জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

 

জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

 

জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

মাটির উর্বরতা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এমনকি একই জমির বিভিন্ন অংশের উর্বরতার মাত্রা ভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেসব কারণসমূহ মাটির উর্বরতার উপর প্রভাব বিস্তার করে সেগুলোকে
মূলতঃ দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে- প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক প্রভাবক এবং কৃত্রিম প্রভাবক ।

প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক প্রভাবক

এসব কারণ মাটি সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেমন –

মাটির আদি শিলা

মাটি যেসব শিলা দ্বারা গঠিত সেসব শিলায় বিদ্যমান খাদ্যোপাদানের সংখ্যা এবং পরিমাণ যত বেশি সে মাটি তত বেশি উর্বর।

মাটির বয়স

যে মাটির বয়স খুব বেশি সে মাটি বিভিন্ন কারণে য়প্রাপ্ত হয়ে তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলে।

জলবায়ু ও গাছপালা

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু বিভিন্ন ধরনের, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের বৃ কুলও ভিন্নতর হয়। মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ, ভূমি য়, খাদ্যোপাদান চুয়ানির মাত্রা ও পরিমাণ ইত্যাদির উপর মাটির উর্বরতার তারতম্য হয়। যেমন- আফ্রিকার নিরীয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে গড়ে ওঠা ঘন বনাঞ্চলের মাটি থেকে খাদ্যোপাদান চুইয়ে চলে যায় এবং সেখানে উর্বরতা কম। অন্যদিকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে তৃণভূমির। সেখানে তৃণ আচ্ছাদিত জমিতে জৈব পদার্থ বেশি যোগ হওয়ায় মাটি খুব উর্বর। যেমন- উত্তর আমেরিকার প্রেইরী অঞ্চল, রাশিয়ার ষ্টেপস্ অঞ্চলের শেরনোজেম (Chernozem) মাটি। তাছাড়া উষ্ণ অঞ্চলে জৈব পদার্থের দ্রুত বিয়োজনের ফলে উর্বরতা খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়। অন্যদিকে কম উষ্ণ অঞ্চলে বৃষ্টি ও তাপের প্রকোপ কম থাকায় জৈব পদার্থ সহজে নষ্ট হয় না।

ভূমির বন্ধুরতা

ভূমির বন্ধুরতা মাটির উর্বরতার উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে। পাহাড়ী এলাকায় বৃষ্টিপাত হলে ভূমি য় বেশি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যেপাদান পানির সাথে দ্রবীভূত হয়ে নিচে চলে আসে। এতে পাহাড়ী জমি কম উর্বর এবং পাহাড়ের পাদদেশের মাটি অধিক উর্বর হয়ে থাকে। নদী বাহিত পলিমাটিসমৃদ্ধ এলাকার মাটিও অধিকতর উর্বর হয়ে থাকে।

জলাবদ্ধতা

বেশীদিন ধরে জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকলে মাটিতে নানাবিধ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে অনেক সময় গাছের গ্রহনোপযোগী খাদ্যোপাদন অগ্রহনোপযোগী হয়ে যায়। যেমন- গন্ধক, দস্তা ইত্যাদি।

মাটির বিক্রিয়া (p” মান)

মাটির গঠনের সময় আদি শিলার প্রকৃতি অনুযায়ী মাটির p” মানের কম বেশি হয়। এজন্য মাটিতে ফসফরাস, লৌহ, এল্যুমিনিয়াম, বোরণ, মলিবডেনাম ইত্যাদি খাদ্যোপাদান দ্রবণ ফসলে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে ।

ভূমিয়

মাটির উপরের স্তরের উর্বরতা সবচাইতে বেশি। বিভিন্ন নৈসর্গিক কারণে (বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি) মাটি একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়ে যাবার দরুন মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। যে স্থান থেকে মাটি য় হয়ে চলে যায় সে স্থান অনুর্বর হয়ে পড়ে এবং সেখানে ফসলের চাষাবাদ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

মাটির বুনট

মাটির বুনট তিন প্রকারের মাটি কণা দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর মাটিকণার নামকরণ করা হয় মাটিকণার ব্যাসের উপর ভিত্তি করে, যেমন- বেলে কণার মাপ হলো ০.০২-২.০ মিলমিটার, পলিকণা ০.০০২-০.২ মিলমিটার এবং কর্দমকণা ০.০০২ মিলমিটার এর কম ব্যাসবিশিষ্ট। যে মাটি যত বেশি হালকা বুনটের, অথাৎ বেলে ধরনের সে মাটি তত বেশি অনুর্বর। আর ভারী বুনটের মাটি অর্থাৎ এঁটেল ধরনের মাটি বেশি উর্বর হয়ে থাকে।

কৃত্রিম প্রভাবক

যেসব বিষয় বা কার্যকলাপ ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং মানুষ কর্তৃক পরিচালিত সেগুলো কৃত্রিম প্রভাবক। নিম্নে এগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো :

ভূমি কর্ষণ

মাটির আলোড়ন বা চাষের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধির সহায়ক কার্যকলাপকে ভূমিকর্ষণ বলে। নিয়ম মত ও সুপরিকল্পিতভাবে চাষ করা না হলে ভূমির উর্বরতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। জমি উত্তমরূপে চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করা হলে গাছের শিকড় সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায়, জৈব ও অজৈব সব ধরনের সার ভালভাবে মাটিতে মিশে সমভাবে সর্বত্র খাদ্যোপাদান সরবরাহ করতে সহায়তা করে। অকর্ষিত বা অসম্পূর্ণভাবে কৰ্ষিত মাটিতে তা হয় না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অতিরিক্ত কর্ষিতাবস্থা ভুমি য়কে ত্বরান্বিত করতে পারে।
উঁচুনিচু বা পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ করার সময় জমিতে ঢাল বরাবর এবং আড়াআড়িভাবে চাষ দিলেও শেষ চাষটি অবশ্যই ঢালের আড়াআড়িভাবে হতে হবে। নইলে বৃষ্টির পানিতে অবশ্যই ভূমি য় এবং খাদ্যোপাদানের অপচয় হবে।

 

মাটিতে সার প্রয়োগ

ফসল উৎপাদনের জন্য জমিতে সার প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। সারের মাধ্যমে সাধারণতঃ মুখ্য খাদ্যোপাদানগুলোর দু’তিনটা মাত্র সরবরাহ করা হয়। কারণ গাছ নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম অধিক পরিমাণে পরিশোষণ করে বলে মাটিতে এদের অভাব তাড়াতাড়ি দেখা দেয়।

অন্যান্য গৌণ খাদ্যোপাদান খুব অল্প পরিমাণে পরিশোষিত হওয়ায় সাধারণতঃ মাটিতে সঞ্চিত পরিমাণই যথেষ্ট হয়। তবে এদের অভাব ল ণ দেখা দিলে অবশ্যই এসব খাদ্যোপাদান প্রয়োগ করার প্রয়োজন দেখা যায়। যেমন, দস্তা ও গন্ধক ।

জৈব পদার্থের প্রয়োগ

জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণস্বরূপ। জৈব সার প্রয়োগের ফলে মাটির ভৌত গুণাবলীর উন্নতি হয়। জৈব পদার্থ বেলে মাটিতে মাটিকণাকে একসাথে ধরে রাখে, ফলে পানি ধারণ মতা বাড়ে। আবার এঁটেল মাটিতে মাটির কণাগুলোকে পরস্পর থেকে দুরে ঠেলে দিয়ে মাটিতে আলোবাতাস ও পানি চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করে।

জৈব পদার্থ মাটিতে প্রয়োগ করা হলে মাটির উপকারী অণুজীবের সংখ্যা ও কার্য মতা বৃদ্ধি করে, জটিল জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে খাদ্যোপাদান গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আনতে সহায়তা করে। জৈব পদার্থ মাটিতে বিভিন্ন গৌণ খাদ্যোপাদান যোগ করে মাটির উর্বরতা সংর ণ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জৈব সার গোবর, কম্পোস্ট ও সবুজ সারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে ।

ফসল চাষের নিবিড়তা

একটি জমিতে এক বৎসরে যতবার ফসল উঠানো হয় তার শতকরা হিসাব মানকে ফসল চাষের নিবিড়তা বলে। যেমন, একটি জমি থেকে এক বৎসরে একটি পাট ফসল ও একটি রোপা আমন ধান চাষ করলে এ জমির ফসল চাষের নিবিড়তা হবে ২০০%। ফসল চাষের নিবিড়তা যত বেশি হবে জমির উর্বরতা তত কমবে। কারণ একটি জমিতে যত বেশিবার ফসল চাষ করা হবে, সে মাটির খাদ্য ভান্ডারও তত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে উর্বরতা কমে আসবে।

আগাছা দমন

ফসল উৎপাদনের সময় অবশ্যই আগাছা দমন করতে হয়। এতে আগাছা কর্তৃক গৃহীত কিছু পরিমাণে খাদ্যোপাদান জমিতে ফেরৎ দেওয়া সম্ভব হয়, যদি আগাছা জমিতে পচতে দেওয়া যায়। এতে মাটিতে কিছু জৈব পদার্থ যোগ হয়ে থাকে। তবে আগাছা যাতে জমি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে জমির উর্বরতা কমাতে না পারে, সেদিকে ল্য রেখে সময়মত আগাছা দমনে তৎপর হতে হবে।

সবুজ সার ফসল চাষ

সবুজ সার ফসল যেমন- ধৈঞ্চা, শনপাট, বরবটি (গো-মটর) ইত্যাদি ফসল চাষ করে নরম এবং সবুজ অবস্থায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ যোগ হয়। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং মাটির ভৌত গুণাবলীর উন্নতি হয়।

শস্য পর্যায়

ফসল উৎপাদনে যেসব েত্রে উপযুক্ত শস্য পর্যায় অবলম্বন করা হয়, সেসব েত্রে মাটির উর্বরতা সংর িত হয়ে থাকে। যেমন, একটি সুপরিকল্পিত শস্য পর্যায়ে গভীর ও অগভীরমূলী ফসল মাটির নিচের এবং উপরের স্তরের খাদ্যোপাদান পরিশোষণ করবে। তন্ডুল জাতীয় ফসল, সব্জি ফসল ও আঁশ বা কন্দল জাতীয় ফসল খাদ্যোপাদানগুলো সমভাবে গ্রহণ করে না।

অন্যদিকে জমিতে এক জাতীয় ফসল বারবার চাষ করলে বিশেষ কতকগুলি খাদ্যোপাদান বেশি পরিমাণে পরিশোষিত হয়। ফলে অল্প সময়ে এসব খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সুপরিকল্পিত ভাবে শস্য পর্যায় অবলম্বন করলে খাদ্যোপাদান সুষম ভাবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য সুপরিকল্পিত শস্য পর্যায় মাটির উর্বরতা সংরণে সাহায্য করে।

শস্য পর্যায়ের সবুজ সার ফসল জমিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ যোগ করে। আচ্ছাদন ফসল ও পরিচ্ছন্ন কর্ষণ ফসল (যেমন- তামাক, আলু) আগাছা দমনে সাহায্য করে

 

জমির উর্বরতার প্রভাবকসমূহ

 

পানি ব্যবস্থাপনা

ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে জমিতে পানির অভাব দেখা দেয়, বিশেষত যখন বৃষ্টিপাত কম হয় অথবা আদৌ হয় না তখন সেচের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পানি সেচের ফলে খদ্যোপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয়ে আয়নিক আকারে গাছে প্রবেশ করে।

অন্যদিকে অতিবৃষ্টি, বন্যা বা জমির জলাবদ্ধতার সময় পানি অপসারণ না করা হলে গাছের শ্বাসকার্য ঠিকমত চলে না। তাছাড়া অনেক খাদ্যোপাদান অপরিশোষনযোগ্য আকারে রূপান্তরিত হয়ে মাটির উর্বরতার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।

Leave a Comment