অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

 

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা

জমিতে বীজ বপন বা রোপণের পর থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফসল তে যেসব কাজকর্ম করতে হয় সেগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা (Intercultural operation) বলে। যেমন- মালচিং, আগাছা দমন, সারের উপরি প্রয়োগ, সেচ ইত্যাদি।

চারা পাতলাকরণ (Thinning )

জমি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চারা উঠিয়ে ফেলাকে চারা পাতলাকরণ বলা হয়। প্রত্যেক জীবেরই বেঁচে থাকার জন্য কিছু চাহিদা থাকে। চাহিদাগুলো আশানুরূপভাবে পূরণ করলে তার ভেতরে লুকানো গুণাবলী (যেমন বৃদ্ধি, বিকাশ ও পূর্ণতা) সঠিকভাবে প্রকাশ পায়। গাছের বেলায় এমন একটি চাহিদা হচ্ছে তার বেড়ে ওঠার জন্য পরিমিত জায়গা (Space)।

প্রয়োজনের তুলনায় জায়গা কম হলে যেমন সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে না, , তেমনি অতিরিক্ত জায়গার ব্যবস্থা করা হলে জায়গাটির সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন কারণে বীজহার কিছুটা বেশি দেয়া হয়ে থাকে। কারণ, চারার সংখ্যা কিছুটা বেশি হলে সহজে তা উঠিয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু কম পড়লে শুন্যস্থান পূরণ করাটা তত সহজ হবে না। প্রয়োজনের তুলনায় কোন স্থানের চারার সংখ্যা বেশি হলে ফলন এবং গুণগত মানের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

পাটের বেলায় দেখা যায় গাছের ঘনত্ব বেশি হলে পাটগাছ লিকলিকে ও হালকা হয়, আবার গাছের ঘনত্ব কম হলে গাছ থেকে ডালপালা গজাবার প্রবৃত্তি বাড়ে, তাতে ফলন কম হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাছ থাকলে পুষ্টি গ্রহণ, পানির চাহিদা পূরণ ইত্যাদিতে ঘাটতি দেখা দেবার ফলে ইন্সিত ফলন পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে প্রয়োজনের তুলনায় গাছের সংখ্যা কম হলে প্রতি গাছের ফলন কিছুটা বেশি হলেও কাঙ্খিত গাছের সংখ্যা কম থাকার জন্য ফলনের ঘাটতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। সামগ্রিক ফলন কম হয়।

আগাছা দমন (Weed control)

চোখ মেললেই হাজারো রকমের গাছ দেখা যায় যাদের অনেকগুলো প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায় আবার কতকগুলোকে জন্মাতে হয়। এদের মধ্যে অনেকগুলোকে আগাছা এবং অনেকগুলোকে ফসল বলা হয়।

সংজ্ঞা : কোন স্থানে অবাঞ্ছিতভাবে জন্মানো গাছকে আগাছা (Weed) বলে ।

পান্তরে যেসব গাছকে যত্নের সাথে চাষাবাদ করতে হয় এবং যারা মানুষ এবং গৃহপালিত পশুপাখীর জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে তাদেরকে বলা হয় ফসল। আগাছার উদাহরণ- শ্যামা, দুর্বা, চাপড়া, বন্ধুয়া, দন্ডকলস ইত্যাদি। আর ফসলের উদাহরণ হলো ধান, পাট, আখ, সরিষা ইত্যাদি।

প্রতিরোধ (Prevention )

আগাছার বিস্তার ঘটতে বাধা প্রদানের প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ বলে। যেমন- ফসল বীজের সঙ্গে আগাছার বীজ বপন না করা, গোবর বা কম্পোস্ট ভালভাবে না পচিয়ে জমিতে প্রয়োগ না করা, কারণ ভালভাবে না পচালে গোবরে জীবনীশক্তি সম্পন্ন আগাছার বীজ থেকে যায়। এছাড়া পরিষ্কার কর্ষণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, খাল, সেচনালা পরিষ্কার রাখা ইত্যাদির মাধ্যমেও আগাছা প্রতিরোধ করা যায়।

দমন (Control)

আগাছার প্রাদুর্ভাব কমানোর প্রক্রিয়াকে দমন বলে। একটি ফসল তে থেকে সবগুলো আগাছা না তুলেও ভাল ফসল বা ফলন পাওয়া সম্ভব। যে পরিমাণ আগাছা নষ্ট না করলে একটি ফসল সাফল্যজনকভাবে উৎপাদন করা যায় না সে পরিমাণকে বলে অর্থনৈতিক তিকর পর্যায় (Economic injury level)। এটি হলো দমনের সঠিক মাত্রা ।

 

উচ্ছেদ (Eradication )

আগাছাকে মূলসহ কান্ড, ডালপালা, পাতা, ফুলফল, বীজ, মাটিতে পড়া বীজ ইত্যাদি এমনভাবে নষ্ট করে দেয়া হয় যাতে এ জায়গায় কোনদিনই এ জাতের আগাছাটি আর জন্মাতে না পারে। আগাছা দমনের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে যথা :

ক) পরিচর্যা পদ্ধতি,

খ) রাসায়নিক পদ্ধতি,

গ) জৈবিক পদ্ধতি।

পরিচর্যা পদ্ধতি (Cultural method)

ফসল উৎপাদনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে আগাছা নষ্ট করাকে পরিচর্যা পদ্ধতি বলে, যেমন হাল, মই, নিড়ানী দেয়া, আঁচড়া দেয়া ইত্যাদি।

রাসায়নিক পদ্ধতি (Chemical method)

কোন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে আগাছাকে নষ্ট করার প্রক্রিয়াকে রাসায়নিক পদ্ধতি বলে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য আগাছা নষ্ট করতে সম তাদেরকে আগাছানাশক বা হার্বিসাইড /উইডিসাইড বলে। যেমন- ধান েতের শ্যামা ঘাস নষ্ট করতে ষ্টাম এফ-৩৪, প্রোপানিল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর ও কম ব্যয়বহুল।

নির্দিষ্ট রোগের জন্য যেমন নির্দিষ্ট ঔষধ আছে তেমনি আগাছার বেলায়ও নির্দিষ্ট আগাছা ধ্বংস করার জন্য নির্দিষ্ট আগাছানাশক রয়েছে। আমাদের দেশে আগাছানাশক ব্যবহার হয় না বললেই চলে। আজকাল রনষ্টার নামক একটি আগাছানাশক বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।

জৈবিক পদ্ধতি (Biological method)

যখন কোন জীব বা অণুজীব দিয়ে আগাছা নষ্ট করা হয় তাকে জৈবিক পদ্ধতিতে আগাছা দমন বলে । যেমন- আর্জেন্টিন মথ বোরার নামক পোকার শুককীট ফনিমনসা আগাছাকে খেয়ে ফেলে। এদের বেলায় একটি ভয় থাকে আগাছা শেষ হয়ে গেলে এরা হয়তো ফসল গাছকেও খেয়ে ফেলতে শুরু করে দিতে পারে । আমাদের দেশে সাধারণত পরিচর্যা পদ্ধতিতেই আগাছা দমন করা হয়ে থাকে।

জমি প্রস্তুতির সময় বেশ কয়েকবার হাল এবং মই দিতে হয়, তাতে অনেক আগাছা মরে যায়। পরবর্তীকালে ফসল তে
আগাছা বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে নিড়ানী দিয়ে আগাছা উঠিয়ে ফেলা হয়। শুকনা জমিতে আগাছার উপদ্রব বেশি হলে আঁচড়া দিয়েও আগাছা দমন করা হয়, এতে অতিরিক্ত ফসলের চারাও পাতলা হয় । সারিবদ্ধভাবে লাগানো ফসল তে নিড়ানী ছাড়াও ছোট কোদাল, হ্যান্ডহো (Hand hoe) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

ভেজা অবস্থায় সারিবদ্ধ ধান তে জাপানীজ রাইস উইডার (Japanese rice weeder) নামক যন্ত্র দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। আগাছা বড় হয়ে গেলে কাচি দিয়ে কেটে নিতে হয়। আগাছা দমনের সাফল্য ফসলের বপন পদ্ধতির উপর অনেকটা নির্ভরশীল। রোপা তে বা সারিবদ্ধভাবে লাগানো তে তাড়াতাড়ি ও নিপুণভাবে আগাছা দমন করা যায়। ছিটিয়ে বোনা তে আগাছা দমন বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।

ধানের েতে শুকনা কিংবা ভেজা যে কোন অবস্থাতেই আগাছা দমন করা যেতে পারে কিন্তু পাট েেতর মাটি স্যাঁতসেঁতে বা ভেজা থাকা অবস্থায় বা মাটিতে পায়ের ছাপ পড়লে তে নিড়ানি দেয়া ঠিক নয়। মাটিতে পা ডেবে গেলে শিকড় ছিড়ে যায় এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যায় ।

মালচিং (Mulching )

জমির উপরের স্তরে নরম একটি আস্তরণ সৃষ্টি করাকে মালচিং বলে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো বা ভূমিরস সংর ণ। আমদের দেশে শুকনা মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-এপ্রিল) মাটির আর্দ্রতা খুব কম থাকে। তখন মালচিং খুব উপকারী ও ফলপ্রসু।

জমিতে বীজ বপনের পর বৃষ্টিপাত হলে মাটির উপরের স্তর শক্ত হয়ে যায় এবং ফাটল ধরে এবং ফাটলের ভেতর দিয়ে পানি অতি দ্রুত বাষ্পীভবনের মাধ্যমে উড়ে যায়। আবার চাষকৃত ঝুরঝুরে জমি থেকেও পানি সহজে উড়ে চলে যায় এতে ফসলে পানির অভাব দেখা দেয় ।

মালচিং দু’রকমের হয় – স্বাভাবিক মালচিং ও কৃত্রিম মালচিং ।

স্বাভাবিক মালচিং

শক্ত মাটির উপরে কোদাল, নিড়ানি বা আঁচড়ার সাহায্যে মাটি নরম করে মাটি দিয়ে হালকা আবরণের সৃষ্টি করাকে স্বাভাবিক মালচিং বলে। এতে মাটির কৈশিক নালীর (Capillary pore) খোলা মুখ মাটি চাপা পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে মাটির পানি বাষ্পের আকারে সরাসরি উড়ে যেতে পারে না, বাধাগ্রস্থ হয়ে মাটিতেই থেকে যায়।

কৃত্রিম মালচিং

ফসল বপন বা রোপণের পর জমির উপর খড়কুটা দিয়ে আলগা একটি আস্তরের সৃষ্টি করাকে কৃত্রিম মালচিং বলে। আলু, মরিচ, বাদাম ইত্যাদি ফসলে কৃত্রিম মালচিং খুবই কার্যকর। কৃত্রিম মালচিং মাটির পানি সংরণ করা ছাড়াও আগাছা দমনে সহায়তা করে। আমাদের দেশে কৃত্রিম মালচিং এ খড়কুটা, ঘাস, কচুরিপানা, ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।

 

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন, মালচিং

 

এগুলো পচে গিয়ে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। উন্নত দেশে খড়কুটার পরিবর্তে কাগজ, রাবার বা প্লাষ্টিক শীট মাল্‌চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেসব শীটে গাছের চারা বের হয়ে আসার জন্য আগে থেকেই ছিদ্র করে দেয়া থাকে।

Leave a Comment