গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন

আজকের আলোচনার বিষয় গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন। কৃত্রিম প্রজনন ব্যাখ্যা করার আগে প্রথমে বুঝতে হবে প্রজনন কী? প্রজনন হলো জীবের একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জীব তার বংশ রক্ষা করে এবং একই বৈশিষ্ট্যের নতুন জীবন সৃষ্টি হয়। প্রজনন প্রধানত দুই ধরনের হয়—
১. প্রাকৃতিক উপায়ে প্রজনন
২. কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন।

এই পাঠে আমরা কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব, প্রক্রিয়া ও উপকারিতা বিস্তারিতভাবে জানব।

গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন

গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন

ডাকে আসা বা গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে সরাসরি ষাঁড় দ্বারা পাল দেওয়াকে প্রাকৃতিক প্রজনন বলা হয়। প্রাকৃতিক প্রজনন মাঠে বা ঘাটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে থাকে, আবার গাভীর মালিক নিজেও ষাঁড়ের কাছে নিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। তবে, প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে গরুর জাত উন্নত করা সম্ভব নয়।

দেশীয় বা অনুন্নত গরুকে উন্নত করতে হলে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজনন করতে হয়। কৃত্রিম প্রজননে উন্নত ষাঁড় থেকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বীর্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা ডাকে আসা বকনা বা গাভীতে প্রয়োগ করে গর্ভধারণ করানো হয়। এর ফলে বাচ্চার মধ্যে উন্নত জাতের বৈশিষ্ট্য আসে।

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বেসরকারি ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে দেশীয় গাভী বা বকনাকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য দিয়ে প্রজনন করানো হয়। এজন্য উন্নত ও মানসম্মত ষাঁড়ের নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।

 

 

ষাঁড়ের যে সমস্ত গুণাবলি থাকা দরকার তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহারের জন্য ষাঁড়ের অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলি থাকা আবশ্যক। ভাল মানের ষাঁড় থেকে উন্নত জাতের বাচ্চা পাওয়ার জন্য নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো পূরণ করা জরুরি:

১. শারীরিক স্বাস্থ্য ও শক্তিশালী: ষাঁড়কে অবশ্যই সুস্থ, সবল ও সতেজ থাকতে হবে। রোগমুক্ত এবং শরীর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।

২. রোগমুক্ত ও বংশগত সমস্যা মুক্ত: ষাঁড়কে সকল প্রকার রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বংশগত বা জেনেটিক কোনো রোগ থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. মাতার গুণগত মান: ষাঁড়ের মাতাকে অবশ্যই উন্নত জাতের এবং অধিক দুধ বা মাংস উৎপাদনক্ষম হতে হবে, যাতে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়।

৪. উর্বর শুক্রাণু: ষাঁড়ের শুক্রাণু অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে উর্বর এবং প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।

৫. উপযুক্ত বয়স: ষাঁড়ের বয়স কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বছর হতে হবে। তবে জাতভেদে বয়সের সীমা কিছুটা কমবেশি হতে পারে।

৬. আকর্ষণীয় গায়ের রঙ: ষাঁড়ের দেহ বা গায়ের রঙ পরিষ্কার ও আকর্ষণীয় হওয়া উচিত, কারণ কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদিত বাচ্চার গায়ের রঙ ষাঁড়ের মতো হয়।

৭. স্বাস্থ্যগত মধ্যম মান: ষাঁড়ের স্বাস্থ্য যদি মধ্যম মানের হয়, তা অধিকতর সুবিধাজনক।

৮. পরজীবী মুক্ত: ষাঁড়ের শরীরে কোনো পরজীবী থাকা যাবে না।

৯. শান্ত মেজাজ: ষাঁড়ের স্বভাব শান্ত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়া আবশ্যক, যাতে প্রজনন প্রক্রিয়া সহজ হয়।

ষাঁড়ের যত্ন ও ব্যবস্থাপনা

কৃত্রিম প্রজননের পূর্বে ষাঁড়কে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে হবে। ষাঁড়কে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি দেখানো যাবে না এবং তাকে ভারী বা কঠোর কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। নিয়মিত গোসল করানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক পরিবেশে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অতিরিক্ত, ষাঁড়ের প্রজনন যোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত পশুচিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করানো আবশ্যক। এভাবে ষাঁড়ের স্বাস্থ্য ও প্রজনন ক্ষমতা নিয়মিত যাচাই করলে কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বৃদ্ধি পায়।

কৃত্রিম প্রজননের ধাপসমূহ:

গরুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয় :

১। বীর্য সংগ্রহ :

গরুর কৃত্রিম প্রজননে সফলতার জন্য নির্দিষ্ট ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রধান ধাপসমূহ হলো:

(ক) প্রাকৃতিক প্রজনন পদ্ধতি:
গরুর প্রাকৃতিক প্রজননের পর বকনা বা গাভীর যোনিপথ থেকে সরাসরি বীর্য সংগ্রহ করা যায়।

(খ) মলদ্বার উত্তেজনা পদ্ধতি:
ষাঁড়ের মলদ্বার নাড়ানো হলে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা বীর্যপাত ঘটায়। এই সময় বীর্য সংগ্রহ করা হয়।

(গ) বৈদ্যুতিক উত্তেজনা পদ্ধতি:
বিশেষ বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করে ষাঁড়কে উত্তেজিত করলে বীর্যপাত ঘটে, যাকে সংগ্রহ করা যায়।

(ঘ) কৃত্রিম যোনি পদ্ধতি (Artificial Vagina):
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও কার্যকর পদ্ধতি হলো কৃত্রিম যোনি পদ্ধতি। এটি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় সহজ ও কম খরচে সম্পাদনীয়।

  • এই পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট মাপের শক্ত রাবারের নলের মধ্যে পাতলা রাবারের আরেকটি নল ঢোকানো হয়। নল দুটির সংযোগ এমনভাবে করা হয় যাতে মাঝখানে পানি ঢেলে তা বের হতে না পারে।

  • একপ্রান্তে রাবারের পাতলা টিউব এবং অপরপ্রান্তে কাঁচের টিউব সংযুক্ত করা হয়।

  • মাঝের জায়গায় গরম পানি দিয়ে কৃত্রিম যোনির তাপমাত্রা গাভীর যোনির তাপমাত্রার সমপর্যায়ে রাখা হয়।

  • একটি বিশেষ খোয়াড় বা ট্রাভিসে (যাকে ‘ডামি’ বলা হয়) একটি কাঁঠের ষাঁড় দাঁড় করানো হয়। ষাঁড় উত্তেজিত হয়ে গাভীর উপর উঠলে তার লিঙ্গ বের হয় এবং সেটি কৃত্রিম যোনির ভিতরে প্রবেশ করানো হয়।

  • উত্তেজিত ষাঁড় বীর্যপাত করে, যা রাবারের নলের মাধ্যমে কাঁচের টিউবে জমা হয়।

  • সংগ্রহকৃত বীর্য দ্রুত রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা হয়।

এই ধাপগুলি সঠিকভাবে পালন করলে উন্নত জাতের ষাঁড় থেকে উচ্চমানের বীর্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, যা কৃত্রিম প্রজননের সফলতার মূল ভিত্তি।

২। বীর্য পরীক্ষা :

ষাঁড়ের বীর্যের গুণাগুণ ও মান নির্ধারণের জন্য প্রধানত পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যা নিম্নরূপ:

(ক) বীর্যের আয়তন মাপা:
সংগৃহীত বীর্য মাপার জন্য আয়তন মাপক নলের সাহায্য নেওয়া হয়। একটি সুস্থ ষাঁড় থেকে প্রতিবার গড়ে ৫ থেকে ৮ সিসি বীর্য প্রাপ্তি হলে সেটিকে উপযুক্ত পরিমাণ ধরা হয়।

(খ) বীর্যের রঙ নিরীক্ষণ:
ভালো মানের বীর্যের রঙ সাধারণত ক্রিমের মতো ধূসর বা হালকা সাদাটে হয়। যদি বীর্যের রঙ হলুদ, লালচে, রক্তমিশ্রিত, পুঁজ-আবদ্ধ অথবা প্রস্রাবের মতো মিশ্রিত থাকে, তবে সে বীর্য ব্যবহারের জন্য অযোগ্য বলে গণ্য হয়।

(গ) বীর্যের ঘনত্ব পরিমাপ:
সুস্থ ও শক্তিশালী ষাঁড়ের বীর্যের ঘনত্ব সাধারণত ক্রিমের মতো মজবুত হয়। কিন্তু অসুস্থ বা দুর্বল ষাঁড়ের বীর্য পানির মতো পাতলা হয়ে থাকে, যা ব্যবহারযোগ্য নয়।

(ঘ) অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা:
বীর্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই একটি ফোঁটা বীর্য স্লাইডে নিয়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে শুক্রাণুর নড়াচড়ার গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই গতি ০ থেকে ৫ গ্রেডে ভাগ করা হয়। যেখানে গ্রেড ০ অর্থ শুক্রাণু একদমই নড়াচড়া করছে না, যা ব্যবহারের অনুপযোগী। গ্রেড যত বাড়বে, বীর্যের গুণমান তত ভালো হবে।

(ঙ) বীর্যের রাসায়নিক পরীক্ষা:
সংগৃহীত বীর্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে কয়েক ফোঁটা মিথাইল ব্লু মিশিয়ে ১১-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টেস্ট টিউবে পানির সাথে মিশ্রিত করা হয়। যদি টেস্ট টিউবের নীল রঙ ৩ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে হারিয়ে যায়, তবে বীর্য ভালো মানের বলে ধরা হয়। নীল রঙ দীর্ঘস্থায়ী হলে বীর্য ব্যবহারের উপযোগী নয়।

উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে ষাঁড়ের বীর্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়, যা সফল কৃত্রিম প্রজননের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

৩। বীর্য তরলীকরণ :

কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে বীর্য তরলীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, একটি মাত্র উর্বর শুক্রাণুই বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীর্যে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু থাকে এবং তা অত্যন্ত ঘন রূপে থাকে। এই ঘন বীর্য সরাসরি কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহার করলে অতিরিক্ত শুক্রাণু অপচয় হয় এবং স্বল্পসংখ্যক প্রাণীর প্রজননেই তা শেষ হয়ে যায়।

এই কারণে কৃত্রিম প্রজননে ঘন বীর্যকে একটি বিশেষ দ্রবণের সাহায্যে পাতলা বা তরল করে নেওয়া হয়, যাতে করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বীর্য দিয়ে একাধিক বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিকে বীর্য তরলীকরণ (Semen Dilution) বলা হয়।

তরলীকরণে ব্যবহৃত দ্রবণ: কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ

কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ বীর্য তরলীকরণের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর মাধ্যম। এটি বীর্যকে শুধু তরল করে না, বরং শুক্রাণুকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিও সরবরাহ করে, যার ফলে বীর্যের কার্যকারিতা বজায় থাকে।

প্রস্তুত প্রণালি:

১. প্রথমে ২–৯ গ্রাম সোডিয়াম সাইট্রেট (Sodium Citrate) ও ১০০ মিলিলিটার পাতিত পানি একসঙ্গে মিশিয়ে সাইট্রেট সলিউশন তৈরি করা হয়।

২. পরে ২ ভাগ সাইট্রেট সলিউশনের সঙ্গে ১ ভাগ ডিমের কুসুম মিশিয়ে কুসুম-সাইট্রেট দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়।

৩. এই দ্রবণের সঙ্গে সংগৃহীত বীর্য নির্ধারিত অনুপাতে মিশিয়ে যথাযথভাবে তরলীকরণ করা হয়।

এই ডাইলুয়েন্ট বা তরলকারক দ্রব্য শুক্রাণুর জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, তাদের সক্রিয়তা বজায় রাখে এবং জীবাণুমুক্ত রাখতেও সাহায্য করে। ফলে কৃত্রিম প্রজননের সাফল্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করলে কম পরিমাণ বীর্য থেকে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণীকে সফলভাবে গর্ভবতী করা সম্ভব, যা পশুসম্পদ উন্নয়নে অত্যন্ত সহায়ক।

 

৪। বীর্য সংরক্ষণ :

কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় ষাঁড়ের কাছ থেকে সংগৃহীত বীর্যকে তরলীকরণের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে গাভী বা বকনাকে প্রজনন করানো যায়। বীর্য সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো—বীর্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারের জন্য তা সহজলভ্য করে তোলা।

বীর্য সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়:

(ক) স্বল্পমেয়াদে রেফ্রিজারেটর বা বরফযুক্ত থার্মোফ্লাক্সে বীর্য সংরক্ষণ

এই পদ্ধতিতে তরলীকৃত বীর্যকে টেস্টটিউব বা ভায়ালে ভরে ৩–৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে রাখা হয়। এভাবে সংরক্ষিত বীর্যকে ২–৩ দিন পর্যন্ত কার্যকর রাখা যায়। তবে দূরবর্তী স্থানে বীর্য পরিবহনের সময় রেফ্রিজারেটরের বাইরের তাপমাত্রার প্রভাবে বীর্য দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ সমস্যা এড়াতে বরফযুক্ত থার্মোফ্লাক্স ব্যবহার করা হয়। এতে ঠান্ডা পরিবেশ বজায় রাখার ফলে বীর্য ৩ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এইভাবে সংরক্ষিত বীর্যকে তরল বীর্য (Liquid Semen) বলা হয়।

(খ) দীর্ঘমেয়াদে তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যান-এ বীর্য সংরক্ষণ

এটি হলো আধুনিক ও কার্যকর বীর্য সংরক্ষণ পদ্ধতি, যা হিমায়িত বীর্য (Frozen Semen) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে তরলীকৃত বীর্যকে বিশেষভাবে তৈরি ছোট নল বা স্ট্র-তে ভরে তরল নাইট্রোজেন ভর্তি সিমেন ক্যানের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ডুবিয়ে রাখা হয়। প্রতিটি স্ট্র-তে সাধারণত ২০–৩০ মিলিয়ন উর্বর শুক্রাণু থাকে।

তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা প্রায় –196° সেলসিয়াস, যেখানে বীর্য ২০–২৫ বছর পর্যন্ত কার্যক্ষমভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে বীর্যের কার্যক্ষমতা রক্ষার জন্য সিমেন ক্যানের ভেতরে স্ট্রগুলো সার্বক্ষণিক তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। এজন্য ক্যানের নাইট্রোজেন স্তর সবসময় ১০ সেমি বা তার বেশি রাখতে হয়।

একটি ২ লিটার ধারণক্ষমতার সিমেন ক্যান সাধারণত প্রতি ৪–৫ দিন পরপর তরল নাইট্রোজেন দিয়ে পূরণ করতে হয়, যাতে তাপমাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং বীর্যের কার্যক্ষমতা বজায় থাকে।

এইভাবে সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ করলে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানো যায় এবং কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গাভী বা বকনার জাত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

 

৫। বকনা বা গাভীতে বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বকনা বা গাভীকে গর্ভবতী করার জন্য প্রধানত দুই ধরনের বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়:

(ক) তরল বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে তরল বীর্য সংরক্ষণ করা হয় রেফ্রিজারেটর বা থার্মোফ্লাস্কে। প্রয়োগের ধাপগুলো নিম্নরূপ:

১। বীর্য সংগ্রহ: ১ মিলিলিটার তরল বীর্য নিডলের মাধ্যমে সিরিঞ্জে নেওয়া হয়।

২। এ.আই. টিউব প্রস্তুতকরণ: সিরিঞ্জে সংযুক্ত টিউবটিকে গ্লিসারিন দিয়ে পিচ্ছিল করে নেওয়া হয় যাতে এটি সহজে যোনিতে প্রবেশ করতে পারে।

৩। প্রয়োগ পদ্ধতি:
 — বাম হাতে জীবাণুমুক্ত গ্লাভস পরে, হাতটি মলদ্বার দিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে জরায়ুকে ধরতে হয়।
 — ডান হাতে সিরিঞ্জসহ টিউবটি যোনিতে প্রবেশ করাতে হয় যাতে টিউবের অগ্রভাগ বাম হাতে অনুভব করা যায় (কিন্তু তা জরায়ুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না)।

৪। বীর্য প্রয়োগ: ডান হাত দিয়ে সিরিঞ্জের পিস্টনে চাপ দিলে বীর্য জরায়ু মুখে প্রবেশ করে এবং প্রজনন সম্পন্ন হয়।

(খ) হিমায়িত বীর্য প্রয়োগ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ধাপগুলো নিম্নরূপ:

১। থয়িং (Thawing):
 — হিমায়িত বীর্য ভর্তি নল বা স্ট্র সিমেন ক্যান থেকে চিমটার সাহায্যে বের করে তা ৩৪–৩৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রিত পানিতে ৩০–৪০ সেকেন্ড ধরে গরম করতে হয়।
 — একে “থয়িং” বলা হয়। গলানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই বীর্য ব্যবহার করতে হয়।

২। এ.আই. গান প্রস্তুতকরণ:
 — বীর্য ভর্তি স্ট্র-এর কটন প্লাগ প্রান্ত নিচের দিকে রেখে তা গানের মধ্যে ঢুকাতে হয়।
 — স্ট্র-এর উন্মুক্ত বায়ুশূন্য প্রান্তটুকু সমান করে কেটে ফেলা হয় এবং তা জীবাণুমুক্ত এ.আই. সিথে ঢুকিয়ে লকিং ডিভাইস দিয়ে আটকাতে হয়।

৩। প্রয়োগ পদ্ধতি:
 — গাভী বা বকনাকে খোঁয়াড়ে আটকে রেখে যোনিপথ পরিষ্কার করতে হয়।
 — বাম হাতে গ্লাভস পরে তাতে তরল প্যারাফিন লাগিয়ে তা মলদ্বার দিয়ে ঢুকিয়ে জরায়ু ধরে রাখতে হয়।
 — ডান হাতে এ.আই. গানটি যোনিতে ঢুকিয়ে, বাম হাতে অবস্থান নিশ্চিত করে, ধীরে ধীরে পিস্টনে চাপ দিয়ে বীর্য প্রয়োগ করতে হয়।

🔶 গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:

  • ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।

  • ষাঁড় ও গাভীর পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।

  • সফল প্রজননের জন্য সঠিক তাপমাত্রা, সময় ও দক্ষতা অপরিহার্য।

 

কত্রিম প্রজনৃ নে সফলতার কারণ —

গাভী বা বকনার কৃত্রিম প্রজনন একটি সূক্ষ্ম ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণের উপর। সেগুলো হলো:

১। উর্বর ও মানসম্পন্ন ষাঁড় নির্বাচন:
কাঙ্ক্ষিত বা উন্নত জাতের সুস্থ ও উর্বর ষাঁড় থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বীর্য সংগ্রহ করা কৃত্রিম প্রজননের ভিত্তি।

২। বীর্যের গুণগতমান যাচাই:
সংগ্রহের পর ল্যাবরেটরিতে বীর্যের চলনক্ষমতা, ঘনত্ব, গুণমান ও স্বাস্থ্যগত বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়।

৩। সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ:
বীর্যকে নির্ধারিত তাপমাত্রায়, তরল নাইট্রোজেনের ট্যাংকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হয় যাতে তা কার্যকারিতা না হারায়।

৪। সাবধানতার সাথে বীর্য পরিবহন:
সংরক্ষিত বীর্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের সময় অতিরিক্ত তাপ বা কম্পন যেন বীর্যের গুণমান নষ্ট না করে তা নিশ্চিত করতে হয়।

৫। যন্ত্রপাতি ও পরিবেশ জীবাণুমুক্ত রাখা:
প্রজনন কাজে ব্যবহৃত এ.আই. গান, সিথ, গ্লাভসসহ সকল উপকরণ এবং কাজের পরিবেশ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হওয়া আবশ্যক।

৬। অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত কৃত্রিম প্রজননকারী:
যিনি কৃত্রিম প্রজনন সম্পাদন করবেন, তার অভিজ্ঞতা ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি।

৭। বকনা বা গাভীর গরম হওয়া নিশ্চিতকরণ:
প্রজননের আগে বকনা বা গাভীর হিট বা গরম হওয়ার লক্ষণ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হতে হয়।

৮। সঠিক সময়ে প্রজনন:
গরম হওয়ার ১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রজনন করানো হলে সর্বোচ্চ সফলতা পাওয়া যায়।

৯। অনিয়মিত গরম হওয়া গাভীর চিকিৎসা:
যেসব গাভী অনিয়মিত বা দেরিতে গরম হয়, তাদের পশুচিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা করে উপযুক্ত করে তুলতে হয়।

১০। প্রজননের আগে ও পরে বিশ্রামের ব্যবস্থা:
বকনা বা গাভীর ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ না দিয়ে যথাযথ বিশ্রাম দেওয়া দরকার, যাতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে।

১১। যৌনাঙ্গে সংক্রমণমুক্ত থাকা:
যোনি বা জরায়ু সংক্রান্ত কোনো সংক্রমণ বা যৌন রোগ থাকলে কৃত্রিম প্রজননের সফলতা ব্যাহত হয়, তাই পূর্বেই তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হয়।

কৃত্রিম প্রজননে ব্যার্থতার কারণ —

যথাযথভাবে পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ না করলে কৃত্রিম প্রজনন ব্যর্থ হতে পারে। ফলে কাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ঘটে না এবং গবাদি পশু থেকে আশানুরূপ উৎপাদন মেলে না। নিচে কৃত্রিম প্রজননে ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণগুলো তুলে ধরা হলো:

১। রোগাক্রান্ত, দুর্বল বা অনুর্বর ষাঁড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করা:
এমন ষাঁড়ের বীর্যে যথেষ্ট পরিমাণে চলনক্ষম ও স্বাস্থ্যবান শুক্রাণু না থাকায় গর্ভধারণে ব্যর্থতা ঘটে।

২। বীর্যের গুণগতমান যাচাই না করা:
বীর্য সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা না করলে, দূষিত বা কম উর্বর বীর্য ব্যবহৃত হয়ে প্রজননে ব্যর্থতা ঘটতে পারে।

৩। সঠিকভাবে বীর্য সংরক্ষণ না করা:
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বা তরল নাইট্রোজেন যথেষ্ট না থাকলে বীর্যের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।

৪। বীর্য পরিবহনে সতর্কতার অভাব:
কম্পন, অতিরিক্ত উত্তাপ বা সময়সীমা অতিক্রম করলে বীর্যের গুণমান নষ্ট হয়ে যায়।

৫। সিমেন ক্যানের নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া:
তরল নাইট্রোজেন পর্যাপ্ত না থাকলে বীর্য হিমায়িত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়।

৬। সঠিকভাবে স্ট্র থয়িং না করা:
স্ট্র (বীর্য ভর্তি নল) নির্ধারিত সময় ও তাপমাত্রায় গরম না করলে শুক্রাণুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়।

৭। প্রজনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না রাখা:
দূষিত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, যা গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করে।

৮। অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ প্রজননকারী:
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে শুক্রাণু ভুল স্থানে প্রবেশ করে অথবা প্রজনন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।

৯। বকনা বা গাভীর গরম হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া:
গরম না হওয়া অবস্থায় বীর্য প্রয়োগ করলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

১০। সঠিক সময়ে প্রজনন না করা (১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে):
প্রজননের নির্দিষ্ট সময়সীমা না মানলে শুক্রাণু নিষিক্ত হতে পারে না।

১১। ভুল স্থানে শুক্রাণু স্থাপন করা:
জরায়ুর পরিবর্তে যোনিতে বা অন্যত্র শুক্রাণু পড়লে গর্ভধারণ ব্যর্থ হয়।

১২। অনিয়মিত গরম হওয়া বকনা বা গাভীকে চিকিৎসা না করেই প্রজনন করানো:
হরমোনজনিত বা শারীরিক সমস্যার কারণে সফলতা নাও আসতে পারে।

১৩। প্রজননের আগে ও পরে পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব:
অতিরিক্ত চলাফেরা বা মানসিক চাপ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

১৪। যৌনাঙ্গে সংক্রমণ বা যৌন রোগের উপস্থিতি:
এসব সমস্যা থাকলে জরায়ুতে শুক্রাণুর জীবনচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গর্ভসঞ্চার সম্ভব হয় না।

বকনা বা গাভীর গরম হওয়া বা ডাকে আসার বাহ্যিক লক্ষণসমূহ —

বকনা বা গাভী গরমে আসলে (Heat বা Estrus) তার প্রজনন সক্ষমতা অর্জন করে এবং এ সময় প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য গাভীর গরম হওয়া শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে গরম হওয়া বা ডাকে আসার সাধারণ ও লক্ষণীয় বাহ্যিক চিহ্নসমূহ তুলে ধরা হলো:

১। অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ও ঘন ঘন ডাকাডাকি করা:
গাভী সাধারণত শান্ত প্রকৃতির হলেও গরমে এলে অস্থির আচরণ করে এবং বারবার ডাকতে থাকে।

২। এক জায়গায় স্থির হয়ে না দাঁড়িয়ে ছটফট করতে থাকা:
সে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে থাকে এবং আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।

৩। লেজ বারবার নাড়া ও উঁচু করে রাখা:
প্রায়ই লেজ তুলে রাখে এবং পেছনের অংশ ঘন ঘন নাড়ে, যা যৌন উত্তেজনার লক্ষণ।

৪। ঘন ঘন অল্প পরিমাণ প্রস্রাব করা:
প্রস্রাবের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়, তবে পরিমাণে খুব কম থাকে।

৫। ক্ষুধা কমে যাওয়া বা খেতে না চাওয়া:
সাধারণ খাদ্যে আগ্রহ হারায় এবং খাওয়া কমিয়ে দেয়।

৬। যোনিদ্বার ফুলে যাওয়া ও লালচে দেখানো:
প্রজনন অঙ্গ ফুলে ওঠে এবং তাতে লালচে ভাব দেখা যায়।

৭। যোনিদ্বার থেকে স্বচ্ছ, জেলির মতো শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া:
এই শ্লেষ্মা লেজের গোড়া এবং যোনির চারপাশে লেগে থাকতে দেখা যায়, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

৮। অন্য গরুর উপর লাফিয়ে ওঠা ও নিজে লাফিয়ে উঠতে দেওয়া:
গরমে আসা গাভী সাধারণত অন্য গরুর উপরে লাফানোর চেষ্টা করে এবং অন্য গরুকে নিজের উপরে উঠতে দেয়। অনেক সময় নিজের পেছনে অন্য গরুকে চাটতেও দেয়।

৯। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া:
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে একটু বেশি অনুভূত হয়।

১০। দুধের পরিমাণ হঠাৎ কমে যাওয়া (দুধালো গাভীর ক্ষেত্রে):
গাভীর গরমে আসার সময়ে দুধ উৎপাদন কিছুটা কমে যেতে পারে।

✅ এসব লক্ষণগুলো গাভী বা বকনার গরম হওয়া নিশ্চিত করতে সহায়ক। সঠিক সময়ে (সাধারণত গরম হওয়ার ১২–১৮ ঘণ্টার মধ্যে) কৃত্রিম প্রজনন করালে গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

 

কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা :

কৃত্রিম প্রজনন আধুনিক প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে প্রাণির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জাত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। নিচে কৃত্রিম প্রজননের প্রধান সুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো:

১। দেশীয় অনুন্নত জাতের প্রাণির উন্নয়ন সম্ভব:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে দেশীয় গরুর গুণগত মান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়।

২। একটি ষাঁড়ের বীর্যে বহু প্রাণিকে প্রজনন করানো সম্ভব:
একবার সংগৃহীত বীর্য থেকে প্রায় ১০০ থেকে ৪০০টি বকনা বা গাভীকে প্রজনন করানো যায়, যা ব্যয় ও সময় সাশ্রয় করে।

৩। উন্নত বা কাঙ্ক্ষিত ষাঁড়ের বীর্য সহজে ব্যবহারযোগ্য:
দূরবর্তী বা বিদেশি উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্যও সহজে সংগ্রহ ও প্রয়োগ করা যায়।

৪। দীর্ঘমেয়াদে বীর্য সংরক্ষণ:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য হিমায়িত অবস্থায় বহুদিন সংরক্ষণ করে পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করা যায়।

৫। সঙ্গমে অক্ষম হলেও ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার সম্ভব:
শারীরিকভাবে সঙ্গমে অক্ষম বা বয়স্ক ষাঁড় থেকেও কার্যকর বীর্য নিয়ে তা কৃত্রিমভাবে ব্যবহার করা যায়।

৬। উচ্চ হারে গর্ভধারণ সম্ভব:
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে বকনা বা গাভীর গর্ভধারণের হার তুলনামূলক বেশি হয়।

৭। বহু দূরের অঞ্চলেও প্রজনন করানো যায়:
কাঙ্ক্ষিত ষাঁড়ের বীর্য দেশের যেকোনো স্থানেই পৌঁছে দিয়ে প্রজনন করানো যায়, এমনকি দেশের বাইরেও।

৮। প্রাকৃতিক প্রজনন অপছন্দকারী প্রাণির জন্য উপযোগী:
অনেক সময় কিছু গাভী বা বকনা ষাঁড়ের সংস্পর্শে যেতে চায় না বা শুয়ে পড়ে না—তাদের ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন একটি কার্যকর সমাধান।

৯। হাইব্রিড বা সংকর জাত তৈরির সুযোগ:
ভিন্ন ভিন্ন জাতের প্রাণির মধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সংকর জাত বা হাইব্রিড তৈরি করে অধিক উৎপাদনশীল ও টেকসই প্রজাতি সৃষ্টি করা যায়।

১০। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ:
বীর্য ও যোনি পরীক্ষা করে প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন রোগ বা সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।

 

কৃত্রিম প্রজননের অসুবিধা :

যদিও কৃত্রিম প্রজনন গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকর একটি আধুনিক প্রযুক্তি, তবুও এ পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিচে কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো:

১। দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রজননকারীর প্রয়োজনীয়তা:
এ পদ্ধতি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রজননকারী দরকার হয়। অদক্ষ ব্যক্তির দ্বারা কার্য সম্পন্ন হলে তা ব্যর্থতার ঝুঁকি তৈরি করে।

২। বিশেষায়িত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন:
বীর্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের জন্য নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি যেমন—এ.আই. গান, থার্মোফ্লাক্স, স্ট্র থয়িং ডিভাইস ইত্যাদি অপরিহার্য। এগুলো ব্যয়বহুল এবং সবসময় সহজলভ্য হয় না।

৩। ত্রুটিযুক্ত বীর্য ব্যবহারে ব্যর্থতা:
নষ্ট বা নিম্নমানের বীর্য ব্যবহার করলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

৪। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে সফলতা কমে:
প্রজননের সময় ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ, বীর্য ভুল স্থানে প্রয়োগ ইত্যাদি সমস্যায় গর্ভধারণের হার অনেক কমে যায়।

৫। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্যের অভাব:
কাঙ্ক্ষিত গুণসম্পন্ন উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য সহজে পাওয়া না গেলে প্রজননের উদ্দেশ্য সফল হয় না।

৬। বীর্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জটিলতা:
নির্ধারিত তাপমাত্রায় এবং নিরাপদভাবে বীর্য সংরক্ষণ না করলে তা অকেজো হয়ে যেতে পারে।

৭। নীরব গরম (Silent Heat) শনাক্তে সমস্যা:
অনেক বকনা বা গাভী গরম হলেও তা বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় না। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রজনন না করানো গেলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

৮। সঠিক সময়ে প্রজনন করাতে ব্যর্থ হওয়া:
গরমের সঠিক সময় জানার ঘাটতি থাকলে বীর্য প্রয়োগ ব্যর্থ হয় এবং চক্র আবার পুনরায় অপেক্ষা করতে হয়।

৯। প্রজননকারীর অদক্ষতা:
যন্ত্রপাতি ব্যবহার বা পশুর আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে অদক্ষতা থাকলে সঠিকভাবে প্রজনন সম্ভব হয় না।

১০। প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়ার প্রভাব:
অতিরিক্ত গরম, ঠান্ডা বা বর্ষাকালে তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার, বীর্য সংরক্ষণ ও পরিবহণ জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব :

কৃত্রিম প্রজনন হলো আধুনিক কৃষি ও পশুপালন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যা গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এর গুরুত্বগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:

১। অনুন্নত গরুর জাতকে উন্নত জাতের সঙ্গে রূপান্তরিত করা যায়:
দেশীয় বা নিম্নমানের গবাদি পশুকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।

২। উন্নত জাতের কারণে দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণে সহায়ক:
উন্নত জাতের গবাদি পশুর মাধ্যমে দেশের দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।

৩। গবাদি পশুর প্রজনন সংকট প্রতিরোধে কার্যকর:
প্রজনন সমস্যা থাকলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দ্রুত ও নিয়ন্ত্রিত প্রজনন সম্ভব হয়।

৪। গাভী বা বকনার গর্ভধারণের হার বৃদ্ধি পায়:
সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে বীর্য প্রয়োগের ফলে গর্ভধারণের সফলতার হার বেড়ে যায়।

৫। কাঙ্খিত জাতের হাইব্রিড বা সংকর বাচ্চা উৎপাদন:
বীর্যের নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চমানের সংকর জাতের বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব, যা অধিক ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধক।

৬। গবাদি পশুর যৌন রোগ প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে সরাসরি ষাঁড়ের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকায় যৌন রোগের সংক্রমণ কমে।

৭। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি:
এ কার্যক্রমে প্রশিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা থাকায় অনেক বেকার ব্যক্তি কর্মসংস্থান পায়।

৮। একটি ষাঁড় থেকে ব্যাপক সংখ্যক গাভী বা বকনাকে প্রজনন করানো সম্ভব:
বছরে একটি উন্নত ষাঁড়ের বীর্য ব্যবহার করে প্রায় ১০,০০০ টি গাভী বা বকনাকে গর্ভবতী করা যায়, যা প্রজনন খরচ ও সময় বাঁচায়।

৯। গ্রামাঞ্চলে উন্নত জাতের ষাঁড় পালনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়:
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীর্য সরবরাহে গৃহ পর্যায়ে উন্নত জাতের পশু পালন সহজ হয়।

১০। বীর্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘস্থায়িত্ব:
উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীর্য হিমায়িত অবস্থায় সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব, যা প্রজনন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।

কৃত্রিম প্রজনন দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এর সুফল নিশ্চিত করা গেলে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের গড় উন্নত হবে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে।

Leave a Comment