আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সমন্বিত চাষ পদ্ধতি – যা কৃষিজ উৎপাদন: মাছ চাষ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সমন্বিত চাষ পদ্ধতি
ধানক্ষেতে মাছ চাষ
ধানক্ষেতে মাছ চাষ বলতে একই জায়গায় একই ব্যবস্থাপনায় একই সময়ে ধান ও মাছ চাষ করা বোঝায় । ধান ক্ষেতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে ধান মূখ্য ফসল আর মাছ গৌণ ফসল ।
ধান ক্ষেতে মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ, এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য শস্য হলো ধান, বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় মাছের উৎপাদন খুবই কম, একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ৮০-১০০ গ্রাম মাছ খাওয়া প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক মাথা পিছু মাছ গ্রহণ করছে মাত্র ২৫.৬ গ্রাম । তাই মাথা পিছু মাছের উৎপাদন বাড়ানো অতীব প্রয়োজন ।
বাংলাদেশের অনেক জমিতে শুধুমাত্র বছরের অর্ধেক সময় ধান চাষ হয়। আর বাকী অর্ধেক সময় জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। তাই এসব জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ধানের পাশাপাশি একই সাথে মাছ পালন করতে পারলে মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
বর্তমানে এদেশে ধান চাষের জন্য সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে বোরো (ইরি) ধানের আবাদও বাড়ছে আর এসব বোরো ধানের জমিতে অতি সহজেই এবং সামান্য ব্যবস্থাপনায় মাছের চাষ সম্ভব। তাই জমিতে একটি ফসলের পরিবর্তন দুটো ফলন অবশ্যই লাভ জনক। সুতরাং ধানের সাথে মাছের চাষ অর্থাৎ ধান ক্ষেতে মাছ চাষ নিঃসন্দেহে লাভজনক এবং বাড়তি আয়ের একটি সহজ উপায়। তাছাড়া ও ধান ক্ষেতে মাছ চাষে বেশ কতগুলো সুবিধা রয়েছে, যেমন-
- একই জমিতে একই সময়ে ধান ও মাছ এ দুটো ফসল পাওয়া যায় ফলে ধানক্ষেতের পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উপার্জন সম্ভব।
- অল্প শ্রম ও স্বল্প খরচে বেশি আয় নিশ্চিত হয়।
- মাছ ধান ক্ষেতে ছোট ছোট আগাছা থেকে আগাছা দমনে সহায়তা করে।
- মাছের মল ধানের সার হিসেবে কাজ করে ফলে ধানের জন্য সার দিতে হয় না।
- মাছ ধানের জন্য অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড় তাদের ডিম, লার্ভা ইত্যাদি খেয়ে কীটনাশক প্রয়োগের ব্যয় কমায় এবং এতে পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে ।
- ধান ক্ষেতে মাছ চাষের ফলে ধানের ফলন সাধারণত শতকরা ১০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
- মাছকে সম্পূরক খাদ্য না দিলেও চলে
- ধান ক্ষেতে মাছ চলাচলের জন্য পানির নাড়া চড়ার ফলে ধান গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- মাছকে খাদ্য সরবরাহ করা হলে অব্যবহৃত খাদ্য ধানের সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- তাই উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে এ উপসংহারে আসা যায় যে ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য ।
ধান ও মাছের সমন্বিত চাষ ব্যবস্থাপনা
ধান ক্ষেতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের উৎপাদন সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
- ধানক্ষেতে পানির গভীরতা: সাধারণত গভীর পানিতে মাছের উৎপাদন ভালো হয় ।
- মাছের জাত, মজুদ আকার ও ঘনত্ব: দ্রুত বর্ধনশীল, বড় আকারের এবং ধান ক্ষেতের পরিবেশের সাথে সহনীয় জাতের মাছ মজুদ করা হলে মাছের উৎপাদন অধিক হয়।
- সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ: ধান গাছ রোপনের প্রায় ৬ সপ্তাহ পরে মাছকে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা হলে সাধারণত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
- চাকাল: মাছের চাষকাল বেশি হলে মাছের বৃদ্ধি অধিক হয়।
- আংশিক আহরণ : ধানক্ষেত হতে আংশিক আহরণের ফলে মাছের মৃত্যুহার কমে এবং সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়ে।
- রাক্ষুসে প্রাণীর উপস্থিতি : রাক্ষুসে প্রাণী যেমন- ব্যাঙ, সাপ, উদ ও গুইসাপ ইত্যাদি না থাকলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
- কাঁকড়া ও ইঁদুরের গর্ত তৈরি : ধানক্ষেতে কাঁকড়া ও ইঁদুরের গর্ত থাকলে উৎপাদন কমে যায় । ধান ক্ষেতে মাছ ও ধানের মধ্যে আন্তঃ সম্পর্ক তৈরি করার লক্ষ্যে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনায় প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন, ধান ও মাছের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কে পুনঃ সক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত হয় ধানক্ষেতে পোনা মজুদসহ গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে ধান ও মাছে উৎপাদনের পরিমাণ গৃহীত ব্যবস্থাপনার ওপরই নির্ভর করে ।
ধানের ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল
ধান ও মাছের ফলন প্রধানত জমি এবং ধান ও মাছের পরিচর্যা এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার কলা কৌশল এর ওপর নির্ভর করে । ব্যবস্থাপনা যত ভালো হয় ফলন ও ততবেশি হয়ে থাকে, সুতরাং ধান ও মাছের ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ধান ব্যবস্থাপনার কলাকৌশলের প্রধান অংশগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ধানের জমি প্রস্তুতকরণ
ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্য জমি প্রস্তুতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জমি যত ভালোভাবে প্রস্তুত করা হবে মাছ ও ধানের উৎপাদনও তত বেশি হবে জমি প্রস্তুতির সময় নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা উচিত । জমির আয়তনঃ সাধারণত জমির আয়তন ৩০-১০০ শতক হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। জমি প্রস্তুতের সময় জমিকে
সমতল করে দেয়া উচিত।
জমির আইল উঁচুকরণ : জমি এমনভাবে উঁচু করা উচিত যেন স্থায়ীভাবে বন্যার পানিতে আইল ডুবে না যায়। জমির আইল মজবৃত্ত হওয়া প্রয়োজন যাতে পানির চাপে ভেঙ্গে না যায়। সাধারণত ১২-১৮ ইঞ্চি উঁচু করে আইল বাধলে বন্যার পানিতে ডুবার সম্ভাবনা কম থাকে।
মাছের চলাচলের সুবিধার্থে জমিতে গর্ত ও পরিখা বা নালা খনন করার প্রয়োজন রয়েছে। গর্ত বা নালা খনন করার ফলে ধানের জমি সবসময় পানি ধরে রাখতে পারে এবং মাছ অধিক গরমের সময় ঐ সব নালা গর্তে এসে আশ্রয় নিতে পারে। তাছাড়া ধানের জন্য কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছগুলোকে এসব গর্ত ও নালাতে নিয়ে আসা সম্ভব হয় এবং মাছ ধরার সময় ও মাছগুলোকে নালা বা গর্তে এনে তারপর ধরা হয়।
ধানক্ষেতের মাটির ধরন ও জমির উপর পৃষ্ঠের ধরনের উপর ভিত্তি করে তিন ধরনের গর্ত বা নালা খনন করা হয় যেমন জমির চতুর্দিকে নালা ঘনন, জমির মাঝাধানে পুকুর খনন এবং জমির পাশাপাশি নালা খনন। জমির যেদিকে চালু থাকে সে দিকে এক কোণে গর্ত করা সুবিধাজনক। সাধারণত জমিতে এক বা একাধিক নালা খনন করা উচিত। সাধারণত জমির শতকরা ৪৬ ভাগের অধিক গর্ত করা উচিত নয় ।
ধানের জাত নির্বাচন : সাধারণত প্রায় সকল জাতের ধানের সাথেই মাছ চাষ করা হয় তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের যেসব ধান মাঝারি ধরনের লম্বা হয় সেসব ধান মাছ চাষের জন্য অধিক সুবিধাজনক তাছাড়া যেসব জাতের ধানের পানি সহা ক্ষমতা বেশি সেগুলোকে নির্বাচন করা উচিত। ধানের কয়েকটি উপযোগী জাত হলো-আমন মৌসুমের জন্য বি. আর-১১, বি আর-৩ এবং বিআর-৩০ বোরো মৌসুমের জন্য বি আর ১৬ এবং বি.আর.-১৪ ইত্যাদি ।
মাছের ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল: মাছের উৎপাদন মূলত মাছের ব্যবস্থাপনা ওপর নির্ভরশীল। মাছের ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল যত বেশি উন্নত হবে মাছের উৎপাদনও তত বেশি হবে। মাছ ব্যবস্থাপনা কলাকৌশল যত বেশি উন্নত হবে মাছের উৎপাদনও তত বেশি হবে। মাছ ব্যবস্থাপনা কলাকৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
মাছ ছাড়ার আনুপাতিক হার ধান ক্ষেতে মাছ চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হলো সর পুটি, কমনকার্প মাছ। ধান ক্ষেতে এসব জাতের মাছের একক বা মিশ্র চাষ করা যায়। একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতকের জমিতে উল্লিখিত জাতের মাছগুলোর মজুদ ঘনত্ব হলো সরপুটি ২০-২৫ টি এবং কমন কার্প ১০-১৫ টি।
অপর পক্ষে মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতকের জমিতে উল্লিখিত জাতের মাছগুলোর মজুদ হলো সরপুটি ১২টি কমন কার্প ৮টি = মোট ২০টি মাছ ছাড়ার সময় ধান ক্ষেতে মাছ চাষের ক্ষেতে মাছের পোনা ছাড়ার সময় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। কারণ মাছ। ছাড়ার জন্য উপযুক্ত সময় অনুযায়ী মাছের পোনা ছাড়া উচিত ধানের চারা রোপনের পর পরই মাছ ছাড়া উচিত নয়। কারণ মাছ ছাড়ার জন্য ক্ষেতে ৪.৫ ইঞ্চি পরিমাণ পানি রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু ঐ পরিমাণ পানি ধানের প্রাথমিক অবস্থায় বেশ ক্ষতিকর কেননা এতে ধানের কুশি কম গঙ্গায়। তাই ধানের চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর যখন ধানের কৃশি ছাড়বে তখন ক্ষেতে ৪-৫ ইঞ্চি পানি ঢুকিয়ে তারপর মাছ ছাড়া উচিত। তবে যদি ধানক্ষেতের সাথেই বড় আকারের গর্ত থাকে তাহলে ধান লাগানোর পূর্বেই ঐ গর্তে মাছ ছাড়া যেতে পারে।
মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ধান ক্ষেত্রে সঠিক সংখ্যায় মাছ ছাড়া হলে সম্পূরক খাদ্য দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে স্বল্প সময়ে মাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে প্রতিদিন থৈল এবং চালের কুড়া ১৯১ অনুপাতে মাছের মোট ওজনের ৩-৫% হারে ধান ক্ষেতে ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
ধানক্ষেতে মাছের জন্য বৈচিত্র্যময় খাদ্য থাকে যেমন: শেওলা, ধানের পোকা, ছোট ছোট আগাছা বিভিন্ন পোকার লার্ভা ইত্যাদি খেয়ে মাছ দ্রুত বড় হয়।
মাছের রোগের প্রতিকার ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে সাধারণত মাছের রোগ হবার সম্ভবনা কম থাকে। কারণ মাছের অধিকাংশ রোগ শীতকালে দেখা যায়। মাছের রোগ হওয়ার মূল সময়টাতে ক্ষেতে সাধারণত ধান থাকে না।
তথাপি আমন মৌসুমের শেষে যদি মাছের রোগ বিশেষত ক্ষত রোগ দেখা দেয় তখন মাছগুলোকে গর্তে এনে প্রতি শতকে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাতেও মাছের রোগ ভালো না হলে সম্পূর্ণ মাছ ধরে ফেলাই উত্তম।
সারাংশ
ধান ও মাছের একত্রে চাষই হলো ধান ক্ষেতে মাছ চাষ। এক্ষেত্রে ধান মূখ্য ফসল আর মাছ গৌণ ফসল। ধান ও মাছ একত্রে চাষের ফলে ধানক্ষেত ও পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। ফলে অধিক লাভবান হওয়া যায়।