আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-চারার পরিচর্যা
চারার পরিচর্যা
নার্সারিতে চারা গাছের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা করা প্রয়োজন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে শিশু চারাগাছ ক্রমশ সুস্থ সবল রোপণের উপযুক্ত চারায় পরিণত হয়। সঠিকভাবে পরিচর্যা না পেলে কখনো সুস্থ, সবল নির্ধারিত সংখ্যক চারা পাওয়া যাবে না। নতুন স্থানে রোপণের পূর্ব পর্যন্ত নার্সারিতে চারার যেসব পরিচর্যা করা হয় তা হলো-
১. শেড বা ছায়া প্রদান;
২. সেচ ও নিকাশ;
৩. মালচিং
৪. আগাছা বাছাই ও মাটি আলগাকরণ;
৫. অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলা এবং শূন্যস্থান পূরণ:
৬. সার প্রয়োগ:
৭. শিকড় ছাঁটাই ও গ্রেডিং
৮. রোগবালাই ব্যবস্থাপনা:
৯. হার্ডেনিং বা শক্তকরণ:
১০. চারা সজ্জিতকরণ ও লেবেলিং।
শেড বা ছায়া প্রদান
অধিকাংশ উদ্ভিদের অঙ্কুরিত চারাকে অতিরিক্ত রোদ ও তাপ হতে রক্ষার জন্য খুঁটির সাহায্যে ০-১.৫ মিটার উচ্চতায় শেড বা ছায়া প্রদান করতে হয়। সাধারণত খড়, ছন, তরজা, বাঁশের ধারা ইত্যাদি দ্বারা চালা তৈরি করা হয়। চারা বড় হবার পর শেষ সরিয়ে ফেলতে হবে।
এছাড়া চারা ছোট থাকাকালীন সময়ে ও ছায়া চাল সরিয়ে সকাল ও বিকালে চারাকে হাল্কা রোদের সংস্পর্শে আনতে হবে। শেড বীজতলায় মাটির রস সংরক্ষণে ও সাহায্য করে। তবে কিছু কিছু উদ্ভিদ, রয়েছে যেমন- সেগুন, গামার প্রভৃতি চারায় কোন শেড প্রদানের প্রয়োজন হয় না।
সেচ ও নিকাশ
খাদ্য উৎপাদন ছাড়াও চারার জন্য বাতাস ও পানি অত্যাবশ্যক। সেজন্য বীজ বপন বা চারা রোপণের পর থেকেই পলিব্যাগ ও বেডে পানি দিতে হয়। সকালে অान না ঝাকরির সাহায্যে অথবা স্প্রে মেশিন দিয়ে পরিমিত সেচ দেওয়া উচিত।
সেচের ফলে অামা হয় এবং অঙ্কুরিত চারার মাটি হতে বিভিন্ন খনিজ উপাদান শোষন সহজ হয়। তবে অতিরিক্ত সেচ প্রদানে বীজ বা চারা পড়ে যেতে পারে। সেজন্য বর্ষাকালে অতিরিক্ত। বৃষ্টির পানি দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করা অপরিহান।
মালচিং
মাটির রস ও আর্দ্রতা সং া ই বীজতলা ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে। মালচিং মাটির আর্দ্র করে বীজের অঙ্কুরোদগমকে ত্বরান্বিত করে ফেলে জমিতে কম সেয়ানা দরকার হয়। নারিকেল, সুপারি, আমড়া, মেহগনি ইত্যাদি চারা উত্তোলনে মালচিং ব্যবহার করা হয়।
আগাছা পরিষ্কার ও মাটি আলগাকরণ
আগাছা চারা গাছের বড় শত্রু। এর চারা গাছের সাথে খালা, পানি, আলো ও জায়গা নিয়ে জ বপন না চারা রোপণের পর থেকেই নার্সানির চারাকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ছোট অবস্থায় আগাছাকে হাত বা নিড়ানি দ্বারা তুলে বেডের বা পলিব্যাগের বাইরে ফেলতে হनে। অনেক সময় পলিব্যাগ বার বার সেচ প্রদানের ফলে মাটির উপরিভাগ শক্ত হয়ে যায়।
এতে চারার শিকড় আটকে বৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বাশের সূচালো কাঠি যারা সাবধানে মাটি আলগা করে দিতে হবে। মাটি আলগা করার পর মাটি উত্তমরূপে অকিয়ে সেচ দিতে হন। ফলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয় এবং আগাছার প্রকোপ হ্রাস পায়।
অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলা এবং শূন্যস্থান পূরণ
পলিব্যাগের দ্বারা যখন টিকে মানে কিংবা কিছুটা বড় হবে তখন কেবল একটি দ্বারা রেখে বাকিগুলো ভুলে যেতে হবে। তা না হলে চারার বৃদ্ধি কমে যাবে এবং দ্বারা দুর্বল হবে। তাই সুস্থ সবল একটি চারা রেখে বাকিগুলো সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। এছাড়া যে সন পলিব্যাগে চারা নেই সেগুলোতে অন্য পলিব্যাগের অতিরিক্ত চারা তুলে রোপন করাতে হবে।
বেডের ক্ষেত্রে চারা বেশি ঘন হলে একই রকম ঘটনা ঘটবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণ। চারা রেখে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে।
সার প্রয়োগ
সুস্থ সবল চারার জন্য পলিব্যাগ ও নার্সারি বেডে সার প্রয়োগ করা হয়। তবে চারার বয়স ১.৫-২ মাস না হওয়া পর্যন্ত্ কোন সার প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণত শুকনো গোবর, খইল ও ইউরিয়া সার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে কিংবা মিহি গুঁড়া করে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
চারার বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে তার উপর সারের পরিমাণ এবং কি প্রকারের সার প্রয়োজন তা নির্ভর করে। সার প্রয়োগের পর বীজতলায় ঝাঁকরি বা স্প্রে মেশিন দিয়ে সেচ প্রদান করা ভালো। শীতের সকালে কুয়াশায় পাতা ভিজা থাকা অবস্থায় সার প্রয়োগ করা। উচিত নয়। এতে চারা গাছের কচি ডগা ও পাতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
শিকড় ছাঁটাই ও গ্রেডিং
উদ্ভিদ শিকড় দ্বারা মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। পলিব্যাগে চারায় অনেক সময় চারার শিকড় পলিব্যাগে ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। এসব শিকড় চারার স্থানান্তরে অসুবিধার সৃষ্টি করে থাকে। তাই সাবধানে ধারালো কাঁচি দিয়ে হেঁটে দিতে হবে।
শিকড় ছাঁটাই করার পর চারার বৃদ্ধি অনুযায়ী প্রায় একই উচ্চতার শিকড় চারাকে আলাদাভাবে সাজিয়ে রাখতে হয়। একে গ্রেডিং বলে। থ্রেডিং এর ফলে পাশাপাশি থাকা একটি চারা অন্যটিকে আলো-বাতাস পেতে কোন রকম অসুবিধার সৃষ্টি করে না।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
নার্সারিতে চারাগাছে বিভিন্ন প্রকারের রোগ ও পোকার আক্রমণ হতে পারে। চারা উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে ড্যাম্পিং অফ নামক ছত্রাকবাহিত একটি রোগ। বীজ ও চারা উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে বীজ আক্রান্ত হলে চারা গজায় না।
আর গজানোর সাথে সাথে আক্রান্ত হলে অঙ্কুর নষ্ট হয়ে যায়। চারা আক্রান্ত হলে মাটির কাছাকাছি গোড়া ঢলে বা নেতিয়ে পড়ে। শিকড় আক্রাড় হলে চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। বীজতলা বাপলিব্যাগের মাটি স্যাতস্যাতে থাকলে এবং মাটিতে বায়ু চলাচল কম হলে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
১. বীজ বপনের পূর্বে মাটি ও বীজ শোধন করতে হবে।
২. পরিমিত পরিমাণে সেচ এবং প্রয়োজনীয় নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ডারায় রোগের আক্রমণ দেখামাত্র উপরের শেড সরায়ে ফেলতে হবে।
8. বেশি ঘন করে বীজ বপন করা
৫. কোন জৈব সার যেমন- গোবর মাটিতে প্রয়োগ করা যাবে না।
৬. আকড়ে স্থানে ডায়থেন এম-৪৫ বা কুপ্রাভিট নামক ছত্রাকনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
ইউক্যালিপটাস, পাইন ইত্যাদি উদ্ভিদের চারায় কম বেশি এ রোগ হ্যা। অন্যান্য হাক রোগের মধ্যে মূল পচা, আগা মরা পাতার নাগ অন্যতম। এদের দমনে কুপ্রাভিট, ভারে এম-৪৫, বার্দো মিক্সার, ফরমালিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা চারা আক্রান্ত হলে রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র চারাকে তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বীজতলায় বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। ক্ষতিকারক পোকামাকড় কচি চারার ডগা ও পাতার রস চুষে কিংবা চিবিয়ে খেয়ে চারাকে না করে ফেলে।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ডায়াজিনন ৬০ ইসি, লিবাসিড ৫০ ইসি, ডাই এলড্রিন ২০ ইসি, সুমাগিয়ন ৫০ ইসি ইত্যাদি যে কোন কীটনাশক নির্দিষ্ট মাত্রার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
হার্ডেনিং
নার্সারিতে চারা যথেষ্ট যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে বেড়ে ওঠে। ফলে ছারাকে যখন নার্সারির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে তুলে নতুন পরিবেশ রোপণ করা হয় তখন অনেক সময় চারা মারা যায়। সেজন্য নতুন পরিবেশে রোপণের মাস খানেক পূর্ব থেকেই বিভিন্ন উপায়ে চারাকে কিছুটা শক্ত ও কষ্ট সহিষ্ণু করা হয়।
একেই হার্ডেনিং বলে। নার্সারিতে চারাকে হার্ডেনিং করার উপায়সমূহ হলো-
১. চারার বৃদ্ধির সাথে সাথে শেড সরিয়ে চারাকে রোদের সংস্পর্শে আনা এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে শেড সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলা।
২. সেচেনা পরিমাণ ক্রমশ কমানো
৩. চারার উচ্চতা অনুযায়ী গ্রেভিং করা।
৪. পলিব্যাগের বাইরে আসা শিকড় মন মন ছাঁটাই করা।
৫. ইউরিয়া সার প্রয়োগ বন্ধ করা।
চারা সজ্জিতকরণ ও লেবেলিং
নার্সারিতে চারা বাছাই করে তা সুন্দরভাবে সাহিত্যে চিহ্নিতকরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ। মরা ও দুর্বল চারা কোন সময় নার্সারির প্রবেশ পথে রাখা উচিত নয়। কেননা এতে গ্রাহকগণ উৎসাহ হারাবেন। চারাগুলোতে ট্যাগ বা লেবেল লাগালে গ্রাহকগন তারা না করতে আস্থাবান হবেন। চার বা পাতা বা কান্ড কোন দিয়ে ধরতে নেই।
পলিব্যাগ বা টবে হাত দিয়ে চারা উঠাতে হবে। চারা পরিবহনের সময় বাঁশের ঝুড়ি বা কাঠের বাক্স ব্যাবহার করা উচিত।
ডারা পরিবহন
নার্সারি থেকে চারাকে রোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। চারা আঘাতপ্রাপ্ত হলে কিংবা শিকড়ের মাটি আলগা হয়ে পড়ে গেলে রোপণের পর চারা বাঁচানো কষ্টকর। সাধারণত পলিব্যাগের ঢাকা পরিবহন সুবিধাজনক।
বীজতলা থেকে পরিমিত মাটিসহ চারা তুলে সাবধানতার সাথে রোপণ স্থানে নিয়ে গেলে রোপণের পর চারা মরার হার অনেক কমানো যায়।
সারমর্ম
নার্সারিতে সুস্থ ও সবল চারা পেতে হলে বীজ বপনের পর অঙ্কুরিত চারার गान যত্ন নেয়া আবশ্যক। এসব পরিচর্যাসমূহ হলো- চারার ছায়া প্রদান, সেচ-নিকাশ, মালচিং, সার প্রয়োগ, শিকড় ছাঁটাই, গ্রেডিং, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা এবং হার্ডেনিং।