গবাদিপশুর দুধ উৎপাদন, প্রজনন ও শারীরিক সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে সুষম খাদ্যের উপর। গাভীর খাদ্য সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত —
১️⃣ আয়তনীয় খাদ্য (Roughage) — যেমন খড়, ঘাস, ন্যাপিয়ার, ভুসি ইত্যাদি।
২️⃣ দানাদার খাদ্য (Concentrate Feed) — যেসব খাদ্যে আয়তনের তুলনায় খাদ্যমান বেশি এবং সহজপাচ্য।
দানাদার খাদ্য গাভীর শক্তি, প্রোটিন, খনিজ ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করে এবং দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
Table of Contents
পাঠের উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি শিখতে পারবেন —
– গাভীর জন্য উপযুক্ত দানাদার খাদ্য উপকরণ নির্বাচন করতে।
– আনুপাতিক হারে খাদ্য উপকরণ মিশিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য তৈরি করতে।
– গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি ও শরীরের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে কার্যকর খাদ্যতালিকা প্রণয়ন করতে।
গাভীর দানাদার খাদ্য প্রস্তুত করা
দানাদার খাদ্যের সংজ্ঞা
যেসব খাদ্যদ্রব্যে প্রতি একক ওজনের তুলনায় অধিক পুষ্টিমান থাকে এবং সহজে হজমযোগ্য হয়, সেগুলোকে দানাদার খাদ্য বলা হয়।
এই ধরনের খাদ্য সাধারণত শস্য, ভুসি, খৈল, শস্যের উপজাত, শুকনো মাছের গুঁড়া ইত্যাদি থেকে প্রস্তুত করা হয়।

সাধারণ দানাদার খাদ্য উপকরণসমূহ:
গাভীর দানাদার খাদ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত উপকরণগুলো ব্যবহার করা হয়:
- চালের কুঁড়া
- গমের ভুসি
- ভুট্টা গুঁড়া
- কলাই, ছোলা, খেসারি
- সয়াবিন খৈল
- সরিষার খৈল
- তিল খৈল
- শুকনো মাছের গুঁড়া
- খনিজ লবণ
- ভিটামিন প্রিমিক্স
আমিষ (Protein) উপাদানের ভিত্তিতে দানাদার খাদ্যের শ্রেণিবিন্যাস
| শ্রেণি | খাদ্যের ধরন | উদাহরণ | আনুমানিক আমিষের পরিমাণ |
|---|---|---|---|
| ক | কম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য | কুঁড়া, ভুসি | ৫–১৫% |
| খ | মধ্যম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য | খৈল, কলাই, ছোলা | ২০–২৫% |
| গ | উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য | শুকনো মাছের গুঁড়া, রক্তের গুঁড়া, মাংসের কণা | ৩৫–৪৫% |
গাভীর খাদ্য উপকরণের পরিমাণ নির্ভর করে:
গাভীর ওজন ও বয়স,
দৈনিক দুধ উৎপাদনের পরিমাণ,
দুধের চর্বির মাত্রা,
এবং পালন পদ্ধতির ধরন (স্থানীয়/ক্রস জাত, স্থায়ী/চারণ)।
সাধারণভাবে, একটি প্রাপ্তবয়স্ক দুধদায়ী গাভীর জন্য দৈনিক দানাদার খাদ্যের পরিমাণ হয় — দুধ উৎপাদনের প্রতি লিটার দুধের জন্য প্রায় ৪০০–৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য।
দুগ্ধবতী গাভীর পুষ্টি চাহিদা এবং খাদ্য উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক পাঠ ৫.৩–এ। এখানে সেই তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে একটি ব্যবহারিক দানাদার খাদ্য প্রস্তুতির প্রক্রিয়া দেখানো হলো।
দুগ্ধবতী গাভীর জন্য ১০ কেজি দানাদার খাদ্য প্রস্তুতের প্রণালী
প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ (উদাহরণ)
| ক্র. | উপকরণের নাম | পরিমাণ (কেজি) | মন্তব্য |
|---|---|---|---|
| ১ | চালের কুঁড়া | ৪.০ | শক্তি সরবরাহ করে |
| ২ | গমের ভুসি | ২.৫ | আঁশ ও খনিজ উপাদান দেয় |
| ৩ | সরিষার খৈল | ২.০ | প্রোটিন সরবরাহ করে |
| ৪ | শুকনো মাছের গুঁড়া | ০.৫ | প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস |
| ৫ | খনিজ মিশ্রণ | ০.২৫ | হাড় ও দুধের জন্য প্রয়োজনীয় |
| ৬ | খাদ্য লবণ | ০.২৫ | ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স রক্ষা করে |
| মোট | ১০.০ কেজি |
সারণি ২৪ : দুগ্ধবতী গাভীর দানাদার -খাদ্যের উপকরণসম হের পরিমাণ

প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি
- পরিষ্কার মেঝে বা মিক্সিং ট্রে
- এক বা একাধিক পরিষ্কার পাত্র
- ছালা বা মোটা বস্তা
- ওজন মাপার যন্ত্র
- কলম, পেন্সিল ও ব্যবহারিক খাতা
খাদ্য প্রস্তুতের ধাপসমূহ
১️⃣ পরিষ্কার স্থান নির্বাচন করুন
খাদ্য মেশানোর জন্য শুকনো ও পরিষ্কার মেঝে ব্যবহার করুন। ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় মিশ্রণ করা যাবে না।
২️⃣ কম পরিমাণ উপকরণ আগে মেশান
খাদ্য লবণ ও খনিজ পদার্থগুলো প্রথমে একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৩️⃣ ক্রম অনুযায়ী উপকরণ মেশান
এরপর কুঁড়া, ভুসি, খৈল, মাছের গুঁড়া ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে একত্রে মেশান এবং শেষে পূর্বে মিশ্রিত খনিজ–লবণ মিশ্রণ যোগ করুন।
৪️⃣ ভালোভাবে নেড়ে একরূপ করুন
সব উপকরণ একসাথে সমানভাবে মেশানো পর্যন্ত নেড়ে বা উল্টে দিন।
৫️⃣ সংরক্ষণ করুন
মিশ্রণ সম্পন্ন হলে ছালা বা বস্তায় ভরে শুকনো, বাতাস চলাচলযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করুন।
৬️⃣ ব্যবহার নির্দেশনা
প্রয়োজনে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে দুধ দোহনের পর গাভীকে খেতে দিন।
সাবধানতা ও সতর্কতা
- ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে বা অপরিচ্ছন্ন স্থানে খাদ্য মিশ্রণ করবেন না।
- খাদ্য উপকরণ ব্যবহারের আগে গন্ধ, রঙ ও ছত্রাকের উপস্থিতি পরীক্ষা করুন।
- ছত্রাকযুক্ত বা পচা খাদ্য কখনো ব্যবহার করবেন না, এতে গাভীর দুধে বিষক্রিয়া হতে পারে।
- দানাদার খাদ্যের সাথে পর্যাপ্ত পানি ও আয়তনীয় খাদ্য (ঘাস বা খড়) অবশ্যই সরবরাহ করুন।
- তৈরি খাদ্য ১৫–২০ দিনের মধ্যে ব্যবহার করা উত্তম; পুরনো খাদ্য এড়িয়ে চলুন।
অতিরিক্ত টিপস (Best Practices)
- খাদ্যে ভিটামিন প্রিমিক্স যুক্ত করলে দুধের মান বৃদ্ধি পায়।
- স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন উপকরণ (যেমন- ডাল, সরিষা খৈল, খেসারি) ব্যবহার করলে ব্যয় কমে।
- চারণভূমি থাকলে গাভীর দৈনিক দানাদার খাদ্যের পরিমাণ কিছুটা কমানো যায়।
- খাদ্য মিশ্রণ তৈরির পর একবার পুষ্টি বিশ্লেষণ (Proximate Analysis) করানো উত্তম, যাতে খাদ্যের মান নিশ্চিত করা যায়।
গাভীর দানাদার খাদ্য হলো দুধ উৎপাদনের মেরুদণ্ডস্বরূপ। যত্নসহকারে উপকরণ বাছাই ও সঠিক অনুপাতে মিশ্রণ করলে দুধের পরিমাণ ও গুণমান দুটোই বৃদ্ধি পায়। একটি সুষম দানাদার খাদ্য গাভীর স্বাস্থ্য, প্রজনন ও অর্থনৈতিক উৎপাদন সক্ষমতা বজায় রাখে।
