ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

ধানের ক্ষতিকর ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ১ম পত্র ১৮৮৯” এর ইউনিট – ৭ এর পাঠ – ৭২ পাঠ এর অংশ। ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রায় ৩৩টি প্রজাতির পোকাকে ধানের প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিন মৌসুমেই
প্রায় একই ধরনের পোকা আক্রমন করে যদিও আক্রমনের মাত্রা ভিন্ন। আউশ ও আমন মৌসুমে পোকার প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।

ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

 

নিচে কয়েকটি প্রধান পোকার ক্ষতির লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:

ধানের পোকা মাকড়:

 

১। মাজরা পোকা

ক্ষতির লক্ষণ

১) মাজরা পোকার মথ ধানের পাতায় ডিম পাড়ে।

২) ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে কান্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে কান্ডের নীচের দিকে কেটে দেয়।

৩) আক্রমন শীষ বের হবার পূর্বে হলে ’ডেটহার্ট’ এবং শীষ আসার সময় হলে ‘হোয়াইট হেড’ লক্ষণ প্রকাশ করে।

ধানের ক্ষতিকর ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা , পাঠ-৭.২ , ইউনিট - ৭

দমন ব্যবস্থা

১) ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা। চিত্র ৭.২.১ : মাজরা পোকা

২) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা।

৩) জমিতে ডালপালা পঁুতে পাখি বসবার ব্যবস্থা করা।

৪) জমিতে ১০—১৫% মরা ডগা অথবা শতকরা ৫% সাদা শীষ দেখা গেলে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

৫) মাজরা পোকা প্রতিরোধী জাত যেমন বিআর—১, বিআর—১০, বিআর—১১, বিআর—২২, ব্রিশাইল ইত্যাদি চাষ করা।

Capture 74 ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

২। ধানের গলমাছি বা নলিমাছি

ক্ষতির লক্ষণ

১) কীড়া ধান গাছের বাড়ন্ত কুশিকে আক্রমন করে এবং আক্রান্ত কঁুশি পিয়াজের মত হয়। ২) কঁুশিতে শীষ বের হয় না।

দমন ব্যবস্থা

১) রোপনের পর জমি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

২) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করতে হবে।

৩) ৫% কুশি পিয়াজ পাতার মত হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

 

৩। ধানের পামরি পোকা (Dicladispa armigera):

ক্ষতির লক্ষণ

১) পামরি পোকা পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ও কীড়া এ দু—অবস্থায় ধান গাছ আক্রমন করে।

২) কীড়া পাতা ছিদ্র করে সবুজ অংশ খায়।

৩) পূর্ণবয়স্ক পোকা ধানের পাতার উপর সমান্তরাল দাগ করে সবুজ অংশ কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। ৪) পাতা শুকিয়ে পুড়ে যাওয়ার মত হয়।

দমন ব্যবস্থা

১) হাতজাল অথবা মশারিরর কাপড় দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।

২) গাছের পাতা ছেঁটে দিয়ে কীড়া মারা যায়।

৩) পাতার ৩৫% ক্ষতি হলে অথবা প্রতি গোছায় ধানগাছে ৪টি পূর্ণবয়স্ক পোকা থাকলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

 

Capture 75 ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

৪। ধানের বাদামি গাছ ফড়িং:

ক্ষতির লক্ষণ

১) বাদামি গাছ ফড়িং ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়।

২) আক্রান্ত গাছ প্রথমে হলদে এবং পরে পুড়ে যাওয়ার মত রং ধারন করে মারা যায়। একে হপার বার্ণ বলে।

দমন ব্যবস্থা

১) আলোক ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করা ।

২) অধিক দূরত্বে চারা রোপন করা (২৫২৫ সে.মি)।

৩) আগাম পাকে এমন জাতের ধান চাষ করা।

৪) অধিক আক্রমন হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।

 

৫। ধানের সবুজ পাতা ফড়িং:

ক্ষতির লক্ষণ

১) পূণবয়স্ক ও বাচ্চা উভয় অবস্থায় এ পোকা ধানের পাতার রস শুষে খায়।

২) গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছ খাটো হয়।

৩) এ পোকা টুংরো ভাইরাস ছড়ায়।

দমন ব্যবস্থা

১) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।

২) হাতজাল ব্যবহার করে পোকা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।

৩) প্রতিরোধী জাত যেমন বিআর—১, বিআর—২, বিআর—৫, বিআর—৬, বিআর—১০, বিআর—১২ জাতের ধান চাষ করা।

 

৬। ধানের গান্ধি পোকা:

ক্ষতির লক্ষণ

১) ধানের দানায় দুধ সৃষ্টির সময় আক্রমন করে।

২) পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই ধানের দানায় খোসা ছিদ্র করে ধানের দুধ শুষে খায়।

৩) ধান চিটা হয় এবং চিটার গায়ে বাদামি গোলাকার দাগ দেখা যায়।

 

ধানের ক্ষতিকর ধানের পোকামাকড় 2 ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

 

দমন ব্যবস্থা

১) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা।

২) হাতজাল ব্যবহার করা।

৩) পাখি বসার জন্য ডালপালা পুঁতে দেয়া।

৪) ধানের প্রতি গোছায় ২—৩ টি গান্ধী পোকা দেখা গেলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।

 

৭। ধানের পাতা মোড়ানো পোকা ক্ষতির লক্ষণ:

১) পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া ধানের পাতা লম্বালম্বি মুড়িয়ে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতায় লম্বা সাদা দাগ করে। ২) পাতা পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়।

দমন ব্যবস্থা

১) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা।

২) ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা।

৩) ২৫% পাতার ক্ষতি হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।

 

৮। ধানের চুঙ্গি পোকা ক্ষতির লক্ষণ:

১) চুঙ্গি পোকা পাতার উপরের অংশ কেটে ছোট ছোট চুঙ্গি তৈরি করে ভেতরে থাকে।

২) গাছের পাতা সাদা হয়ে যায় ও পাতার উপরের অংশ কাটা থাকে।

৩) দিনের বেলায় চুঙ্গিগুলো পানিতে ভাসতে থাকে।

 

দমন ব্যবস্থা:

১) আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে মথ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।

২) হাতজাল ব্যবহার করে চুঙ্গিসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।

৩) আক্রান্ত জমির পানি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং জমি শুকিয়ে ফেলতে হবে।

৪) বেশি আক্রমন হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

 

ধানের রোগ বালাই:

বাংলাদেশে ধানের ৩২টি রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। রোগগুলি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও কৃমি দ্বারা সংঘটিত হয়।

এখানে ধানের কয়েকটি প্রধান রোগের কারণ, লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা বর্ণনা করা হলো:

 

১। ধানের পাতা পোড়া বা পাতা ঝলসানো রোগ:

কারণ :

ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনে হয়।

লক্ষণ:

১) চারা অবস্থায় এ রোগ হলে আক্রান্ত গাছের গোড়া পত্রফলক, বাইরের পাতা হলদে হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।

২) বয়স্ক গাছে থোড় অবস্থা থেকে পাতা পোড়া রোগের লক্ষণ দেখা যায়।

 

দমন ব্যবস্থা:

১) রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা।

যেমন— বিআর—২, বিআর—৪, ব্রিধান—২৭, ব্রিধান— রোগ ২৮, ব্রিধান—২৯, ব্রিধান—৩১ ইত্যাদি।

২) আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা।

৩) সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা।

৪) আক্রান্ত জমির পানি শুকিয়ে আবার সেচ দেয়া।

৫) ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলা।

 

২। ধানের খোলপোড়া রোগ:

কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়

লক্ষণ

১) ধান গাছের কুশি গজানোর সময় রোগটির প্রাদুভার্ব হয়।

২) প্রথমে খোলে ধুসর দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে তা বড় হয়ে সমস্ত খোলে ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।

৩) পত্রফলকে গোখরা সাপের চামড়ার ন্যায় দাগ তৈরি হয়।

 

দমন ব্যবস্থা

১) সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।

২) নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি করে ধান লাগাতে হবে।

৩) বেশি আক্রান্ত হলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।

৪) ফসল কাটার পর আক্রান্ত জমির নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

 

৩। ধানের কান্ড পচা রোগ:

কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়।

লক্ষণ

১) খোলে কালচে গাঢ় অনিয়মিত দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে বড় হয়।

২) কান্ড চিড়লে কালো গোলাকার বুটির মত দানা দেখা যায়। দমন ব্যবস্থা

১) রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন—

বিআর—১১, বিআর—১৪, ব্রিধান—১৭, ব্রিধান—৩০, ব্রিধান—৩১, ব্রিধান—৪০, ব্রিধান—৪২ ইত্যাদির চাষ করা।

২) সুষম সার ব্যবহার করা।

 

৪। ধানের খোলপচা রোগ:

কারন: ছত্রাক সংক্রমনে হয়। লক্ষণ

১) ডিগপাতার খোলে গোলাকার বা অনিয়মিত দাগ পড়ে। দাগগুলির কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামী হয়। দাগগুলো মিশে বড় হয়।

২) শীষ আংশিক বের হয়।

৩) খোল পচে যায়।

 

দমন ব্যবস্থা

১) সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা।

২) রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা ও বীজ শোধন করা।

৩) ধান কাটার পড় খড়কুটো জমিতে পুড়িয়ে ফেলা।

 

৫। ধানের টুংরো রোগ:

কারন: ভাইরাস সংক্রমনে হয়।

 

লক্ষণ

১) পাতার রং হালকা সবুজ হয় এবং পরে হলদে হয়।

২) গাছ টান দিলে উঠে আসে।

৩) আক্রান্ত পাতা মুচড়ে যায় ও গাছ খাটো হয়।

 

দমন ব্যবস্থা

১) সবুজ পাতা ফড়িং ভাইরাস ছড়ায়। তাই এ পোকা দমন করা জরুরী।

২) রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা।

৩) রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা।

৪) সবুজ পাতা ফড়িং দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

ধানের ক্ষতিকর ধানের পোকামাকড় 3 ধানের পোকামাকড় ও রোগ বালাই এবং দমন ব্যবস্থা

 

৬। ধানের ব্লাস্ট রোগ:

 লক্ষণ

১) পাতায় ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে।

২) দাগের চারিদিকে গাঢ় বাদামী এবং মাঝের অংশ সাদা ছাই বর্ণের হয়।

৩) কান্ডের গিঁটে, খোল ও পাতার সংযোগস্থান কালো দাগ সৃষ্টি করে।

৪) শিষের গোড়ায় কালো দাগের সৃষ্টি করে এবং গোড়া পচে যায় এতে চিটা ও অপুষ্ট দানা হয়।

 

দমন ব্যবস্থা

১) জমিতে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে।

২) রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন— বিআর—৩, বিআর—১৪, বিআর—১৫, বিআর—১৬, বিআর—২৪ ইত্যাদি চাষ করা।

৩) রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা ও বীজ শোধন করা।

৪) পটাশ জাতীয় সার উপরি প্রয়োগ করা।

 

Leave a Comment