দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ  দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা। এটি কৃত্রিম প্রজনন ও খামার স্থাপন এর দুগ্ধ খামার স্থাপন ইউনিটের অন্তর্গত।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

Table of Contents

 দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

দুগ্ধ খামার হলো শিল্প কারখানার মতো। মোটর কোম্পানীতে যেমন ষ্টিল, রাবার, প্লাস্টিক, শ্ৰমিক ইত্যাদি ব্যবহার করে গাড়ি তৈরি করা হয় ঠিক তেমনি দুগ্ধ খামারেও শ্রমিক, জমি, হে, সাইলেজ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি ব্যবহার করে গাভী থেকে দুধ উৎপাদন করা হয় । তবে দুধ উৎপাদনের জন্য এই কাজগুলো করতে হয় ধাপে ধাপে এবং পরিকল্পনামাফিক । দুগ্ধ খামারের এই প্রক্রিয়াটিই হলো ব্যবস্থাপনা ।

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনায় যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয় সেগুলো হলো-

  • গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা (Care and management of cow during and after parturition)
  • বাসস্থান (Housing )
  • দুগ্ধবতী বাছুর পালন ( Raising dairy calf)
  • দুগ্ধ খামারে তথ্য সংরক্ষণ (Keeping records in dairy farm)
  • অন্যান্য ব্যবস্থাপনা (Other management )

গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা (Care and management of cow during and after parturition)

দুগ্ধ খামারের সফলতা নির্ভর করে সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার উপর । গাভী থেকে অধিক পরিমাণে দুধ উৎপাদনের জন্য এবং সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম বাচ্চা পাওয়ার জন্য গর্ভকালীন ও প্রসবের সময় গাভীর বিশেষ ধরনের যত্ন নেওয়া উচিত । এই কোর্স বইটির পাঠ ১.৬ মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

বাসস্থান (Housing)

পরিকল্পনামাফিক উপযুক্ত বাসস্থান ব্যতীত কখনোই দুগ্ধ খামারের সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। অপরিকল্পিত বাসস্থান অনেক সময় দুগ্ধ খামারকে অলাভজনক করে তুলতে পারে । সঠিক বাসস্থানের মাধ্যমে একদিকে যেমন গাভীর আরামদায়ক অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে অন্যদিকে তেমনি বাসস্থান যেন স্বাস্থ্যসম্মত, দীর্ঘস্থায়ী ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দুধ উৎপাদনের উপযোগী হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে । এই কোর্স বইটির পাঠ ২.১ এর স্থান নির্বাচন ও বাসস্থান অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ।

দুগ্ধবতী বাছুর পালন (Raising dairy calf)

একটি গাভীর খামার কতোটা সফলতা লাভ করবে তা নির্ভর করে ঐ খামারে বাছুর কিভাবে পালন করা হচ্ছে । ভালো গাভী কখনোই ক্রয় করা যায় না, খামারে তৈরি করতে হয় । অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের দেশে বাছুরের মৃত্যুর হারও অনেক বেশি । একটি ভালো গাভী যেমন একটি ভালো বাছুরের জন্ম দেয় তেমনি একটি ভালো বাছুর একটি ভালো গাভী হতে পারে ।

সাধারণত দু’ভাবে বাছুর পালন করা হয়ে থাকে—

ক. বাছুরকে তার মায়ের কাছে থাকতে দেওয়া হয় এবং দোহনের পূর্বে ও পরে অল্প পরিমাণে মায়ের দুধ পান করতে দেওয়া হয় ।

খ. গাভী থেকে পৃথক রেখে বাছুর পালন : এক্ষেত্রে জন্মের ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বাছুরকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে আবার কলস্ট্রাম খাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত বাছুরকে মায়ের কাছে রেখে দেয়। পরবর্তীতে একেবারে পৃথকভাবে বাছুরের খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে । এই পদ্ধতিটির নাম “দুধ ছাড়ানো পদ্ধতি” বা উইনিং সিস্টেম (Weaning system)। এই পদ্ধতিটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অধিক বিজ্ঞানসম্মত । বৈজ্ঞানিকভাবে বাছুর পালন কার্যক্রম নিচে আলোচনা করা হলো—

জন্মের পূর্বেই বাছুরের খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা

বাছুর গাভীর গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই তার পালন শুরু হয়ে থাকে । গাভীকে সঠিকভাবে খাদ্য না দিলে এবং উপযুক্ত পরিচর্যা প্রদান না করলে দূর্বল বাছুর প্রসবের সম্ভাবনা থাকে । এজন্য বাছুরের সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রসবের ৩ থেকে ৫ মাস পূর্ব থেকেই গাভীর প্রতি নজর দেওয়া উচিত ।

জন্মের পরপরই বাছুরের যত্ন

বাছুর জন্মানোর পরপরই তার নাক-মুখ থেকে শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে গাভীকে চাটতে দিতে হবে । শীতকালে খেয়াল রাখতে হবে যেন বাছুরের ঠান্ডা না লাগে। অতপর জীবাণুমুক্ত কাঁচি দিয়ে নাভীর রজ্জু কেটে টিংচার আয়োডিন লাগিয়ে দিতে হবে ।

 

 

বাছুরকে খাওয়ানোর পদ্ধতি

বাছুরকে দু’পদ্ধতিতে খাওয়ানো যায় । যেমন—

ক. স্বাভাবিক উপায়ে খাওয়ানো (Natural feeding) :

এ পদ্ধতিতে দুধ দোহনের আগে ও পরে বাছুরকে তার মার বাঁট চুষে খেতে দেওয়া হয় । এতে বাছুর অনেক সময় প্রয়োজনমত দুধ খেতে পায় না । এছাড়াও বাছুর কতোটা দুধ খেলো সে সম্পর্কেও জানা যায় না ।

খ. কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো (Artificial feeding) :

বাছুরকে যখন তার মার কাছ থেকে সরিয়ে পৃথকভাবে পালন করা হয় তখন কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো হয়ে থাকে । এ পদ্ধতিতে আবার দু’ভাবে খাওয়ানো হয়ে থাকে । যেমন—

১. নিপলে খাওয়ানো (Nipple pail) :

এই পদ্ধতিতে দুধের পাত্রের সাথে নিপল লাগানো থাকে । বাছুরকে শিখিয়ে দিলেই বাছুর খুব সহজেই নিপলে দুধ খেতে শিখে ।

২. বালতিতে খাওয়ানো ( Pail feeding) :

সাধারণত নবজাত বাছুর প্রথমে সরাসরি বালতি বা পাত্রে দুধ খেতে চায় না, সেক্ষেত্রে বাছুরকে দুধ খেতে শেখাতে হয় । পাত্রে দুধ রেখে বাছুরের মুখটা পাত্রের কাছে নিয়ে আসতে হবে। প্রথমে হাতের একটি আঙ্গুল বাছুরকে চুষতে দিতে হবে এবং হাতটা আস্তে আস্তে নামিয়ে দুধের পাত্রে নিয়ে বাছুরের মুখ কাছে এনে আঙ্গুলটা সরিয়ে নিতে হবে। বাছুর দুধের স্বাদ পেলে খেতে শুরু করবে । বাছুরকে বেশ কিছুক্ষণ খেতে না দিয়ে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে দ্রুত কার্যকর হয় । বাছুর এভাবে পাত্রে দুধ খেতে শিখলে প্রতিটি বাছুরকে পৃথক পাত্রে বা বালতিতে দুধ খাওয়ানো হয় ।

তবে বালতিতে খাওয়ানোর তুলনায় উঁচুস্থানে সংরক্ষিত নিপল হতে দুধ খাওয়ানো বাছুরের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী । কারণ এ পদ্ধতিতে বাছুর ঘাড় সোজা করে দুধ টানে। ফলে কিছু দুধ সরাসরি অ্যাবোমেজামে চলে আসে। এ দুধ সরাসরি এনজাইমেটিক ডাইজেশন হওয়ায় বাছুরের পুষ্টিতে অধিকতর সহায়ক । একটু খেয়াল করলে দেখাযাবে, গাভী হতে বাছুর প্রকৃতির এনিয়মেই দুধ পান করে ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

 বাছুরের খাদ্য

বাছুরের প্রাথমিক খাদ্য হলো কলস্ট্রাম বা কাচলা দুধ। জন্মের পর থেকে অন্তত ৩ দিন পর্যন্ত বাছুর যাতে দৈনিক ২ থেকে ২.৫ লিটার পরিমাণ কলস্ট্রাম খেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে ।

বাছুরকে গাভীর দুধ (Whole milk) খাওয়াতে হলে কিছু নিয়ম অনুসরণ করা উচিত । যেমন—

১. দুধ সংগ্রহ করার পরপরই বাছুরকে খাওয়াতে হবে ।

২. পরে খাওয়াতে চাইলে শরীরের তাপমাত্রার সাথে সংগতি রেখে দুধ গরম করে খাওয়াতে হবে।

৩. ৭ দিন বয়স পর্যন্ত দৈনিক ৩ থেকে ৪ বার এবং এরপর দৈনিক দু’বার খাওয়াতে হবে ।

এছাড়াও বাছুরকে ননীবিহীন দুধ (Skim milk), শুষ্ক ননীবিহীন দুধ (Dried skim milk), ছানার পানি (Whey) ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে । সাধারণত দু’সপ্তাহ বয়স থেকে বাছুরকে “কাফ স্টারটার” (Calf starter) প্রদান করা যেতে পারে । জন্মের ৭-১৫ দিনের মধ্যে বাছুরকে দানাদার মিশ্রণ খাওয়ানো শুরু করা যেতে পারে । ৩ থেকে ৬ মাস বয়সে বাছুরকে অল্প অল্প করে সাইলেজ খাওয়ানো যায় ।

দুধ ছাড়ার পর বাছুরকে কচি ঘাস খাওয়ানো যায় । বাছুরকে চারণভূমিতে চরে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বাছুর যেন সবসময় পরিষ্কার পানি পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । বাছুরের খাদ্যে যেন প্রয়োজনমত খাবার লবণ, খনিজ পদার্থ থাকে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে । প্রয়োজনবোধে বাছুরের খাবারের সাথে খনিজ মিশ্রণ সরবরাহ করা যেতে পারে । পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, অ্যান্টিবায়োটিক বাছুরের বৃদ্ধিতে ভালো ভূমিকা রাখে । সুতরাং বাছুরের খাবারের সাথে পরিমাণমত অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করা যেতে পারে ।

বাছুরের বাসস্থান

বাছুরের ঘর গাভীর ঘরের কাছাকাছি হওয়া বাঞ্ছনীয় । প্রতিটি বাছুরের জন্য ১০ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন । বাছুরের ঘরের সাথে সরাসরি সংযুক্ত একটি খোলা জায়গা থাকতে হবে যেখানে বাছুর দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে এবং এতে করে তার ব্যায়াম হবে । বাছুরের ঘর সংলগ্ন একটি খাবার ঘরও থাকতে হবে । এছাড়া বাছুরের ঘরে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে । সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য যদি সম্ভব হয় বিভিন্ন বয়সের বাছুর যেমন – ৩ মাসের কম বয়স্ক বাছুর, ৩-৬ মাস বয়সী বাছুর এবং ৬ মাসের বেশি বয়স্ক বাছুর আলাদা আলাদা রাখা যেতে পারে ।

বাছুরের ডিহর্নিং (Dehorning the calf)

ডিহর্নিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে রাসায়নিক বস্তু ব্যবহার করে বা যান্ত্রিকভাবে বা বৈদ্যুতিক ডিহর্নারের সাহায্যে শিং কেটে ফেলা হয় । সাধারণত বাছুরের জন্মের ১০ দিনের মধ্যে ডিহর্নিং করা ভালো । ডিহর্নিং করার পদ্ধতিগুলো হলো- –

ক. রাসায়নিক পদ্ধতি ঃ এক্ষেত্রে রাসায়নিক বস্তু হিসেবে কস্টিক পটাশ ব্যবহার করা হয় ।

খ. যান্ত্রিক পদ্ধতি ঃ বিশেষভাবে তৈরিকৃত কর্তন যন্ত্র বা করাত ব্যবহার করে অথবা রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে ।

গ. বৈদ্যুতিক ডিহর্নার ব্যবহার করে ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

বাছুর চিহ্নিতকরণ (Marking the calf)

বাছুর চিহ্নিতকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খামার ব্যবস্থাপনা । বাছুর চিহ্নিতকরণের যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো—

ব্রান্ডিং (Branding) :

সংখ্যা, অক্ষর, ডিজাইন বা এসবের সংযোগে তপ্ত লোহা বা রাসায়নিক দ্রব্যের (তরল নাইট্রোজেন) মাধ্যমে ত্বকে ছাপ দিয়ে বাছুর শনাক্তকরণ পদ্ধতিই হলো ব্রান্ডিং ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

ট্যাটুইং (Tattoing) :

এই পদ্ধতিতে নম্বর লাগানোর জন্য একটি ট্যাটুইং সেট থাকে এবং সেই সেটে থাকে একটি ট্যাটুইং ফরসেপ (চিত্র- ১৮), ট্যাটুইং কালি এবং একটি অনুক্রমিক যুক্ত সংখ্যা বা অক্ষর । সাধারণত কানের ভেতর পাশে আলতোভাবে ট্যাটুইং করা হয় ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

ইয়ার ট্যাগিং (Ear tagging) :

নম্বরযুক্ত হালকা ধাতুর পাত বা শক্ত প্লাসটিকের তৈরি ট্যাগ সুনির্দিষ্ট ট্যাগিং ফরসেপের সাহায্যে বাছুরের কানে ঝুলিয়ে চিহ্নিতকরণের নামই ইয়ার ট্যাগিং ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

এছাড়া গলায় ট্যাগ নম্বর ঝুলিয়ে বা কানে ছোট ছোট দাগ কেটে বা স্বল্প সময়ের জন্য শরীরে রং লাগিয়েও বাছুর চিহ্নিত করা হয়ে থাকে ।

বাছুরের রোগবালাই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (Prevention and control of calf diseases)

বাছুর পালনে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা হলো রোগবালাই । সাধারণত, সাদা স্কাউর, সাধারণ স্কাউর, নিউমোনিয়া, গোলকৃমি এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ পরজীবীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ।

দুগ্ধ খামারে তথ্য সংরক্ষণ (Keeping records in the dairy farm )

সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ ব্যতীত কোনো ব্যবসাই লাভজনক হতে পারে না। দুগ্ধ খামারে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। উদাহরণস্বরূপ, তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমেই খামারের ভালো গাভীটিকে চিহ্নিত করা যায় । আবার প্রতিদিন দুগ্ধ খামারে কী পরিমাণ খাবার দেওয়া হচ্ছে এবং কী হারে উৎপাদন হচ্ছে তা জেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় । দুগ্ধ খামারে যে সব তথ্য রাখা প্রয়োজন সেগুলো হলো—

  • দুধ উৎপাদন তথ্য (Milk record register)
  • খাদ্য প্রদান তথ্য (Cattle feed register)
  • প্রজনন তথ্য (Breeding record)
  • স্বাস্থ্য তথ্য (Health record)
  • বাছুরের তথ্য (Calf register)
  • আর্থিক তথ্য (Financial record)

অন্যান্য ব্যবস্থাপনা (Other management

দৈনন্দিন কার্যাবলী (Routine work)

প্রতিটি দুগ্ধখামারেই প্রতিদিন নিয়ম মাফিক কিছু কাজ করতে হয়। এই পাঠের শেষ অংশে দুগ্ধ খামারের দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পর্কে জানতে পারবেন ।

পরিচর্যার সময় দয়ালু মনোভাব প্রদর্শন (Kindness in handling)

দুগ্ধখামারে গাভীর প্রতি সবসময় দয়ালু মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে । গাভীদের বন্য জীবজন্তুর মতো করে দেখা উচিত নয় । তাদের প্রতি সবসময় স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি দিতে হবে ।

দুগ্ধবতী গাভীর গ্রুমিং (Grooming dairy cows)

গাভীর শরীরের বর্হিভাগ একটি ব্রাশ দিয়ে ঘষামাজা করে শরীর থেকে ময়লা ও আলগা চুল অপসারণ করাকেই গ্রুমিং বলে । গ্রুমিং এর ফলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়, গাভী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং পরিষ্কার দুধ উৎপাদন করা যায় । এছাড়া ওলান ও পেছনের পায়ের অপ্রয়োজনীয় লম্বা চুল কেটে ফেলা উচিত ।

গর্ভবতী গাভীকে দুগ্ধহীনা করা বা গাভীর দুধ বন্ধ করা (Drying off cows)

গাভী বাচ্চা প্রসবের ৪০-৮০ দিন পূর্ব থেকেই দুধ দোহন বন্ধ করা উচিত । দুধ দোহন বন্ধ করার উদ্দেশ্য হলো—

  • দুধ উৎপাদনকারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিশ্রাম দেওয়া ।
  • গাভী যে খাদ্য খায় তা দুধ উৎপাদনে খরচ না করে যেন বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধিতে কাজে লাগতে পারে ।
  • গাভীর শরীরে খনিজ পুষ্টির মজুদ গড়ে তোলা যা পরবর্তীতে দুধ উৎপাদনে কাজে লাগবে ।
  • প্রসবের পূর্বে গাভীকে স্বাস্থ্যবতী হতে দেওয়া ।

গাভীকে দুগ্ধহীনা করার তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হলো—

ক. সম্পূর্ণভাবে দোহন না করে (Incomplete milking) :

গাভীর দুধ দোহন বন্ধ করার সময় হলে প্রথমত কয়েকদিন ওলানে সামান্য দুধ রেখে দোহন করতে হবে, এরপর দিনে একবার করে অসম্পূর্ণভাবে দোহন করতে করতে যখন দুধ উৎপাদন অতি সামান্য পরিমাণে হবে তখন দোহন একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে ।

খ. সাধারণ দোহন করে (Intermittent milking) :

যে গাভীকে দুগ্ধহীনা করতে হবে সে গাভীকে প্রথমত দিনে একবার করে অতপর একদিন পরপর দোহন করতে হবে এবং অবশেষে দোহন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে হবে ।

গ. দোহন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে (Complete cessation) :

যে সকল গাভী অল্প পরিমাণে দুধ দেয় (যেমন সর্বোচ্চ ১০ লিটার) সে সকল গাভীর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি নিরাপদে ব্যবহার করা যায় ।

 

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

গাভীর গরম হওয়া নির্ধারণ ও পাল দেওয়ানো (Detecting heat and mating) :

সঠিকভাবে সময়মতো গাভীর গরম অবস্থা নির্ণয় করা ও পাল দেওয়ানো দুগ্ধ খামারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ । সময়মতো গাভীর গরম নির্ধারণ করে পাল দেওয়াতে না পারলে খামার ক্ষতিগ্রস্থ হবে ।

গর্ভ পরীক্ষা (Pregnancy diagnosis) :

গাভীকে পাল দেওয়ানোর দু’মাস পরেই গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করাতে হবে । পাল দেওয়ানোর পর গর্ভে বাচ্চা না আসলেও অনেক সময় গাভী পুনরায় গরম হয় না । সুতরাং সময়মতো গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করিয়ে গাভীর সঠিক অবস্থা জানতে হবে ।

দুধ দোহন (Milking) :

প্রতিদিন দুধ দোহনের সময় ওলান ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং যতটা সম্ভব প্রতিদিন একই সময়ে দুধ দোহন করতে হবে । গাভীকে পরিষ্কার করে শুকনো হাতে পূর্ণহস্ত পদ্ধতিতে (Full hand milking) দুধ দোহন করা উচিত ।

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Disease preventive measures) :

যে বিষয়গুলো নিয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গঠিত সেগুলো হলো—

ক. টিকাদান কর্মসূচী (Vaccination programme) :

সময়মতো বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটোরিয়া ঘটিত রোগের টিকা দিতে হবে। যেমন— রিন্ডারপেস্ট, খুরা রোগ, তড়কা রোগ, বাদলা রোগ, গলাফোলা রোগ, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি ।

খ. বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা (Testing programme) :

বিভিন্ন সময়ে খামারের গাভী পশু চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সন্দেহমুক্ত থাকতে হবে।

গ. কৃমিনাশক ব্যবহার (Deworming programme) :

খামারের গাভীর গোবর পরীক্ষা করে নির্দিষ্ট কৃমিনাশক ব্যবহার করা উচিত ।

গাভী ছাঁটাই (Culling of dairy animals )

দুগ্ধখামার লাভজনক করতে হলে খামার থেকে ত্রুটিযুক্ত অলাভজনক গাভীকে সময়মত ছাঁটাই করতে হবে । ছাঁটাইয়ের জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো-

  • সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে ।
  • শারীরিক বৃদ্ধি ভালো না হলে ।
  • কম পরিমাণ দুধ দিলে ।
  • ঠিকমত গর্ভধারণ না করলে ।
  • নিয়মিতভাবে গরম না হলে ।
  • বছরে ২৭০ দিনের কম সময় দুধ দিলে ।
  • মারাত্মক বদ অভ্যাস থাকলে ।

বদঅভ্যাস নিয়ন্ত্রণ (Control of bad habits)

গাভীর বিভিন্ন ধরনের বদঅভ্যাস দেখা যায় । যেমন—

ক. নিজের বা অন্যের বাঁট চোষা (Suckling) :

এধরনের বদঅভ্যাসযুক্ত গাভীকে পৃথক করে রাখতে হবে । গাভীর নাকে লোহার রিং পড়িয়ে তার সাথে ২-৩ টি রিং ঝুলিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।

খ. অন্যের শরীর চাটা (Licking) :

এ ধরনের বদঅভ্যাস দেখা দিলে লবণ বা খনিজ মিশ্রণ জিহ্বায় ঘষে দিতে হবে ।

গ. লাথি মারা (Kicking) :

এসব ক্ষেত্রে গাভী যদি বদরাগী হয় তাহলে তার মাথা উঁচু করে বাঁধতে হবে এতেও কাজ না হলে ওলানের ঠিক সম্মুখভাগে দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে । এভাবে বাঁধার পর ও ফল না পাওয়া গেলে পেছনের দু’পা শক্ত করে বাঁধার ব্যবস্থা করতে হবে ।

 

দুগ্ধ খামার ব্যবস্থাপনা

 

দুগ্ধখামারের দৈনন্দিন কার্যাবলী

দুগ্ধখামারের সফলতার জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু কাজ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সম্পন্ন করতে হবে । খামারের ব্যবস্থাপক এ কাজগুলোর তত্ত্বাবধান করে থাকেন । খামারের ব্যবস্থাপক এবং কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এ কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়ে থাকে । দুগ্ধ খামারে প্রতিদিন যে কাজগুলো করতে হয় সেগুলো হলো-

সময়

কাজ

ভোর ৩.০০ – ৩.৩০ মিঃ

দুধ দোহন করার ঘর এবং দুগ্ধবতী গাভীগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে ।

ভোর ৩.৩০ – ৪.৩০ মিঃ

দুধ দোহন শুরু করতে হবে এবং দৈনিক গাভীর যতটুকু দানাদার খাদ্যের প্রয়োজন তার অর্ধেক পরিমাণ দোহনের সময় গাভীকে খেতে দিতে হবে। দোহনের পর বাছুরকে খাওয়াতে হবে ।

সকাল ৫.৩০ – ৬.৩০ মিঃ

বিক্রয়ের জন্য কাঁচা দুধ সরবরাহ করতে হবে ।

সকাল ৬.৩০ – ৭.০০ মিঃ

গাভীগুলোকে শেডে পাঠাতে হবে ও খামারের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজের সাথে জড়িত কর্মচারীরা সকাল ৭.০০টার মধ্যে তাদের দায়িত্ব শেষ করে চলে যাবেন । খামারের শ্রমিক এবং তদারককারীরা এ সময়ে কাজে যোগ দেবেন । খামারের শ্রমিকবৃন্দ সকাল ৭.০০টা থেকে বিকেল ৩.৩০ মি. পর্যন্ত মাঠে ঘাস সংগ্রহ করবেন ।

সকাল ৭.৩০ – ১১.০০ মিঃ

গাভীগুলো খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াবে যাতে করে কিছুটা ব্যায়াম হয় এবং সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন-ডি সংশ্লেষণ করতে পারে । অন্যান্য ব্যবস্থাপনা, যেমন— চিহ্নিতকরণ, বাছুরের ডিহর্নিং, ভ্যাকসিনেশন, সাইলেজ ও হে তৈরিকরণ ইত্যাদি কাজ এ সময়ে করতে হবে ।

সকাল ১১.০০ – ১২.০০ মিঃ

এসময়ের মধ্যে সাইলেজ এবং হে তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। গাভীগুলোকে মিল্কিং বার্নে পুনরায় নিয়ে আসতে হবে। অতপর দুধালো গাভী ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । এসময় অবশ্য সকল প্রাণিকে আঁশ জাতীয় খাদ্য দিতে হবে ।

বিকাল ২.৩০ ৩.০০ মিঃ

দুধালো গাভীসহ অন্যান্য গাভীর বাসস্থান এসময়ের মধ্যে পরিষ্কার পরিছন্ন করতে হবে ।

বিকাল ৩.০০ – ৪.০০ মিঃ

এসময় দুধ দোহন করতে হবে এবং অবশিষ্ট দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। অতপর বাছুরের খাবার সরবরাহ করতে হবে ।

বিকাল ৪.০০ – ৪.৩০ মিঃ

এসময়ে সকল প্রাণীদের আঁশ জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে গ্রাহকদের নিকট তরল দুধ পৌঁছে দিতে হবে এবং খালি পাত্র সংগ্রহ করতে হবে ।

সন্ধ্যা ৬.০০ মিঃ

খামারে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে ।

সন্ধ্যা ৬.০০ রাত ১২.০০ মিঃ

নৈশ প্রহরী দায়িত্ব পালন করবে ।

 

ম্যানেজার রাত্রিবেলা খামার ত্যাগ করার প্রাক্কালে যেসব গাভী বাচ্চা প্রসব করতে পারে তাদের সংখ্যা অবশ্যই নৈশ প্রহরীকে অবগত করে যেতে হবে । সেই সাথে ক্যাশে রক্ষিত টাকার পরিমাণও জানিয়ে যেতে হবে । ম্যানেজারের যদি রাতে খামার পরিদর্শন করার ইচ্ছা থাকে তবে তা নৈশপ্রহরীকে বলে যেতে হবে যাতে করে পূর্ব অনুমতিসাপেক্ষে ম্যানেজার অনায়াসে খামারে প্রবেশ করতে পারে ।

সারমর্ম

গাভীর খামারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপর তার প্রকৃত মুনাফা নির্ভর করে। খামারের ম্যানেজার যদি | ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খামার পরিচালনা করেন তবে এর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। | খামারের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, শ্রমিকদের কাজের বন্টন, গাভী ও বাচ্চার প্রয়োজন মাফিক খাদ্য প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে যদি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করে খামার পরিচালনা করা হয় তবে সেক্ষেত্রে | উৎপাদনের হারও বেড়ে যাবে । এছাড়া খামারের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে খামার লাভজনক করে গড়ে তোলা উচিত ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

১। সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (~) দিন ।

ক. গাভী থেকে পৃথক রেখে বাছুর পালনের ক্ষেত্রে জন্মের কতদিন পর মায়ের কাছ থেকে সরাতে হবে?

i. ২-৩ দিনের মধ্যে

ii. ৩-৪ দিনের মধ্যে

iii.৩-৫ দিনের মধ্যে

iv. ২-৫ দিনের মধ্যে

খ. বাছুরকে খাওয়ানোর পদ্ধতি কয়টি?

i. ৩ টি

ii. ৪ টি

iii. ৫ টি

iv. ২ টি

২। সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন ।

ক. সাধারণত বাছুরের জন্মের ১০ দিনের মধ্যে ডিহর্নিং করা ভালো ।

খ. ট্যাটুইং একটি নম্বার লাগানোর যন্ত্র ।

৩। শূন্যস্থান পূরণ করুন।

ক. গাভীকে পাল দেয়ার ———- মাস পরেই গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করাতে হবে ।

সময়মতো গাভীকে বিভিন্ন —— ও —— ঘটিত রোগের টিকা দিতে হবে ।

৪।  এক কথায় বা বাক্যে উত্তর দিন ।

ক. সাধারণত ২ সপ্তাহ বয়স থেকে বাছুরকে কী খাওয়ানো যেতে পারে?

খ. শিং কেটে ফেলার যন্ত্রের নাম কী?

 

Leave a Comment