গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট – পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের, পরিবেশ বিভাগের ৩ নং ইউনিটের পাঠ ৩.১ নং পাঠের অংশ। গ্রীন হাউজের ধারণা গ্রীন হাউজ  একটি ইংরেজি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ সবুজ ঘর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি কাঁচ দিয়ে তৈরি ঘর বিশেষ যেখানে অনুকূল তাপমাত্রা সৃষ্টি করে বা ধরে রেখে সবুজ গাছপালা গ্রীন হাউজ একটি ইংরেজি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ সবুজ ঘর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি কাঁচ দিয়ে তৈরি ঘর যেখানে অনুকূল তাপমাত্রা সৃষ্টি করে বা ধরে রেখে সবুজ গাছপালা জন্মানো হয়। জন্মানো হয়।

 

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

 

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

সাধারণত শীতপ্রধান দেশে এবং ইদানিং তেল সমৃদ্ধ মরুময় দেশগুলোতেও এ ধরনের কাঁচের ঘর তৈরি করে তার ভেতরে টমেটো, শশা, বাঁধাকপি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মূলত উদ্যানজাতীয়  সবজি ও ফলমূল জন্মানো হয়। এখানে সূর্যের দৃশ্যমান আলোকরশ্মি গ্রীন হাউজের কাঁচের প্রাচীর ভেদ করে অতি সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু বিকরিত আলোকরশ্মি কাঁচ ভেদ করে বাইরে আসতে বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে কিছুটা তাপ ভেতরে আটকে যায় যা কাঁচের ঘরকে উত্তপ্ত করে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

এখানে দৃশ্যমান সৌরশক্তি ক্ষুদ্রতরঙ্গাকারে (৪০০—৭৬০ হস) কাঁচের দেয়াল দিয়ে খুব সহজেই ভেতরে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত উদ্ভিদ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিফলনের পর এই সৌরশক্তির একটি অংশ কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বায়ুমন্ডলে বিকিরিত হয় এবং আরেকটি অংশ, যা মূলত অদৃশ্যমান অতি—লাল বিকিরণ , কাঁচের দেয়ালে বাধাগ্রস্থ হয়ে কাঁচের ঘরের মধ্যে থেকে যায়। ফলে ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রা অপেক্ষা বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত গ্রীন হাউজ।

 

গ্রীন হাউজ প্রভাব

গ্রীন হাউজ প্রভাব কথাটি বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রার সাথে সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবীতে সকল তাপ ও শক্তির উৎস সূর্য। সূর্য থেকে আগত আলোক রশ্মি বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নিয়ে গঠিত। এর সকল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই দৃশ্যমান নয়। সূর্যের দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য ৪০০—৭৬০ হস। আবার আলোক রশ্মির সবটুকুই বর্তমানে কার্বন ডাই—অক্সাইডসহ কিছু গ্যাস বায়ুমন্ডলে বৃদ্ধি পাবার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে কাঁচের ঘরের প্রক্রিয়ার মতো পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার আশঙ্কা দেখা ি দয়েছে। আর এটির নামই হচ্ছে বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ‘গ্রীন হাউজ প্রভাব’ বা ‘গ্রীন হাউজ ইফেক্ট’। জীবের কাজে লাগে না।

 

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

 

অতিরিক্ত অংশ ভূপৃষ্ঠ থেকে অবলোহিত তরঙ্গ রশ্মি (ওহভৎধৎবফ ৎধফরধঃরড়হ) হিসেবে, যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৭৬০ হস এর উর্ধ্বে, বিকিরণের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের বাহিরে চলে যায়। কিন্তু বায়ুমন্ডলে এমন কিছু গ্যাস রয়েছে যা সূর্যের দৃশ্যমান আলোক রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে কোন বাধা দেয় না। কিন্তু এরা ভুপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণকালে অবলোহিত রশ্মি শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপের সবটুকু মহাশূন্যে চলে যাবার পরিবর্তে কিছুটা অংশ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে থেকেই যায়। এভাবে কতটুকু তাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে থেকে যাবে তা অবশ্য নির্ভর করে অবলোহিত রশ্মি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন কী পরিমাণ গ্যাস বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান আছে তার ওপরে। সুতরাং বায়ুমন্ডলে এ ধরনের গ্যাসের আধিক্য যত বেশি হবে তার তাপ শোষণ ক্ষমতাও তত বাড়বে।

অর্থাৎ এ সকল গ্যাস গ্রীন হাউজের কাঁচের বেষ্টনীর মতো কাজ করে বায়ু মন্ডলের তাপ বৃদ্ধি করে। বর্তমানে কার্বন ডাই—অক্সাইডসহ কিছু কিছু গ্যাস বায়ুমন্ডলে বৃদ্ধি পাবার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে কাঁচের ঘরের প্রক্রিয়ার মতো পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এটির নামই হচ্ছে বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ‘গ্রীন হাউজ প্রভাব’ বা ‘গ্রীন হাউজ ইফেক্ট’।

গ্রীন হাউজ ইফেক্টের উৎপত্তি শক্তি, রাসায়নিক ক্রিয়া—বিক্রিয়া ও ভৌত অবস্থাদির একটি জটিল সমীকরণের মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে পৃথিবীর জলবায়ু। শুক্র গ্রহের উত্তাপ এত অধিক যে, সেখানে একজন মানুষ পৌঁছামাত্র তার শরীরের রক্ত ফুটতে আরম্ভ করবে। পক্ষান্তরে মঙ্গল গ্রহের উত্তাপ হিমাঙ্কের এতই নিচে যে, সেখানে পৌছার সাথে সাথে একজন মানুষ প্রচন্ড ঠান্ডায় জমাট বেঁধে মৃত্যুবরণ করবে। এ দু’টো গ্রহে তাপমাত্রা বিভিন্নতা হবার মূল কারণ গ্রহ দু’টোর বায়বীয় উপাদানে বিরাট রাসায়নিক ভিন্নতা। পৃথিবী, মঙ্গল ও শুক্র এ তিনটি গ্রহেই প্রচুর সৌর শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু বিকিরণের মাধ্যমে যে পরিমাণ তাপ শক্তি মহাশূন্যে ফিরে যায় তা নির্ভর করে গ্রহগুলোর বায়ুমন্ডলের গ্যাসীয় উপাদানের উপর ।

 

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

 

গ্রীন হাউজের ভেতরে যে প্রক্রিয়ায় কাঁচের ঢাকনা দিয়ে তাপ আবদ্ধ হয়ে যায়, সেই একই প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই—অক্সাইড ও মিথেনের মতো কিছু কিছু গ্যাস বায়ুমন্ডলের নিম্নাংশের তাপ শোষণ করে উত্তাপ বৃদ্ধি করে। শুক্র গ্রহের বিদগ্ধ উত্তাপের কারণ মুলত সেখানকার CO2 সমৃদ্ধ বায়ুমন্ডল, যা অনিয়ন্ত্রিত গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটায়। অপরপক্ষে, মঙ্গল গ্রহে CO2 ও অন্যান্য গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ এতই কম যে, তা হিমাঙ্কের উপরে তাপমাত্রা ধরে রাখতে সমর্থ নয়। পক্ষান্তরে, পৃথিবীর রয়েছে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ বায়ুমন্ডল যেখানে CO2 এর পরিমাণ শতকরা প্রায় ০.০৩ ভাগ, যা বিগত কয়েক লক্ষ বৎসরেও তেমন বৃদ্ধি পায়নি।

মানব সৃষ্ট কার্যাবলী দিয়ে পৃথিবীর জটিল ভারসাম্যতা বিঘ্নিত হতে পারে এমন ধারণা প্রথম প্রকাশ করেন সুইডিশ রসায়নবিদ সেভানতে অরহেনিয়াস ১৮৯৬ সালে। কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি জীবাশ্ম অরহেনিয়াস মত প্রকাশ করেন যে, দ্রুত শিল্প বিপ্লবের জন্য অধিক কয়লা পোড়ানো হলে CO2 গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং তা ধীর গতিতে বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখনকার সময়ে এটি কল্প—কাহিনী অথবা তাত্ত্বিক ি বষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৫৭ সালে ক্যালিফর্নিয়ার স্ক্রিপস ইনষ্টিটিউট অব ওসেনোগ্রাফী সে সত্যতার প্রমাণ পান।

ঘটিত জ্বালানির দহন শেষে CO2 নির্গত হয়। অরহেনিয়াস মত প্রকাশ করেন যে, দ্রুত শিল্প বিপ্লবের জন্য অধিক কয়লা পোড়ানো হলে CO2 গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং তা ধীর গতিতে বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখনকার সময়ে এটি কল্প—কাহিনী অথবা তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৫৭ সালে ক্যালিফর্নিয়ার স্ক্রিপস ইনষ্টিটিউট অব ওসেনোগ্রাফীসে সত্যতার প্রমাণ পান। তারা দেখান যে, পৃথিবীতে যে পরিমাণ CO2 নির্গত হয় তার প্রায় অর্ধেকই স্থায়ীভাবে বায়ুমন্ডলে আবদ্ধ হয়ে যায়। এরপরে বিজ্ঞানী ডেভিট কিলিং ১৯৫৮ সালে হাওয়াইয়ের মনালয়াতে বায়ুমন্ডলের CO2 এর ঘনত্ব ৩১৫ পিপিএম হিসেবে রেকর্ড করেন। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ৩৫০ পিপিএম অতিক্রম করেছে।

সেভানতে অরহেনিয়াসই প্রথম ‘গ্রীন হাউজ ইফেক্ট’ কথাটি ব্যবহার করেন। শিল্প বিপ্লবের যুগে বিপুল পরিমাণ কয়লা পোড়ানের ফলে যে পরিমাণ CO2 বাতাসে মিশেছে তার কুফল সম্পর্কে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, বায়ুমন্ডলে CO2 বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর উষ্ণতা ৫ সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। তিনি আরও মত প্রকাশ করেন যে, CO2 গ্যাস কমে যাবার কারণেই তুষার যুগের সৃষ্টি হয়।

 

সুতরাং এ কথা বলারই অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রীন হাউজ প্রভাবই একসময় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করেছিল। তাপ অপরিবাহী কম্বল সৃষ্টির কারণেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ১৫ সেণ্টিগ্রেড, অন্যথায় তা ১৭.৭ সেণ্টিগ্রেডের বেশি হতো না। সুতরাং গ্রীন হাউজ গ্যাসের অবর্তমানে পৃথিবী রাতারাতি পরিণত হবে প্রাণহীন শীতল গ্রহে। তাই পৃথিবীর স্বাভাবিক তথা অনুকূল অস্তিত্বের জন্য এক দিকে যেমন এদের পরিমিত উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে, অন্যদিকে বায়ুমন্ডলে এদের অস্বাভাবিক উপস্থিতি যেন বিপর্যয়কর
অবস্থার সৃষ্টি না করে তাও লক্ষণীয়।

 

গ্রীন হাউজ গ্যাসসমূহ ও এদের উৎস

 

গ্রীন হাউজ গ্যাস যে সকল গ্যাস ভূপৃষ্ঠের বিকিরিত তাপ আটকিয়ে রাখার ক্ষমতাস¤পন্ন অর্থাৎ গ্রীন হাউজ প্রভাব সৃষ্টি করতে সমর্থ তাদেরকে গ্রীন হাউজ গ্যাস বলে। এদের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (ঈঐ৪), নাইট্রাস অক্সাইড (ঘ২ঙ), ক্লোরো—ফ্লোরো—কার্বন ইত্যাদি। অতীতে CO2 কেই একমাত্র গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন সূত্র মতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় গ্রীন হাউজ প্রভাব ঘটানোর জন্য CO2 এর ভূমিকা শতকরা প্রায় ৪৯ ভাগ যে সকল গ্যাস ভূপৃষ্ঠের ।

সারণী — ৩.২ — ১ বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের মাত্রা

তবে এটা নিশ্চিত যে, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এ জাতীয় গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমন্ডলে আশংকাজনক ভাবে বেড়ে চলেছে।

 

কার্বন ডাই—অক্সাইড (CO2)

শিল্প কারখানা, মটরযান ও নানা রকমের চুল্লীতে বর্ধিত হারে জীবাশ্ম জ্বালানী (যেমনঃ কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ইত্যাদি) পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণে CO2 বায়ুতে নির্গত হচ্ছে বর্তমানে যার পরিমাণ বৎসরে প্রায় ৫.২ বিলিয়ন টন গ্রীন হাউজ প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রধান গ্যাসই হেŽছ কার্বন ডাই—অক্সাইড (CO2)। এজন্য বিজ্ঞানের ভাষায় গ্রীন হাউজ ইফেক্টকে অনেকেই ‘কার্বন ডাই—অক্সাইড সমস্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটি কার্বন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগ যা কার্বনের দহন থেকে সৃষ্ট। শিল্প কারখানা, মোটরযান ও নানা রকমের চুল্লীতে বর্ধিত হারে জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমনঃ কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ইত্যাদি) পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণে CO2 বায়ুতে নির্গত হচ্ছে বর্তমানে যার পরিমাণ বৎসরে প্রায় ৫.২ বিলিয়ন টন।

তাছাড়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, জীব ও উদ্ভিদ দেহের পচন প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণেও প্রচুর CO2 বায়ুতে জমা হচ্ছে । জীব জগত নিঃশ্বাসের সাথে যে পরিমাণ CO2 ত্যাগ করছে তার পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। একজন মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে প্রতিদিন প্রায় ২ পাউন্ডের মতো CO2 বাতাসে ছাড়ছে। এর সাথে আরও যোগ হচ্ছে কাঠ পোড়ানো ও বনরাজি উজাড়িকরণ সংক্রান্ত CO2। ১৯৮০ সনের এক হিসাব মোতাবেক দেখা গেছে বিষুবীয় অঞ্চলে বন ধ্বংসের কারণে ১৬৫৯ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই—অক্সাইড গ্যাস বায়ুতে যোগ হয়েছে। বনায়ন ধ্বংসের কারণে দ্বৈত ঘটনার সৃষ্টি হয়। একদিকে বন নিধনের ফলে সালোকসংশ্লেষনের মাধ্যমে CO2 শোষণকারী গাছের সংখ্যা হ্রাস পায় অন্যদিকে কর্তিত গাছের কাঠ, পাতা ইত্যাদি পোড়ানো বা পঁচনের ফলে নির্গত হয় CO2।

শিল্প বিপ্লবের আগে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় দু’শ বৎসর পূর্বেও বায়ু মন্ডলে CO2 এর স্থিতি নির্ভর করতো প্রাকৃতিক যোগ বিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু শিল্প বিল্পবের সাথে সাথে অর্থাৎ বর্ধিত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পর থেকে আবহাওয়াগত সমীকরণে এক নূতন মাত্রা যোগ হয়। কারণ শিল্প কারখানা যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বর্ধিত CO2 নির্গত করে, উদ্ভিদ ও সাগর ততটা শোষণ করে নিতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া এ শতকের গোড়ার দিক থেকে মোটরযানের আবিস্কারের ফলে ব্যাপক জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলে। এছাড়াও রয়েছে অধিক জনসংখ্যাজনিত কারণে খাদ্য, গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে CO2 আত্তীকরণের উৎস।

১৯৫৮ সনের পর থেকে পৃথিবীর CO2 বৃদ্ধির পরিমাণ ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করা হচ্ছে । সে সময় থেকে বর্তমান দশক পর্যন্ত CO2 বৃদ্ধির হার ০.৫ ভাগ থেকে ১.০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের উৎসসমূহ বন্ধ বা নির্গমনের মাত্রা কমাতে না পারলে বৃদ্ধির বর্তমান হার যে আরও উর্ধ্বগামী হবে তাতে কোন্ সন্দেহ নেই। আর এর ফলে বাড়বে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া।

কারা সবচেয়ে বেশি CO2 দূষণ ঘটাচ্ছে সাধারণ ভাবে উন্নত দেশসমূহকেই বায়ুমন্ডলে CO2 বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়। ১৯৮০ সনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে উন্নয়নশীল দেশসমহ থেকে যেখানে বায়ুতে ূ CO2 নির্গমনের পরিমাণ ছিল ১৩% সেখানে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও দূর—প্রাচ্য থেকে নির্গমনের পরিমাণ ছিল ৫৭% CO2। কিন্তু ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশসমূহেও শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে আগামী শতাব্দীর প্রথমাংশেই CO2 নির্গমনের দিক দিয়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহ উন্নত দেশগুলিকেও ছাড়িয়ে যাবে।

 

মিথেন

এক অণু কার্বন ও চার অণু হাইড্রোজেন সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্যাসের নাম মিথেন (ঈঐ৪)। এটি প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উৎস এবং এর দাহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি। মিথেন নির্গমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষিকার্যের সাথে বহুলাংশে সম্পর্কযুক্ত। বিগত ২০০ বৎসরে বায়ুমন্ডলে মিথেনের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রাকৃতিক উৎস ছাড়াও জলাভূমি, পচনশীল বর্জ্য, গবাদি পশু, উইপোকার অন্তে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি উৎস থেকেও মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। জলাবদ্ধ ধানের জমিতে জৈব পদার্থ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিজাড়িত হয়ে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে।

বর্তমানে বিশ্বের মোট মিথেন উৎপাদনের শতকরা ১০ ভাগই জলাবদ্ধ ধানের জমি থেকে আসছে। বিশ্ব—খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ, ১৯৯৪) মতে ধানের জমি থেকে বৎসরে ৬০ মিলিয়ন টন মিথেন উৎপন্ন হয় এবং এর শতকরা ৯০ ভাগই আসে এশিয় দেশগুলি থেকে। নয়া—দিল্লীস্থ ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের প্রাক্তন ডাইরেক্টর ডঃ সুরেশ, কে. মিনহার (১৯৯৫) মতে ধানের জলাবদ্ধ ধানের জমিতে জৈব পদার্থ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ি বজাড়িত হয়ে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে। বর্তমানে বিশ্বের মোট মিথেন উৎপাদনের শতকরা ১০ ভাগই জলাবদ্ধ ধানের জমি থেকে আসছে। বর্তমানে বায়ুমন্ডলে প্রায় ১.৭ ি পপিএম মিথেন গ্যাস রয়েছে এবং এর পরিমাণ বৎসরে শতকরা ১—২ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

জমি থেকে নিঃসৃত মিথেনের পরিমাণ অবশ্য ঋঅঙ—র চাইতে ১৫ গুণ কম বলে উলে­খ করা হয়েছে। মিথেন গ্যাসের আরেকটি উৎস হচ্ছে গো—মহিষ, ছাগল—ভেড়া ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। বিশ্ব—খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) সমীক্ষা মতে এসকল পশুর অন্ত্র থেকে বৎসরে প্রায় ৮০ মিলিয়ন টন মিথেন উৎপন্ন হয়, যা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত মিথেনের শতকরা ১৮ ভাগ। এছাড়া কাঠ ধ্বংসকারী উইপোকার ঢিবি থেকেও মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। জানা গেছে কাঠ ধ্বংসকারী একটি মাঝারি আকৃতির উইপোকার ঢিবি থেকে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫ লিটার মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। বর্তমানে বায়ুমন্ডলে প্রায় ১.৭ পিপিএম মিথেন গ্যাস রয়েছে এবং এর পরিমাণ বৎসরে শতকরা ১—২ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে বায়ুতে পরিমাণ কম হলেও গ্রীন হাউজ ইফেক্ট ঘটানোর ক্ষমতা CO2 অপেক্ষা মিথেনের বেশি। কারণ— ১ অণু CO2 যে পরিমাণ গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটায় ১ অণু মিথেন তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সমর্থ (উবঢ়ঃযহবিং অংরধ, ১৯৯৩)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ এ্যালান তেরামোরার (১৯৮৮) মতে ১০,০০০ গুণ বেশি।

 

নাইট্রাস অক্সাইড

বর্তমানে বৎসরে শতকরা ০.৩ ভাগ হারে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর গ্রীন হাউজ ইফেক্ট সংগঠন ক্ষমতা CO2 অপেক্ষা ১৮০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি। অক্সিজেনের সাথে নাইট্রোজেনের সংযুক্তির ফলে যেসব অক্সাইড তৈরি হয় নাইট্রাস অক্সাইড তার অন্যতম। এ গ্যাসের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, মোটরযান, প্লাষ্টিক, এসিড, বিস্ফোরক দ্রব্য নির্মান কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা এবং কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন গঠিত সার। এর মধ্যে জৈবিক উৎস থেকে নিঃসৃত গ্যাসের প্রায় এক পঞ্চমাংশই সংযোজিত হয় জমিতে নাইট্রোজেন গঠিত সারের ব্যবহার থেকে। বর্তমানে বৎসরে শতকরা ০.৩ ভাগ হারে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর গ্রীন হাউজ ইফেক্ট সংগঠন ক্ষমতা CO2 অপেক্ষা ১৮০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি।

 

ক্লোরো – ফ্লোরো কার্বন

গ্রীন হাউজ ক্ষমতা বিশে­ষণে CO2 এর পরেই ঈঋঈং এর অবস্থান। এরা বায়ুমন্ডলে দীর্ঘস্থায়ী। আর টপোস্ফিয়ারে পৌঁছে সুর্যের অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙ্গে যায় এবং মুক্ত ক্লোরিন পরমাণু বেড় হয়ে আসে। আর এ ক্লোরিন অণুই ওজোন স্তর ধ্বংসের মুল কারণ। ক্লোরো—ফ্লোরো—কার্বন (ঈঋঈঝ) ক্লোরিন, ফ্লোরিন এবং কার্বনের একটি যৌগ। অন্যান্য গ্রীন হাউজ গ্যাস থেকে এটি ব্যতিক্রম ধর্মী এ জন্য যে এটি কোন্ প্রাকৃতিক উৎস থেকে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে না বরং মানব সৃষ্ট। বিগত ৫০ বৎসর যাবৎ এটি উৎপাদিত হয়ে আসছে বিভিন্ন দ্রাবক, রিফ্রেজারেটরের তরল পদার্থ, স্প্রে—ক্যানের প্রপেলার এবং ফোম প্যাকিং সামগ্রীতে ব্যবহারের জন্য।

যদিও বায়ুমন্ডলে গ্যাসসমুহের পরিমাণ এখনো খুবই সামান্য তথাপি গ্রীন হাউজ প্রক্রিয়ায় এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ: (১) কোন্ কোন্ ঈঋঈং— এর বিকিরণ ক্ষমতা CO2 অপেক্ষা দশ হাজার গুণ বেশি, (২) প্রায় সবগুলোই বায়ুমন্ডলে দীর্ঘস্থায়ী, (৩) স্ট্রাটোস্ফিায়ারের ওজোন ধ্বংসকারী, যার পরিণতিতে গ্রীন হাউজ প্রভাব ঘটে, এবং (৪) বায়ুমন্ডলে ঈঋঈং বৃদ্ধির হার অধিক (বর্তমানে ৫—৭%)। প্রকৃতপক্ষে, গ্রীন হাউজ ক্ষমতা বিশ্লেষণে CO2 এর পরেই  এর অবস্থান। এরা বায়ুমন্ডলে দীর্ঘস্থায়ী। আর টপোস্ফিয়ারে পৌঁছে সুর্যের অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙ্গে যায় এবং মুক্ত ক্লোরিন পরমাণু বেড় হয়ে আসে। আর এ ক্লোরিন অণুই ওজোন স্তর ধ্বংসের মূল কারণ।

 

গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

 

জীব জগত ও গ্রীন হাউজ ইফেক্ট

এ কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই—অ*াইড, মিথেন, নাইট্রাস অ*াইড, সি.এফ.সি প্রভৃতি গ্রীন হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধিজনিতকারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু বায়ুমন্ডলে কী পরিমাণ তাপের বৃদ্ধি ঘটেছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে সম্প্রতি যে চিত্র ফুটে ওঠেছে তা থেকে এটা নিশ্চিত যে, বিগত ১০০ বছরে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ০.৫  ০.১ সেঃ বৃদ্ধি পেয়েছে বায়ুমন্ডলের গড়পড়তা তাপ ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও পরবর্তী তিন দশকে প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। কিন্তু ৭০ এর দশকের পর থেকে তা হঠাৎ করে আবার বাড়তে থাকে এবং ৮০ দশকে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের তাপমাত্রা গত ১৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলের গড় তাপমাত্রা আরও ১.৫ থেকে ৪.৫ সেঃ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আবহাওয়া ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু আবহাওয়াবিদদের মতে তাপমাত্রার গড় অপেক্ষা সাময়িক চরম বৃদ্ধিই বেশি বিপদজনক।

 

আবহাওয়াগত পরিবর্তন

গ্রীন হাউজ গ্যাস দ্বারা ভূ—পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুগত পরিবর্তনে নানা ধরনের জটিল প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, মারাÍক খরা, বৃহৎ দাবানল স্থান বিশেষে শৈত্য প্রবাহ, অধিক হারে অপ্রত্যাশিত বন্যা ইত্যাদি। তবে বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসজনিত উত্তাপ বৃদ্ধির প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্র একইভাবে হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন না। পৃথিবীর মধ্য অক্ষাংশে অবস্থিত দেশসমূহ যেমনঃ অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ স্থান, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশসমূহের তাপমাত্রা জনিত আবহাওয়া পরিবর্তন প্রক্রিয়া সর্বাধিক অনুভূত হবে। আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত উদ্ভূত পরিস্থিতির একটি বড় বিপদ এই যে, এটি কখন ঘটবে তা নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করা যায় না।

হ্যারিকেনের তীব্রতা সম্পন্ন মাত্র কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানীর কারণ হতে পারে। আফ্রিকার অধিকাংশ স্থানে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে লাগাতার দুই তিনটি খরা—বৎসর লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহার ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটবে যা কেবলমাত্র আণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার সাথে তুলনীয় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

 

বৃষ্টিপাতে প্রভাব

আবহাওয়ার পরিবর্তন হেতু বৃষ্টিপাতের ধরনেও বিরাট পরিবর্তন আসবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। ফলে উর্ধ্ব—অক্ষাংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত, গ্রীস্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন বৃষ্টিপাত এবং মধ্য অক্ষাংশে গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে শীতকালে হবে আর্দ্র এবং গ্রীস্মকাল হবে শুষ্ক। পক্ষান্তরে উপ—গ্রীস্মীয় অঞ্চল যা ইতোমধ্যেই শুষ্ক তা আরও শুষ্ক হয়ে যাবে।

গ্রীন হাউজ প্রভাবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আগামী ৫০ বৎসরের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ হ্রাস পাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন যে আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলের বৃষ্টিপাত বেষ্টনী  উত্তর দিকে সরে গিয়ে সাহেল এলাকা আর্দ্রতাযুক্ত করবে এবং মধ্য চীনের প্রান্তীয় কৃষি ভূমিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের বৃহত্তর অংশ হবে খরা কবলিত।

 

কৃষিতে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া

কৃষিতে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটে থাকলেও বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন আজও আবহাওয়া ও জলবায়ুগত উপাদানের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই জলবায়ুগত যে কোন্ পরিবর্তনে কৃষি তথা শস্য উৎপাদন, পশু পালন, বন ও মৎস্য চাষের উপর প্রত্যক্ষভাবে যে প্রভাব পড়বে তাতে কোন্ সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) মতে বায়ুমন্ডলের তাপ বৃদ্ধি পেলে আজ যেখানে তীব্রশীত সেসব স্থানে শস্য উৎপাদন সম্ভব হবে। আগামী ১০০ বৎসরে মধ্য অক্ষাংশের জলবায়ু স্তর ি বজ্ঞানীদের ধারণা আগামী ৫০ থেকে ১০০ বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ২—৫সেঃ বৃদ্ধি পেলে মেরু অঞ্চলের অধিকাংশ বরফ গলে  ি গয়ে সাগরের পানিতে যোগ হবে। তাছাড়া উত্তাপ বৃদ্ধিজনিত কারণে সাগরের পানির আয়তনও বৃদ্ধি পাবে।

ফলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ০.৩ থেকে ১ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আশংকা করা হচ্ছে। এবং এর সাথে সম্পৃক্ত ইকোসিস্টেম ২০০ থেকে ৭০০ কিমি পর্যন্ত মেরুর দিকে স্থানান্তরিত হবে। এতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশসমূহ উপকৃত হবে। কিন্তু শুষ্ক ও উপশুষ্ক অঞ্চলের (অৎরফ ধহফ ংবসর ধৎরফ ুড়হব) দেশসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাহারা মরুভূমি যদি ২০০ কি. মি. দক্ষিণ দিকে সরে যায় তবে সেখানকার সম্পদ শতকরা ৩০ জন লোকের খাদ্য সংস্থান দিতে অসমর্থ হবে।

উদ্ভিদের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ যথার্থ বজায় থাকলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই—অ*াইড বৃদ্ধি জনিত কারণে ফসলের উৎপাদন ১০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি উৎপাদনে দু’টি উৎকণ্ঠাজনক উপাত্ত হচ্ছে উŽচ তাপমাত্রা ও স্থানীয় বৃষ্টিপাত বা সেচের ঘাটতি। গ্রীন হাউজ প্রভাবের কারণে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো কিছু কিছু উদ্ভিদ চাষের বিস্তৃতি ঘটালেও পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল ধানের পুষ্পায়নের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উদ্ভিদের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ যথার্থ বজায় থাকলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই—অ*াইড বৃদ্ধি জনিত কারণে ফসলের উৎপাদন ১০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কার্বন ডাই— অ*াইডের উর্বরতা সাধন ক্ষমতা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। ফলে উন্নত বিশ্বে গ্রীন হাউজে ফসল উৎপাদনে CO2 কে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা ধারণা করা হয় যে বর্তমান সময়ে ফসলের বর্ধিত উৎপাদনের পিছনে আংশিকভাবে হলেও বায়ুমন্ডলে বর্ধিত কার্বন ডাইঅ*াইডের একটি ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।

কার্বন ডাই অ*াইডের ইতিবাচক দিক প্রকৃতিতে উদ্ভিদের কার্বন বিপাকের জন্য ঈ৩ ও ঈ৪ জাতীয় দুইটি ভিন্নতর পদ্ধতি রয়েছে। বর্ধিত কার্বন ডাই—অ*াইডের প্রতি সাড়া প্রদানে ঈ৩ উদ্ভিদ ঈ৪ উদ্ভিদ অপেক্ষা বেশি কার্যকরী। এতে করে তুলনামূলকভাবে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফসল যেমনঃ গম, বার্লি ইত্যাদি অধিক সুবিধা ভোগ করবে। পক্ষান্তরে, আখ, ধান প্রভৃতি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফসল কম সুবিধা পাবে। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই—অ*াইডের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে সকল ফসলের জন্য উন্নততর পানি ব্যবহার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর ফলে কম পানি ব্যবহার দ্বারা শুষ্ক ও উপ—শুষ্ক অঞ্চলে (অৎরফ ্ ংবসর ধৎরফ ৎবমরড়হং) ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি জনিত প্রতিক্রিয়া

পৃথিবীর মোট জলরাশির শতকরা ৯৭.৫ ভাগ সাগর এবং মহাসাগরে, দুই ভাগ উŽচ পর্বত—শৃঙ্গ ও মেরু অঞ্চলে এবং বরফে আবদ্ধ। বাকি ০.৫ ভাগের মধ্যে রয়েছে নদ—নদী, খাল—বিল, হ্রদ, ডোবা—নালা, ঝরণা ও ভুগর্ভস্থ পানির আধার। বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী ৫০ থেকে ১০০ বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ২—৫সেঃ বৃদ্ধি পেলে মেরু অঞ্চলের অধিকাংশ বরফ গলে গিয়ে সাগরের পানিতে যোগ হবে। তাছাড়া উত্তাপ বৃদ্ধিজনিত কারণে সাগরের পানির আয়তনও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ০.৩ থেকে ১ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আশংকা করা হচ্ছে । তবে মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, বার্মা, চীনসহ পৃথিবীর বহু নিম্নাঞ্চল এবং বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা লবণাক্ত পানির নিচে ডুবে যাবে।

হারিয়ে যাবে চাষ যোগ্য উর্বর জমি। গৃহহীন হবে লক্ষ লক্ষ জনপদ। বিনষ্ট হবে উপকূলীয় মৎস্য চাষ ও ম্যানগ্রুভ বনাঞ্চল। জলোচ্ছ্বাসের আওতায় আসবে উপকূলীয় নিম্নভূমি। ব—দ্বীপ অঞ্চলের স্বাদু পানির আধারগুলো লবণাক্ত পানিতে ভরে যাবে। এভাবেই ব্যাপক পরিবর্তন আসবে জৈব—ইকোসিস্টেমে।

 

মৎস্য চাষে প্রভাব

আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে মৎস্য স¤žদের উপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হবে, তা সে সাগর বা মিঠা পানি যেখানেই হোক। মাছের সামুদ্রিক আবাসস্থল ও প্লাংটনের স্থানান্তর ঘটবে, ব্যহত হবে উৎপাদনশীলতা। স্বাদু পানির মাছ খরা, বন্যা ও উচ্চ তাপ দ্বারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে চিংড়ী চাষ। ফলে মৎস্য চাষ ও আহরণের সাথে সম্পৃক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন যাত্রায় পড়বে চরম টানা পোড়া।

বনসম্পদে প্রভাব পৃথিবীর কার্বন চক্র বিবর্তনে বৃক্ষরাজির ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ২০০০ বিলিয়ন কার্বন পৃথিবীর সবুজ গাছপালা ও মাটি ধারণ করে আছে, যা বায়ুমন্ডলে অবস্থিত মোট কার্বনের প্রায় তিন গুণ। বৃক্ষনিধন বা অপসারণের ফলে ধারণকৃত কার্বন জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে অথবা প্রাকৃতিক উপায়ে জারিত হয়ে পুণরায় বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৫০ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে বন নিধনের ফলে ৯০—১৮০ বিলিয়ন টন কার্বন বায়ুমন্ডলে জমা হয়েছে যা কয়লা ও জ্বালানি
থেকে জমাকৃত কার্বনের প্রায় সমপরিমাণ।

বর্ধনশীল গাছপালা সালোক—সংশে­ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই—অ*াইড শোষে নেয় এবং আত্তীকরণ করে রাখে। অধিক হারে বৃক্ষ নিধনের অর্থ হবে একদিকে কার্বন আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়া, অন্য দিকে কর্তিত বৃক্ষরাজির জারণ প্রক্রিয়া থেকে বায়ুমন্ডলে আরও কার্বন জমা হওয়া। ফলে গ্রীন হাউজ প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পাবে।

গ্রীন হাউজ প্রভাবজনিত উত্তাপ বৃদ্ধিতে বৃক্ষরাজি ও অন্যান্য উদ্ভিদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। অধিকাংশ বৃক্ষই স্বল্প পরিসর তাপমাত্রার মধ্যে (ঘধৎৎড়ি ৎধহমব ড়ভ ঃবসঢ়বৎধঃঁৎব) অভিযোজিত। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সে: বৃদ্ধি পেলে তা হবে বনভুমির জন্য বিপর্যয়কর। কারণ এতে বর্তমান জলবায়ু অঞ্চলগুলো শত শত কি. মি. মেরু অঞ্চলের দিকে সরে যাবে। কিন্তু বনাঞ্চল সরে যাবার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান হার তার চেয়েও অধিক। তাই সময়মত বনাঞ্চল অভিবাসন প্রক্রিয়া জোরদার করা না হলে বনাঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য মারাÍকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

 

গ্রীন হাউজ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে করণীয়

গ্রীন হাউজ প্রভাব মানব সৃষ্ট একটি বিশ্ব—ব্যাপি সমস্যা। “মানব সভ্যতা অদ্যাবধি যতগুলো সমস্যা “মানব সভ্যতা অদ্যাবধি যতগুলো সমস্যা মোকাবেলা করেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাটি হলো এর ভিতর সবচেয়ে মারাত্বক” মোকাবেলা করেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাটি হলো এর ভিতর সবচেয়ে মারাত্বক” (আল গোর, উপরাষ্ট্রপতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, এপ্রিল ১৯৯৪)। সুতরাং আঞ্চলিকভাবে এর কোন্ সমাধান সম্ভব নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমান দূষণ হার এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ব—ব্যাপি যে পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত তা হলোঃ

* জীবাশ্ম জ্বালানি যথাসম্ভব নিম্নমাত্রায় রাখতে হবে এবং বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিরাপদ জ্বালানির উৎস খঁুজতে হবে।

* পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তি যা সাধারণভাবে পরিবেশ দূষণ ঘটায় না যেমনঃ বায়ু, পানি, সৌরশক্তি, পারমানবিক শক্তি ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি বেশি নজর দিতে হবে।

* স্বল্প তেল ব্যবহার উপযোগী মটরযান উদ্ভাবন করে জ্বালানি ব্যবহার কমাতে হবে।

* প্রাকৃতিক বন সম্পদ সংরক্ষণ ও নতুন করে বনায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে।

* কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

* সস্তা বিকল্প আবিস্কারের মাধ্যমে ঈঋঈং ব্যবহার কমাতে হবে বা প্রয়োজনে বন্ধ করে দিতে হবে।

* মটরযান ও শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ধূঁয়া থেকে গ্রীন হাউজ গ্যাস অপসারণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।

* শিল্প কারখানা গুলো নিরাপদ রাখার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।

* ধানের জমি থেকে অল্প মিথেন নির্গত হয় এমন সব ধানের জাত উদ্ভাবন করতে হবে।

* গ্রীন হাউজ প্রভাব দূরীকরণে উন্নত বিশ্বকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় কারিগরী ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।

* গণ—মাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যমের মাধ্যমে গ্রীন হাউজ প্রভাবের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

* স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।

* যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণেও পরিবেশের দূষণ হচ্ছে সে কারণে জনসংখ্যা বিস্ফোরণরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

Leave a Comment