গাভী পালন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গাভী পালন – যা কৃষিজ উৎপাদন: গৃহপালিত পশুপাখি পালন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত।

দুগ্ধ শিল্প

প্রাণীসম্পদ তথা কৃষির বিকাশ ও অগ্রগতির সঙ্গে গাড়ী পালন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এদেশে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, কোন জাতির মেধার বিকাশ মূলত সে জাতি কতটুকু দুধ পান করে তার ওপর নির্ভর করে। আর তাই দেখা যায় বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশেই দুগ্ধ শিল্প বা ডেয়রি ইন্ডাস্ট্রি একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা অনেকটাই পিছিয়ে।

এদেশে প্রতিবছর দুধের চাহিদা ১২.৫২ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২.২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অবশ্য বর্তমানে এদেশের অনেকেই দুধ উৎপাদনের জন্য গাভীর খামার গড়তে আগ্রহী হচ্ছেন।

আর তাই দেশে প্রায় ৪৮,০০০টি খামার গড়ে উঠেছে। তবে এসব খামারের বেশিরভাগ ছোট ও মাঝারি আকারের। তবে পরিকল্পিতভাবে দুগ্ধ খামার গড়ে খামার ব্যবস্থাপনার খুটিনাটি বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলে খামারিরা সহজেই গাভী পালন করে দেশকে উন্নতমানের তরল আমিষ সরবরাহের পাশাপাশি দেশের মানুষের মেধা বিকাশ ও নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন। আর দেশের কৃষি অর্থনীতিও হবে সমৃদ্ধ ।

 

গাভী পালন

 

গাভী পালন

 

খামার গড়তে প্রাথমিক প্রস্তুতি

লাভজনক গাভী অর্থাৎ দুগ্ধ খামার গড়তে হলে সবার আগে প্রয়োজন প্রাথমিক প্রস্তুতি। আর এই প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে খামারের সফলতা বা ব্যার্থতা। দুগ্ধ খামারের সফলতা নির্ভর করে খামারির আর্থিক সঙ্গতি, অভিজ্ঞতা, উন্নত জাতের পাতা, নিরাপদ বাসস্থান ও সুষম খাদ্য সরবরাহের ওপর।

শুরুতেই বিশাল আকারের খামারের কথা চিন্তা না করে ছোট আঙ্গিকে খামার গড়ার পরিকল্পনা করা উচিত। তাই ৫-৬টি গাড়ী নিয়ে যাত্রা করে ধীরে ধীরে খামার সম্প্রসারণ করাই উত্তম। দু’টি গাভীর পালনের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন করে দক্ষ লোক নিয়োগ দেয়া উচিত।

গাভীর খামারের স্থান নির্বাচন

পাতীর খামার এমন জায়গায় নির্মাণ করতে হবে যেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ও দুধ বিক্রির যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে । খামারের চারপাশে উঁচু দেয়াল, পরিবেশসম্মত আবাসন, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং গাভীর বিশ্রাম ও হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে । স্থান নির্বাচন ও বাসস্থান নির্মাণ হয়ে গেলে উন্নত জাতের গাভী নির্বাচন ও ক্রয় করতে হবে।

উন্নত জাতের গাভী

দুগ্ধ খামার থেকে ভালো উৎপাদন পেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে উন্নত জাতের গাভী। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত জাতের গাভী, যেমন:- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি, আয়ারশায়ার, মিল্কিং শর্টহন ইত্যাদি থেকে যেখানে দৈনিক ৩০-৫০ লিটার দুধ পাওয়া যায়, সেখানে আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের গাভী থেকে মাত্র ১-৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

তবে শীতপ্রধান দেশের উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল গাভীগুলো এদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় তেমনভাবে টিকতে পারে না। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ইতোপূর্বে আনা সিন্ধি ও শাহীওয়াল ৭-১০ লিটারের বেশি দুধ দেয় না। আমাদের দেশের স্থানীয় জাত রেড চিটাগাং, পাবনা ও সাদা সিন্ধি অনুল্লেখিত জাতসমূহের থেকে বেশি উৎপাদন দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

কাজেই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী জাতের গাভীকে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি, শাহিওয়াল, সিদ্ধি প্রভৃতি জাতের ঘাড়ের বীর্য দিয়ে প্রজনন করালে যে সংকর জাতের সৃষ্টি হয় তা একদিকে যেমন অধিক দুধ উৎপাদনশীল হয়, অন্যদিকে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্নও হয়। তবে এ সংকর জাতগুলোর মধ্যে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের সংকরই সবচেয়ে ভালো।

উন্নত ব্যবস্থানায় একটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের গাভী থেকে ১৫-৩৫ লিটার দুধ পাওয়া সম্ভব। কাজেই লাভজনক গাভী খামার গড়তে হলে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের গাভী দিয়েই শুরু করা উচিত।

উন্নত জাতের গাভীর প্রাপ্তিস্থান

ঢাকা সদর, সাভার ও কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, পাবনার বাঘাবাড়ি, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ইত্যাদি এলাকায় উন্নত জাতের গাভী বেশি দেখা যায় ।

 

গাভী পালন

 

উন্নত জাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য

উন্নত জাতের গাভীর মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে । যেমন:-

  • মাথার আকার ছোট ও হালকা, কপাল প্রশস্ত ও চোখ হবে উজ্জ্বল ।
  • দৈহিক আকার আকর্ষণীয় ও দেহের গঠন ঢিলেঢালা হবে। দেহের সামনের দিক হালকা, পিছনের দিক ভারী ও সুগঠিত হবে।
  • পাজরের হাড় স্পষ্ট ও হাড়ের গঠন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে ।
  •  চামড়া পাতলা, চামড়ার নীচে অযাচিত চর্বি থাকবে না। চাড়ার রঙ উজ্জ্বল, লোম মসৃণ ও চকচকে হবে।
  • ওলান বড়, সুগঠিত ও দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। গুলানের বাটগুলো একই আকারের হবে এবং চারটি বাট সমান দূরত্বে থাকবে ও সমান্তরাল হবে ।
  • দুগ্ধশিরা মোটা ও স্পষ্ট হবে। তলপেটে নাভীর পাশ দিয়ে দুগ্ধশিরা আঁকাবাঁকাভাবে বিস্তৃত থাকবে ।

গাভীর পরিচর্যা

গাভীর পরিচর্যার লক্ষ্য হলো গাভীকে অধিক কর্মক্ষম রাখা। গাভীর সঠিক পরিচর্য্য না হলে উন্নত জাতের গাভী পালন করেও গাভীকে সুস্থ-সবল ও উৎপাদনক্ষম রাখা যাবে না। ফলে গাড়ী থেকে কাঙ্খিত পরিমাণে দুধ পাওয়া যাবে না। এতে খামারি লোকসানে মুখে পড়বেন ।

কাজেই গাভীকে নিয়মিত গোসল করানো, শিং কাটা, খুর কাটা ইত্যাদির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া গাভীকে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ, যেমন:- মশা-মাছি থেকে নিরাপদ রাখতে করে। এসব পরিচর্যায় গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ও উৎপাদনে ভালো প্রভাব পড়বে।

গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর যত্ন

গর্ভকালীন সময়ে গাভীর দিকে বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত কারণ এই সময় গাভীর গর্ভে বাচ্চা বড় হতে থাকে । এসময় গাভীকে প্রচুর পরিমাণে দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রসবের কয়েক দিন আগে থেকে প্রসবকালীন সময় পর্যন্ত গাভীকে আলাদা জায়গায় রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জায়গাটি সমতল হতে হবে। গর্ভকালীণ সময়ে অবহেলা করলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

তাছাড়া গাভী প্রজনন ও গর্ভধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। প্রসবের লক্ষণ দেখা দিলেই গাভীকে শান্ত পরিবেশে রেখে ২-৩ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রসব অগ্রসর না হলে প্রাণী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রসবের পর বাছুরকে অবশ্যই শালদুধ পান করাতে হবে। কারণ এই শালদুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও বাছুরকে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।

বাচ্চা প্রসবের পর ফুল পড়ে গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। গাভী বাচ্চা প্রসবের পর ৫-৭ দিন পর্যন্ত শালদুধ দেয়। এর পরে স্বাভাবিক দুধ পাওয়া যায়। বাচ্চা প্রসবের ৯০ দিনের মধ্যে গাভী পুনরায় গরম না হলে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত ।

দুগ্ধ দোহনকালীন পরিচর্যা

দৈনিক ভোরে একবার ও বিকালে একবার নির্দিষ্ট সময়ে গাভীর দুধ দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের আগে গাভীর ওলান ও দোহনকারীর হাত পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুতে হবে। দোহনকালীন সময় গাভীকে উত্তেজিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে ও দ্রুততার সঙ্গে দুধ দোহন সম্পন্ন করতে হবে।

গাভীর খাদ্য

গাভীর দৈহিক বৃদ্ধি এবং কোষকলার ক্ষয়পূরণ ও বিকাশ, তাপ ও শক্তি উৎপাদন, দুধ উৎপাদন, প্রজননে সক্ষমতা অর্জন, গর্ভাবস্থায় বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধিসাধন ইত্যাদির জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য পরিবেশনে শর্করা, আমিষ ও স্নেহপদার্থের প্রতুলতার দিকে নজর দিতে হবে। গাভীর সুষম খাদ্যতালিকার উদাহরণ সারণি ১২-১৪-এ দেয়া হয়েছে।

গাতীয় স্বাস্থ্যসম্মত লালন-পালন ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা

গাভীর স্বাস্থ্যসম্মত লালন-পালন বলতে এমন কতগুলো বিধি ব্যবস্থাকে বোঝায় যা মেনে চললে গাভীকে রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে অধিক দুধ উৎপাদন করা যায়। এগুলো নিম্নরূপ:-

  • পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থাসহ দূর্যোগ নিবারণের সুবিধাসম্পন্ন বাসস্থান নির্মাণ করা।
  • খাদ্য ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
  • পচা-বাসি ও ময়লাযুক্ত খাদ্য ও পানি পরিহার করা।
  • সব সময় তাজা ও বিশুদ্ধ খাবার ও পানি সরবরাহ করা।
  • নিয়মিত কৃমিনাশকের ব্যবহার করা। নিজমিত সংক্রামক ব্যাধির টিকা প্রদান করা।
  • দ্রুত মলমূত্র নিষ্কাশন করা।
  • প্রজনন ও প্রসবে নির্জীবাণু পদ্ধতি অবলম্বণ করা।

 

সারসংক্ষেপ

প্রাণীসম্পদ তথা কৃষির বিকাশ ও অগ্রগতির সঙ্গে গাড়ী পালন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। দুগ্ধ খামার থেকে ভালো উৎপাদন পেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে উন্নত জাতের গাভী। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত জাতের গাভী, যেমন:- হলস্টেইন- ফ্রিজিয়ান, জার্সি, আয়ারশায়ার, মিল্কিং শর্তহন ইত্যাদি থেকে যেখানে দৈনিক ৩০-৫০ লিটার দুধ পাওয়া যায়, সেখানে আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের গাভী থেকে মাত্র ১-৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

তবে শীতপ্রধান দেশের উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল গাভীগুলো এদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় তেমনভাবে টিকতে পারে না। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ইতোপূর্বে আনা সিন্ধি ও শাহীওয়ান ৭-১০ লিটারের বেশি দুধ দেয় না। গাভীকে নিয়মিত গোসল করানো, শিং কাটা, খুর কাটা ইত্যাদির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দৈনিক ভোরে একবার ও বিকালে একবার নির্দিষ্ট সময়ে। গাভীর দুধ দোহন করতে হবে।

 

Leave a Comment