আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা। মাছের রেণুকে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার মাধ্যমে লালন পালন করে মজুদ পুকুরে ছেড়ে চারা পোনায় উন্নীত করার পদ্ধতিকে নার্সারি ব্যবস্থাপনা বলে । যে ক্ষুদ্রায়ত জলাশয়ে বা পুকুরে মাছের রেণু অত্যন্ত যত্ন সহকারে লালন করে মজুদ পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত করে বড় করা হয় তাকেই নার্সারি পুকুর বলে। নার্সারি ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক। মাছ চাষিরা স্বল্প খরচে খুব সহজেই মার্সারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করতে পারে।
নার্সারি ব্যবস্থাপনা
মাছ চাষের পূর্ব শর্তই হচ্ছে উন্নতমানের পোনা সরবরাহ করা। যে পদ্ধতিতে রেণু পোনাকে ধানি পোনা এবং ধানি পোনাকে চারা পোনায় পরিণত করা হয় তাকে নার্সারি ব্যবস্থাপনা বলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নার্সারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণত দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যথা- এক ধাপ ও দুই ধাপ পদ্ধতি। নিচে এসব পদ্ধতির রেখারূপ উপস্থাপন করা হলো-
রেণু
নিষিক্ত ডিম ফোটার পর এদের পেটের নিচে একটি হলুদ বর্ণের খাদ্যথলি থাকে। এ অবস্থায় এরা কোন খাবার খায় না। যখন পেটের খাদ্যথলি শরীরের সঙ্গে মিশে যায় তখন তাদের রেণু পোনা বলে ।
ধানি পোনা
রেণু পোনা কিছুটা বড় হয়ে ধানের আকার বা ১-২ সে.মি. লম্বা হলে সেগুলো ধানি পোনা বলে। রেণু থেকে ধানী হতে ৮-১০ দিন সময় লাগে।
চারা পোনা
ধানি পোনা আরো বড় হয়ে হাতের আঙুলের মতো বা ৮-১০ সে.মি. লম্বা হলে সেগুলোকে চারা পোনা বলে। চারা পোনাই মাছ চাষের পুকুরে ছাড়তে হয়।
পুকুর নির্বাচন :
মৌসুমী পুকুর বা সারা বছর পানি থাকে এমন যে কোন পুকুরকে নার্সারি পুকুর বা আঁতুর পুকুর হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তবে এসব পুকুর আয়তনে ছোট এবং আয়তকার হলে ভালো হয়। পুকুরের আয়তন ২.৫-২৫ শতাংশ হওয়া উচিত। পুকুর থেকে প্রয়োজনের সময় পানি বের করা ও পানি দেওয়ার জন্য একটি নির্গমন ও একটি প্রবেশ পথ থাকা ভালো। নির্গমন ও প্রবেশ পথ দিয়ে যাতে অবাঞ্ছিত মাছ পুকুরে ঢুকতে বা পোনা মাছ সহজে বের হতে না পারে সেজন্য এই দুটি পথ জাল দিয়ে আটকে রাখতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতি
পূর্বের পাঠে পুকুর প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সেভাবেই পুকুর প্রস্তুত করতে হবে। বিভিন্ন ধাপগুলো চিত্রের মাধ্যমে দেখান হলো-
এক ধাপে প্রতিপালন
এ পদ্ধতিতে রুইজাতীয় মাছের যে কোন প্রজাতির ৪-৫ দিনের রেণু পোনা ২-৩ মাস লালন পালন করে ৮-১০ সে.মি. বড় করা যায়। এক্ষেত্রে শতাংশে প্রতি ৬-৮ গ্রাম পোনা মজুত করা যায়। এর চেয়ে অধিক ঘনত্ব পোনা মজুত করলে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পুরক খাদ্য সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়।
সমপরিমাণ চালের কুঁড়া ও সরিষার খৈল গুঁড়া করে চালুনি দিয়ে ভালো করে ছেঁকে নিয়ে সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। পোনা বড় হওয়ার সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়।
খাবার সরবরাহের হার প্রতি ১০ দিন পর পর পুকুরে খাদ্য সরবরাহের হার বৃদ্ধি করতে হয়। রেণু পোনা মজুদের পর থেকে নিম্নরূপ হারে খাদ্য দিতে হবে।
প্রথম ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ১০ গুণ
দ্বিতীয় ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ১৫ গুণ
তৃতীয় ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ২০ গুণ।
চতুর্থ ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ২৫ গুণ
পঞ্চম ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৩০ গুণ
ষষ্ঠ ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৩৫ গুণ
উল্লেখিত হারে প্রয়োজনীয় খাবার দুভাগে ভাগ করে অর্ধেক সকালে এবং বাকি অর্ধেক বিকালে পুকুরে নির্দিষ্ট এলাকায় ছিটিয়ে দিতে হবে। এসময় পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যও প্রয়োজনানুসারে বৃদ্ধি করতে হবে। রেণু পোনা মজুদের ১০ দিন পর পর শতাংশ প্রতি ১০ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর সার পাওয়া না গেলে শতাংশ প্রতি ৭৫ গ্রাম টি.এস.পি ও ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
সতর্কতা :
পুকুরে পানির রং ঘন সবুজ থাকলে সার দেয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। ঠিকমত পরিচর্যা করা সম্ভব হলে ২-৩ মাসের মধ্যে ৮-১০ সে.মি. আকারের চারা পোনা পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে পোনার বেঁচে থাকার হারও শতকরা ৬০-৭০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।
পরিচর্যা
রেণু পোনার অবস্থা পরিচর্যা করার জন্য ৫ দিন পর পর পাতলা কাপড় দিয়ে পোনা তুলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। পোনার স্বাস্থ্য ভালো দেখা গেলে শতকরা ১% ভাগ হারে অতিরিক্ত খাদ্য পুকুরে সরবরাহ করতে হবে। পানির রং বেশি সবুজ হলে অজৈব সার ও খাবার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। নতুবা অক্সিজেনের অভাবে মাছ মারা যাবে। মাঝে মাঝে হররা বা জাল টেনে পুকুরের তলার বিষাক্ত গ্যাস বের করে দিতে হবে।
আহরণ
পোনা মাছ সকালেই আহরণ করা উচিত। কারণ সূর্যালোক বাড়ার সাথে সাথে পুকুরের পানির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় পোনা আহরণ করা হলে, তাদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়। বার বার জাল টেনে এবং পানি নিষ্কাশন করে সব পোনা ধরে নিতে হবে।
দুই ধাপে প্রতিপালন
এক্ষেত্রে দুটি পর্যায়ে পোনা পালন করা হয়। দুই ধাপে পোনা পালন বেশি লাভজনক বলে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ রকম পোনা পালনের জন্য দুটি পুকুর প্রয়োগ প্রাথমিক পর্যায়ে এ পর্যায়ে ৪-৫ দিনের রেনু পোনা প্রতি শতাংশে ৫০-১০০ গ্রাম হারে নার্সারি পুকুরে মজুদ করা যায়।
পোনা মজুদের দিন পর থেকে খাবার দিতে হয়। সমপরিমাণ চালের কুঁড়া ও সরিষার খৈল মিশিয়ে সকালে ও বিকালে পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়। তবে সমস্ত খাবার সমান ভাগ করে সারা দিন নির্দিষ্ট সময় পরপর ৩-৪ বারে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রেনু পোনা মজুদের পর থেকে কি হানা দিতে হবে
প্রথম ৫ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৩ গুণ খাদ্য
দ্বিতীয় দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৫ জন খাদ্য
তৃতীয় ৫ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৭ গুণ খাদ্য
চতুর্থ ৫ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ১০ গুণ
এছাড়া পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ কম থাকলে তা ক্রমশ বৃদ্ধি করতে হবে।
সেক্ষেত্রে শুদ্ধ গোবর সার প্রয়োগ করা যায়। উল্লেখিত বেশি ঘনত্বে ২১ দিন লালন-পালন করা হলে পোনা মাছের বেঁচে থাকার হার শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ অবস্থার পোনার আকার ৩ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে। এই পোনা ধানি পোনা হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যায়।
মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রাথমিক পর্যায়ে লালনকৃত ধানি পোনা অন্য পুকুরে শতাংশ প্রতি ২৫০০- ৪০০০ টি মজুদ করতে হয়। পোনা মজুদের দিন পর থেকে নিম্নহারে না সরবরাহ করতে হবে।
প্রথম ১৫ দিন প্রতি শত পোনার জন্য ৮ গ্রাম খাদ্য
দ্বিতীয় ১৫ দিন প্রতি শত পোনার জন্য ১০ গ্রাম
তৃতীয় ১৫ দিন প্রতি শত পোনার জন্য ১২ গ্রাম খাদ্য
চতুর্দ ১৫ দিন প্রতি শত পোনার জন্য ১৪ গ্রাম
এছাড়া এক ধাপ পদ্ধতির মত জৈব ও অজৈব সার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এই নিয়মে পোনা-লালন পালন করলে প্রতিটি পোনা ২ মাসে প্রায় ৫-৮ সে.মি. পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে মাছের বেঁচে থাকার হার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ। যদি একই পুকুরে পোনা রেখে বিক্রয় করার প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সকালে ১/২ বার জাল টেনে পোনা মাছ আহরণ করতে হবে। কোন অবস্থাতেই দুবারের বেশি এবং দুবেলা জাল টানা যাবে না। কারণ এতে পানি ঘোলা হয়ে পোনা মারা যাবে।
এভাবে পোনা উৎপাদন করলে আঁতুর বা নার্সারি ব্যবস্থাপনা করে প্রচুর আয় করা যায়।
সারমর্ম:
- পানির রং ঘন সবুজ থাকলে পুকুরে সার দেয়া সামকিভাবে বন্ধ রাখতে
- পোনা মাছের জন্য মোট খাবার ভাগ করে দিনে দুবার সরবরাহ করা ভা
- পোনা মাছ সকালে আহরণ করতে হয় কার সময় পানির তাপমাত্রা কম থাকে।