবার কিছু আমদানি করে আনা হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমদানির পাশাপাশি দেশে রাসায়নিক শিল্প সংস্থাগুলোও সার উৎপাদন করে থাকে।
নীচের ছক (ছক—২) থেকে দেখা যায়, ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে সারের ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে গেছে। ১৯৯০-৯১, ১৯৯১-৯২ এবং ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে মোট সারের ব্যবহার ছিল যথাক্রমে ১৯,৯৪,১৬০; ২১,২৭,০০৪; এবং ২০,৩৪,৭৯২ মেট্রিক টন।
সেচ
বাংলাদেশে মোট ফসলী জমির পরিমাণ প্রায় ১৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা হয় মোট ফসলী জমির ১৯.৪৬ শতাংশে এবং গতানুগতিক পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা হয় ৪.৪৬ শতাংশ জমিতে। বাকি ৭৬.৩% জমি এখনও সেচের আওতায় আসতে পারেনি।
যদিও বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়, তবে বৃষ্টির অসম বণ্টনের কারণে রবি মৌসুমের বিশেষ ফসল যেমন বোরো ধান, গম, গোল আলু ইত্যাদির জন্য সেচ প্রদান অপরিহার্য। সেচের আওতায় আরও বেশি জমি আনতে পারলে খাদ্য ঘাটতি অনেক কমে যাবে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে দেশে সেচের পরিমাণ ও প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছকে (ছক—৩) প্রদর্শিত হয়েছে।
আপদনাশক
ফসলকে বিভিন্ন প্রকার আপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের আপদনাশক ব্যবহার করা হয়। ফসলের শত্রু হিসেবে কাজ করে আগাছা, পোকামাকড়, রোগ জীবাণু, ইঁদুর এবং গুদামে আক্রমণকারী অন্যান্য প্রাণী। এসব ক্ষতিকারক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন ধরনের আপদনাশক ব্যবহৃত হয়, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কৃষিতে পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই, আগাছা ও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাক্রমে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও রোডেন্টিসাইড ব্যবহার করা হয়। এগুলো পাউডার, তরল এবং দানাদার আকারে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে এসব আপদনাশকের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে মোট ৭৩০৭.২২ মেট্রিক টন আপদনাশক ব্যবহৃত হয়েছিল, যা ১৯৯৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬৪০.৪৯ মেট্রিক টনে। ১৯৯৪ সালের প্রথম ছয় মাসে এককালে ৪৭৪৪.৮ মেট্রিক টন আপদনাশক ব্যবহৃত হয়েছে।
ছক–৪: বাংলাদেশে আপদনাশকের ব্যবহার (মেট্রিক টন)
বছর | ব্যবহৃত আপদনাশকের পরিমাণ (মেট্রিক টন) |
১৯৯২ | ৭৩০৭.২২ |
১৯৯৩ | ৭৬৪০.৪৯ |
১৯৯৪ (ছয় মাস) | ৪৭৪৪.৮ |