চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। চিচিঙ্গা হচ্ছে ঝিঙের মতো কিন্তু আরও লম্বা বা কখনও সাপের মত পেঁচানো, অপেক্ষাকৃত নরম সবজি। একে কখনো কইডা বা দুধকুুুশি বা হইডা বলা হয়ে থাকে। এর ইংরেজি নাম Snake gourd আর বৈজ্ঞানিক নাম Trichosanthes cucumerina। এটি ঝিঙে, লাউ, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির মতই কিউকারবিটেসি পরিবারের সদস্য। চিচিঙ্গা বাংলাদেশের সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি।
Table of Contents
চিচিঙ্গা চাষ
চিচিঙ্গা গাছের পাতা ২৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফুলগুলি উষ্ণ, সাদা আঁশ নিয়ে রাতে পাপড়ি মেলে , পাপড়িগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় চুলের মতো সাদা আঁশ গুলো কিছুটা মুটিয়ে আসে, তবে রাতের বেলা সাদা রেখার কারণে নীল রঙের ফলগুলো দেখা যায় (নিচের গ্যালারীতে ফটো দেখুন)। চিচিঙ্গা ফল ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পেকে গেলে লাল বর্ণ ধারণ করে এবং বীজ সংগ্রহ করা যায়। এদের একটি জাত হলো জাপানি চিচিঙ্গা। এটি কিছুটা গোলাকৃতির হয় এবং ৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃত্তাকার হয়। চট্টগ্রামে এটিকে হইডা ও গোপালগঞ্জে কুশি নামে ডাকা হয়।
চিচিঙ্গার অনেক ঔষধী গুণ আছে। চিচিঙ্গার ১০০ ভাগ ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৫ ভাগ পানি, ৩.২-৩.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৪-০.৭ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিঃগ্রাঃ ক্যালসিয়াম, ০.৫-০.৭ মিঃগ্রাঃ লৌহ এবং ৫-৮ মিঃগ্রাঃ খাদ্যপ্রাণ সি আছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম চিচিঙ্গার পুষ্টি তথ্য:
আয়রন | ৫.৭০% |
আয়োডিন | ৫.৯০% |
কোলেস্টেরল | ০.০ মিলিগ্রাম |
ক্যালোরি | ৮৬.২ কিলোক্যালরি |
খনিজ পদার্থ: ক্যালসিয়াম | ৫.১০% |
খাদ্যতালিকাগত ফাইবার | ০.৬ গ্রাম |
দস্তা | ৭.২০% |
পটাশিয়াম | ৩৫৯.১ মিগ্রা |
প্রোটিন | ২.০ গ্রাম |
ফসফরাস | ৫.০০% |
ভিটামিন ই | ১.১০% |
ভিটামিন বি৬ | ১১.৩০% |
ভিটামিন সি | ৩০.৫০% |
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস: ভিটামিন: ভিটামিন এ | ৯.৮০% |
মোট কার্বোহাইড্রেট | ১২.৫ গ্রাম |
ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস: মোট ফ্যাট | ৩.৯ গ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | ৬.৭০% |
ম্যাঙ্গানিজ | ১২.৫০% |
সোডিয়াম | ৩৩.০ মিলিগ্রাম |
স্যাচুরেটেড ফ্যাট | ০.৫ গ্রাম |
চিচিঙ্গা চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:
উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় চিচিঙ্গা ভাল জন্মে। শীতের দু’ তিন মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় চিচিঙ্গা জন্মানো যায়। সব রকম মাটিতে চিচিঙ্গার চাষ করা যায় তবে জৈব সার সমৃদ্ধ দো-আশঁ ও বেলে দো-আশঁ মাটিতে ভালো জন্মে।
জাত
বিএডিসি ‘ঝুম লং’ নামের একটি জাতের বীজ উৎপাদন করছে। এর ফল নীলাভ কালচে সবুজ ও দীর্ঘ। ফলধারী আরো একটি জাত ‘সাদা সাভারী’ নামে পরিচিত। তাছাড়া তিস্তা, তুরাগ, সুরমা, রূপসা, বিভিন্ন জাত এদেশে চাষ হয়।
চিচিঙ্গার জীবন কাল:
মোট জীবনকাল প্রায় পাঁচ মাস। তবে জাত ও আবহাওয়া ভেদে সময় কমবেশী হতে পারে।
চিচিঙ্গার উৎপাদন মৌসুম:
এদেশে চিচিঙ্গা প্রধানত খরিফ মৌসুমেই হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে যে কোন সময় চিচিঙ্গার বীজ বোনা যেতে পারে।
চিচিঙ্গা চাষের জন্য বীজের হার:
চিচিঙ্গার জন্য হেক্টর প্রতি ৪-৫ কেজি (১৬-২০ গ্রাম/শতাংশ) বীজের প্রয়োজন হয়। জাত ভেদে শতক প্রতি ১২ – ১৫ গ্রাম। উন্নত জাতঃ সুরমা এফ-১, তিস্তা, বারি চিচিঙ্গা-১।
চিচিঙ্গার কৃত্রিম পরাগায়ন:
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশেপাশে অন্য জাতের চিচিংগার গাছ থাকলে নির্বাচিত গাছের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগে (সকাল ৯ঃ০০ ঘটিকা থেকে দুপুর ২ঃ০০ ঘটিকার মধ্যে) পেপার ব্যাগ দ্ধারা বেধেঁ নিতে হবে। অতঃপর ফুল ফোটার পর কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হবে এবং পরাগায়ণ শেষে স্ত্রী ফুলটি আবার ব্যাগিং করে রাখতে হবে। ৩-৪ দিন পর ব্যাগ খুলে ফেলা যাবে। কৃত্রিম পরাগায়ণ অবশ্যই সকাল ৬ঃ০০ ঘটিকা থেকে ৯ঃ০০ ঘটিকার মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে।
চিচিঙ্গার অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা:
অন্য ফসলের মতোই ভালো ফলন পেতে গেলে চিচিঙ্গার পরিচর্যা জরুরী। যেমন – আগাছা সবসময় পরিষ্কার করে সাথে সাথে মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। পাশাপাশি খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। এরপর বাউনী দেয়া চিচিঙ্গার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মিটার উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে । বাউনী দিলে ফলন বেশী ও ফলের গুনগত মানও ভালো হয়।
চিচিঙ্গা চাষে সেচ:
চিচিঙ্গা গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয় বলে তখন সবসময় পানি সেচের প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। তখন অনেক সময় কারণ বৃষ্টিই থাকে না। উক্ত সময়ে ৫-৬ দিন অন্তর নিয়মিত পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
চিচিঙ্গা চাষে সার প্রয়োগ:
২০ কেজি গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ, সমুদয় জিপসাম, দস্তা, বোরণ জমি তৈরির সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট গোবর (মাদা প্রতি ৫ কেজি), টিএসপি (মাদা প্রতি ৩০ গ্রাম), ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ২০ গ্রাম), সমুদয় ম্যাগনেসিয়াম (মাদা প্রতি ৫ গ্রাম) চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম বার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম), ৩০-৩৫ দিন পর ২য় বার, ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় বার ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | শতক প্রতি সার |
কম্পোস্ট | ৮০ কেজি |
ইউরিয়া | ৭০০ গ্রাম |
টিএসপি | ৭০০ গ্রাম |
পটাশ | ৬০০ গ্রাম |
জিপসাম | ৪০০ গ্রাম |
চিচিঙ্গা চাষে পোকামাকড়ঃ
- রেড পামকিন বিটল-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- সুড়ঙ্গকারী পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- জাব পোকা-হলুদ রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করুন।আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- ফলের মাছি পোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে রোগবালাইঃ
- ডাউনি মিলডিউ রোগ-ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ রিডোমিল গোল্ড ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- পাতায় দাগ রোগ-কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ ডিলাইট ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- চিচিঙ্গার পাতা কুঁকড়ানো রোগ-বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২ মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে সতর্কতাঃ
বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যাবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যাবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না।
চিচিঙ্গা ফসল সংগ্রহ ও ফলন:
চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর চিচিঙ্গার গাছ ফল দিতে থাকে। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১০-১৩ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই আড়াই মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চিচিঙ্গার হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ)
চিচিঙ্গা সংরক্ষনঃ
ঠান্ডা ও বাতাস চলাচল করা জায়গাতে ফল ঘষা বা চাপ খায় না এমন ভাবে সংরক্ষণ করুন। বীজ বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে নিমের তেল মিশিয়ে রাখতে পারেন। কিছুদিন পর পর বীজ হালকা রোদে শুকিয়ে নিবেন।
চিচিঙ্গা বা কইডা বা কুশি বা হইডা গ্যালারী: