গোলাপ ফুল চাষ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গোলাপ ফুল চাষ – যা কৃষিজ উৎপাদন: সবজি, ফুল, ফল চাষ এর অন্তর্ভুক্ত ।

গোলাপ ফুল চাষ

 

গোলাপ ফুল চাষ

 

ভূমিকা

ফুল বা সুদৃশ্য গাছপালা উৎপাদনের জ্ঞান ফ্লোরিকালচার বা পুষ্পোদ্যান বিদ্যা নামে পরিচিত। ফুল মানসিক আনন্দ দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । কতগুলো ফুলের সৌন্দর্য মানুষ আকৃষ্ট করে। আবার কতগুলো ফুলের গন্ধ খুবই মনোমুগ্ধকর । ফুল গৃহ স্কুল কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শোভা বর্ধনের জন্য খুবই প্রয়োজন। ফুল শুধু মানুষের মনতুষ্টির জন্যও নয় এর অর্থনৈতিক অবদান অপরিসীম।

বর্তমানে বাংলাদেশে ফুল ও সুদৃশ্য গাছ বাণিজ্যিক উৎপাদন বিশেষ ভাবে গোলাপ চোখে পড়ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সুগন্ধি প্রস্তুতি ফুলের নির্যাস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গোলাপ ফুলকে ফুলের রাণী বলা হয়ে থাকে। এর কোমলতা, বর্ণ, সুগন্ধ এমন কেউ নেই যাকে আকৃষ্ট করে না। সাজ সজ্জায় কাটা ফুল হিসেবে কদর রয়েছে। এছাড়া সুগন্ধি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।

জাত : পৃথিবী জুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো। জাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গোলাপ সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপী এবং মিক্স রঙের হয়ে থাকে। এছাড়াও রানী এলিজাবেথ (গোলাপী), ব্ল্যাক প্রিন্স (কালো), ইরানি (গোলাপী), মিরিন্ডা (লাল), দুই রঙা ফুল আইক্যাচার চাষ করা হয়। যাহোক গোলাপ ফুলকে অনেক শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। তবে উল্লেখযোগ্য শ্রেণিগুলো হলো:

১) হাইব্রিড টি (Hybrideas) ফুলগুলো বেশ বড়, সুগঠিত ও অনেক পাপড়ি বিশিষ্ট । কাটা ফুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ক্রিমশন গোরি, পাপা মিল্যান্ড, টিপটিপ ইত্যাদি এ শ্রেণির জাত।

২) পলিয়েস্থা (Polyanha): ফুলগুলো আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং বড় বড় থোকায় ধরে। যেমন: জর্জ এলগার, ক্যামিও, আইডিয়াল ইত্যাদি ।

৩) ফ্লোরিবান্দা (Floribunda) ফুলগুলো আকারে ছোট এবং থোকায় ধরে। কাটা ফুলের জন্য চাষ করা হয় । যেমন: হানিমুন, সানসিল্ক ইত্যাদি ।

৪) মিনিয়েচার (Miniaure) গাছ ছোট, পাতা ছোট এবং ফুল ছোট হয়। যেমন: রাজিনা, গোল্ডেন, ইয়ালো ডল ইত্যাদি ।

 

গোলাপ ফুল চাষ

 

মাটি, জলবায়ু ও জমি নির্বাচন

গোলাপের জন্য রৌদ্যজ্জল, সুনিষ্কাশিত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি গোলাপ চাষের জন্য উত্তম । মাটির পিএইচ ৬.০-৭.৫ এর মধ্যে হওয়া উচিত । পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে এ ধরনের স্থান পরিত্যাগ করা উচিত ।

জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ

সাধারণত রোপণের পূর্বে ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে জমি ভালভাবে চাষ করতে হবে এবং এরপর মই দিয়ে সমান করে ৬.০ সি. x 1.2 মি… ১.৫ মি. আকারের বেড তৈরি করতে হবে। বেডটি ৫০-৬০ সে.মি. গভীর করে খুড়ে উপরের ২০ সে.মি.গভীরতার মাটি ও মধ্য স্তরের ২০ সে.মি. গভীরতার মাটি গর্ভের দুপাশে রাখতে হবে। শেষের ২০ সে.মি. গভীরতার মাটি না তুলে ভালো করে কুপিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ২০ কেজি গোবর সার, ৫০ গ্রাম টি.এস.পি এবং ৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ সার মেশাতে হয়।

এর উপরে স্তরের মাটির সাথে প্রতি বর্গমিটার ২০ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম টি.এস.পি. ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০০ গ্রাম এম.পি. সার মিশিয়ে গর্তে দিতে হবে। মধ্য স্তরের মাটির সাথে বর্গমিটারে ২০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম সরিষার খৈল, ১০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এম.পি সার মিশিয়ে উপরের স্তর ভরাট করতে হবে।

বেডগুলো সমতল থেকে যেন ২০ সে.মি. উপরে হওয়া উচিত। মাদায় করলে ৬০ সে.মি.× ৬০ সে.মি. গর্ত তৈরি করে তাতে ১০ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম হাঁড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এম.পি সার মিশিয়ে উপরের ২০ সি.মি. স্তর ভরাট করে দিতে হবে ।

গোলাপের বংশ বিস্তার

বীজ, শাখা কলম, দাবা কলম এবং চোখ কলম এর মাধ্যমে গোলাপের বংশ বিস্তার করা হয়। তবে সংকর জাত উদ্ভাবনের জন্য বীজ মাধ্যমে বেছে নেয়া হয়। সাধারণত: উন্নত জাতের গোলাপ এর মাধ্যমে চোখ কলম বংশ বিস্তার করানো হয়। বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময় এ চোখ কলম করা হয়।

 

গোলাপ ফুল চাষ

 

চারা রোপণ পদ্ধতি

অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উত্তম সময়, চারা লাগানোর পূর্বে শুকনো ডাল কেটে ফেলে বেডে বা টবে লাগাতে হবে। এমনভাবে লাগাতে হবে যেন কলমের জোড়ার স্থানটি ঠিক মাটির উপর যায়। গোলাপের চারা লাগানোর হাইব্রিডটি এর জন্য ৭৫-১০০ সে.মি. বা খর্বাকৃতি জাত এর জন্য ৪৫-৫০ সে.মি. দূরত্ব বাঞ্ছনীয় ।

আগাছা দমন ও শাখা ছাঁটাই (প্রুনিং)

সব সময় গোলাপ এর বেড আগাছা মুক্ত রাখা হবে। উত্তম ফুল পাওয়ার জন্য সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাস এর মধ্যে প্রুনিং করতে হবে। শুকনো বা রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে দেয়া হয়। নতুন শাখা বের হলে ফুল ফোটা শুরু হয়।

পানি সেচ

প্রুনিং এর পর গাছের গোড়ার চারদিক হতে ২০ সে.মি. মাটি সরিয়ে এক পার্শ্বে রেখে দিয়ে রৌদ্র ও বাতাসে উন্মুক্ত রাখতে হবে। এর ৮-১০ দিন পরে গাছ প্রতি ৫ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে দিয়ে গাছের গোড়ায় ভালোভাবে সেচ দিতে হবে।

রোগ দমন

গোলাপের শিকড় পঁচা রোগ দেখা যায়। এ রোগ হলে চারা গাছের গোড়ায় কালো দাগ পড়ে, পরিশেষে চারা মারা যায়। বীজতলার মাটি ক্যাপটান দ্বারা শোধন করলে এ রোগ অনেকটা দমন হয়। পাউডারি মিলডিউ রোগ গোলাপ গাছে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগে আক্রান্ত গাছের পাতার নিচে এবং শাখায়
ছাই রং এর পাউডারের প্রলেপ দেখা যায়। সাফলার জাতীয় ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করা হয়।

পোকামাকড় দমন

গোলাপের মিলিবাগের আক্রমণ দেখা যায়। এই পোকা আক্রমণ করলে মোমের ন্যায় গুড়া লেগে থাকে। পাতার তলদেশে চুনের মত পদার্থ দেখা যায়। এরা পাতার রস শোষণ করে। ম্যালথিয়ন স্প্রে করলে মিলিবাগ ধ্বংস হয়। জাব পোকা গোলাপের পাতা, ফুল এর রস শোষণ করে খায়। এ পোকা দমনের জন্য ম্যালথিয়ন স্প্রে করতে হবে।

ফুলসংগ্ৰহ

ফুল আধা ফোটা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে। তবে দূর-দুরান্তে বা কয়েকদিন পর ব্যবহারের জন্য হলে গোলাপের ফুলের কুঁড়ি যখন সম্পূর্ণ রং ধারণ করে কিন্তু ফোটেনি এমন সময় ফুল সংগ্রহ করা উচিত। কাট ফ্লাওয়ার বা কাটা ফুল হিসেবে ফুল লম্বা শাখা পাতাসহ ধারালো ছুরি দিয়ে কাটতে হয়। ফুল চয়নের কাজটি হয় খুব সকালে বা শেষ বিকেলে করা উচিত । ফুল সংগ্রহের পর শাখা পানিতে ডুবিয়ে নিম্নতাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় ।

 

আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন

 

সারসংক্ষেপ

গোলাপ ফুলকে ফুলের রাণী বলা হয়ে থাকে। এর কোমলতা, বর্ণ, সুগন্ধ এমন কেউ নেই যাকে আকৃষ্ট করে না। সাজ | সজ্জায় কাটা ফুল হিসেবে কদর রয়েছে। এছাড়া সুগন্ধি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবী জুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো। শাখা কলম, দাবা কলম এবং চোখ কলম এর মাধ্যমে গোলাপের বংশ বিস্তার করা হয়।

 

Leave a Comment