বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পনা। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদনের জন্য অবশ্যই ভালো পরিকল্পনা এবং সেই অনুযায়ী কাজ হতে হবে।

বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পন

বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পনা

নার্সারি

যে কোন ধরনের বন কিংবা বাগান তৈরি করতে সুস্থ, সবল ও নির্ধারিত মানের চারাগাছ প্রয়োজন। সুস্থ, সবল ও ভালো মানের চারা না হলে ফসল ভালো হয় না। ভালো মানের চারা উৎপাদনের প্রয়োজন হয় নার্সারির। নার্সারির সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, যে জায়গায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফুল, ফল, শাকসবজি ও বনজ বৃক্ষের চারা উৎপাদন ও কলম তৈরি করা হয় এবং রোপনের পূর্ব পর্যন্ত বর্ধনশীল চারা বা কলমের উপযুক্ত যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তাকে নার্সারি বলে।

 

বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পন

 

সুতরাং নার্সারি যেকোন গাছপালার চারা বা কলম উৎপাদনের উপযুক্ত স্থান। এতে নির্দিষ্ট মানের পর্যাপ্ত পরিমাণ চারা বা কলম উৎপাদন করে তা বিক্রয়ের জন্য রক্ষণ করা হয়। নার্সারি শুধুমাত্র বীজ থেকে চারা উৎপাদনের কেন্দ্র নয়। নার্সারিতে চারা উৎপাদন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কলম থেকে চারা তৈরি, ররূপান্তরিত মূল বা শাখা থেকে গাছের বংশবিস্তারের জন্যকলম তৈরি করা হয়।

এছাড়া আধুনিক নার্সারিতে উন্নতমানের মূল্যবান চারা উৎপাদনের জন্য টিকালচার ল্যাবরেটরি এবং গ্রীনহাউজ থাকতে পারে। নিচে সংক্ষেপে নার্সারীর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো-

১। নার্সারিতে উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণে চারা উৎপাদন করা যায় এবং তা সময়মতো সরবরাহ করা যায়।

২। অনেক উদ্ভিদের বীজ গুদামজাত করা যায় না। দুই-একদিনের মধ্যে এদের জীবনীশক্তি হারিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে নার্সারির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যেমন- শাল, গর্জন, তেলশুর ইত্যাদি ।

৩। যে সব উদ্ভিদের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় না কিংবা বীজের চারা থেকে ফলন ভাল হয় না এদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের কলমের চারা বা টিসুকালচার চারা পেতে হলে নার্সারির প্রয়োজন যেমন- বাঁশ, কদম, জানুল ইত্যাদি।

৪। নার্সারিতে বিভিন্ন বয়সের চারা পাওয়া যায়।

৫। চারা বিতরণ ও বিপণনের সুবিধা হয়।

৬। সামাজিক বনায়ন ও বন সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের সফলতার জন্য নার্সারি প্রয়োজন।

৭। নার্সারি ব্যবসা লাভজনক। শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতি, দুঃস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও কর্মহীন মানুষ অল্প পুঁজি নিয়ে স্বল্প জমিতে নার্সারি স্থাপন করে স্বচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

 

বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পন

 

নার্সারির প্রকারভেদ

অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রধানত নার্সারিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

(ক) স্থায়ী নার্সারি ও

খ) অস্থায়ী নার্সারি

নার্সারি স্থাপনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। একটি মনোরম আকর্ষণীয় নার্সারি স্থাপনের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে কাজ সহজ এবং খরচ কম হয়। নার্সারি স্থাপনের পূর্বে একজন পরিকল্পনাকারীর যেসব বিষয় প্রথমেই বিবেচনায় আনতে হয় তা হলো :

১। স্থান নির্বাচন

২। ভূমি উন্নয়ন

৩। বেড়া বা বেষ্টনী নির্মাণ।

৪। নার্সারির নক্সা তৈরি।

নিচে এ সম্পর্কে  আলোচনা করা হলো-

১. স্থান নির্বাচন :

নার্সারি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্থান নির্বাচনে ভুল হলে নার্সারির উৎপাদন ও লাভ দুটিই ব্যাহত হয়। উত্তম স্থান নির্বাচনের জন্য বিবেচ্য বিষয় হলো-

ক। নির্বাচিত জমি উঁচু, সমতল এবং বর্ষাকালে জলমুক্ত থাকবে।

খ। জমির মাটি উর্বর বেলে দো-আঁশ ও কাকরমুক্ত হবে।

গ। নার্সারির জায়গায় প্রচুর আলো ও বাতাসের সুবিধা থাকবে।

ঘ। পানি সেচ ও নিকাশের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।

ঙ। মালামাল ও উৎপাদিত চারা পরিবহনের জন্যউন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

চ। নার্সারি এলাকার জলবায়ু ও আবহাওয়া নার্সারি স্থাপনের অনুকুল হতে হবে।

ছ। নার্সারি ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা থাকবে।

জ। এলাকার জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে। পলিব্যাগে চারা উৎপাদনের জন্য ১ বর্গমিটার বা ১০ বর্গফুট নিম্নোক্ত মাপের পলিব্যাগের প্রয়োজন হয়।

১৫সে.মি. ১০ সে.মি. মাপের ব্যাগ ২২৫ টি

২৫ সে.মি. ১৫ সে.মি. মাপের ব্যাগ ১০০ টি ৪০ সে.মি. ২৩ সে.মি. মাপের ব্যাগ ৩৬ টি

নার্সারির বেডে চারা উৎপাদনের জন্য ১ বর্গমিটার বা ১০ বর্গফুট নিম্নোক্ত চারা সংকুলান হয়।

চারা হতে চারার দূরত্ব                চারার সংখ্যা

৫ সে.মি. ০ ৫ সে.মি.                        ৪00 টি

১০ সে.মি. ০৫ সে.মি.                       ২০০টি

১০ সে.মি. ০০১০ সে.মি.                    ১০০ টি

একটি ৪০ মিটার ১০৪ ফুট সাইজের বেড হতে ১৫ সে.মি. ১০ সে.মি. ব্যাগের ৪০০০ টি চারা, ২৫ সে.মি. * ১৫ সে.মি. ব্যাগের ১৭০০ টি চারা ও ৪০ সে.মি. * ব্যাগের ৬২৫ টি। চারা তৈরি করা যায়।

২. ভূমি উন্নয়ন

যেখানে নার্সারি স্থাপন করা হবে সেখানকার সব গাছপালা, লতা-গুল্ম কেটে ভূমিকে পরিষ্কার করতে হবে। গাছের মুখা ও পাথরের টুকরা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। নার্সারির এলাকা যদি উঁচু নীচু থাকে তাবে তা ভালভাবে সমান করতে হবে। নার্সারির মাটি বেলে দো-আঁশ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে বাহির থেকে বেলে দো-আঁশ মাটি এনে ভরাট
করতে হবে।

৩. বেড়া বা বেষ্টনী নির্মাণ :

নার্সারিতে উৎপাদিত চারা ও কলমকে গবাদি পশু ও অন্যান্য উপদ্রব থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির হাত থেকে নার্সারির চারা

রক্ষা করার জন্য চতুস্পার্শে বেড়া দিতে হবে। সাধারণত নার্সারিতে পাঁচ ধরনের বেড়া দেওয়া
হয়। गा

ক. আর. সি. সি. পিলাযুক্ত কাঁটা তারের বেড়

খ. ইটের দেওয়া

গ. লোহার জালের বেড়া।

ঘ. জীবড় গাছের বেড়া

ঙ  . বাঁশের বেড়া।

প্রথম চারটি পদ্ধতি স্থান নার্সর জন্য প্রযোজ্য তবে অস্থায়ী নার্সারির জন্য বাঁশের বেড়া गान করা ।

৪. নার্সারির নক্সা তৈরি

নার্সারি স্থাপন পরিকল্পনা উপযুক্ত নক্সা তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নক্সা অনুযায়ী পরবর্তীতে নার্সারি স্থাপন করা হয়। একটি নার্সারির নক্সার নিলখত অংশসমূহ পরিকল্পিত সাজানো থাকে।

১. অফিস ও বাসস্থান নার্সারি পরিচালনায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য অফিস থাকবে। এছাড়া এদের থাকার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা ও আদর্শ নার্সারিতে থাকে।

২. নার্সারি ব্লক নার্সারিতে চারা লাগানোর জন্য যে স্থান থাকে তাকে নার্সারি ব্লক বলে।

৩. নার্সারি বেড ও পরিদর্শন পদ্ম বীজতলা ও নার্সারিতে কর্মরত লোকজনের যাতায়াতের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ নার্সারিতে থাকে।

৪. পার্শ্বনালা ও নর্দমা সেচ ও নিকাশের জন্য পার্শ্বনালা ও নর্দমা প্রয়োজন।

৫. পলিব্যাগ ভর্তির অস্থায়ী শেষ পলিব্যাগে মাটি ভর্তির জন্য নির্ধারিত স্থান।

৬. কম্পোষ্ট তৈরির গর্ত নার্সারিতে বিভিন্ন আর্বজনা পচিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করে তা মাটির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। নার্সারিতে নির্দিষ্ট

৭. সীড বেড বীজ থেকে চারা উৎপাদনের নির্ধারিত স্থান। সব বীজ পলি ব্যাগে উত্তোলন করা হয় না। সরাসরি বাজ হতে চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করা হয় এমন বীজ যে স্থানে লাগানো হয় সে স্থানকে নীড বেড বলা হয়। প্রত্যেক নার্সারিতে এর জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকতে হবে।

৮. গ্রীন হাউজ গ্রীন হাউজ হলো কাঁচ বা ফাইন্ডার কাঁচের তৈরি বিশেষ ঘর, যেখানে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত থাকে। সব ধরনের চারা উত্তোলনের জন্য এর প্রয়োজন হয় না। কিছু কিছু প্রজাতির গাছের চারা বা কলম উৎপাদনের জন্য এর প্রয়োজন হয়। যেমন- বাঁশের কলম (কাটিং) বা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত যে কোন গাছের চারা বাজারজাতকরণের পূর্বে গ্রীন হাউজে রাখা আবশ্যক।

৯. মাটি রাখার স্থান টন ও পলিব্যাগের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি রাখার স্থান।

১০. পানির উৎস গভীর বা অগভীর নলকূপ বা পুকুর ইত্যাদি।

উল্লিখিত অংশসমূহ পরিকল্পিতভাবে সাজালে কম জাগায় অপেক্ষাকৃত সুন্দর নার্সারি তৈরি করা যাবে। নার্সারি বেডসমূহ পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি হলে উত্তম, এতে সূর্যের আলো প্রতিটি বেড়ে সমানভাবে পড়বে।

দুটি বেডের মধ্যে ৪৫-৫০ সে.মি. দূরত্ব রাখাতে হবে যাতে একজন লোক বসে কাজ করতে পারে। নার্সারি বেড সাধারণতঃ ১০-১২০ ১৫-২০ মিটার মাপের হয়ে থাকে, তবে প্রয়োজনে এবং জায়গার অনুপাতে দৈর্ঘ্য কিছুটা কম-বেশী করা যেতে পারে। প্রধান পরিদর্শন পথ ৩-৪ মিটার এবং পার্শ পরিদর্শন পথ ১-২ মিটার হয়। নার্সারিতে পানি নিকাশের জন্য প্রধান নিকাশ নালা ও শাখা নিকাশ নাগা থাকতে হবে।

নিচে একটি আদর্শ নার্সারির নক্সা দেওয়া হলো। আপানার আদর্শ নার্সারিটির নক্সা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করুন এবং নিজেদের বাতায় আঁকার অভ্যাস করুন। এটি ভালোভাবে আঁকতে পারলে সহজেই যে কোন নির্ধারিত জায়গায় নার্সারি তৈরি করার নক্সা ও আঁকতে পারবেন।

 

বনজ নার্সারি স্থাপন পরিকল্পন

 

সফলভাবে নাসারি ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু সুযোগ সুবিধে এবং নার্সারি স্থাপনকারীর কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- ।

১. পানি সরবরাহ ও এর সহজলভ্যতা

২. বীজ সংগ্রহ ও গুদামজাতকরণ ।

৩. যন্ত্রপাতি ও আনুসঙ্গিক উপকরণ সংগ্রহ।

৪. মাটি, গোবর, কম্পোস্ট, রাসায়নিক সার ইত্যাদি সংগ্রহ।

৫. নার্সারি বেড তৈরি, বীজ বপন, পলিব্যাগে চারা উত্তোলন কৌশল ইত্যাদি।

৬. বিভিন্ন প্রকার ফুল-ফল, শাকসবজি ও বনজ গাছপালা সম্পর্কিত জ্ঞান।

৭. বিপণন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান।

সারমর্ম

সফল নার্সারি স্থাপনের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। নার্সারি স্থাপনের পূর্বে স্থান নির্বাচন, ভূমি উন্নয়ন, বেড়া বা বেষ্টনী নির্মাণ ও নার্সারির নক্সা তৈরি প্রথমেই বিবেচনায় আনতে হ্যা। উল্লিখিত বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বিবেচনায় এনে সুপরিকল্পিতভাবে এগোতে পারলে সহজেই একটি সুন্দর নার্সারি স্থাপন সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে নার্সারি দুই প্রকার, যথা- স্থায়ী নার্সারি ও অস্থায়ী নার্সারি।

Leave a Comment