আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পরিবেশ দূষণ ও য়িষ্ণু কৃষি পরিবেশ
Table of Contents
পরিবেশ দূষণ ও য়িষ্ণু কৃষি পরিবেশ
দূষণ (Pollution)
সহজ কথায় মাটি, পানি ও বাতাসে তিকর দ্রব্যাদি সংযোগ/ মিশ্রণের ফলে পরিবেশের প্রাকৃতিক গুণাবলী নষ্ট হওয়াকে দূষণ বলে। যেমন- মাটিতে সারের অতিরিক্ত সংযোগ, পানিতে কীটনাশক মিশ্রণ ও বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়ানো
পরিবেশ দূষণ (Environmental pollution)
পরিবেশ দূষণ হলো আমাদের চারপাশের পরিবেশে তিকর পরিবর্তন ঘটানো। এগুলোর অধিকাংশই মানুষের এমন সব কর্মকান্ড যাতে জীবসমূহের সংখ্যা, শক্তি ও বিকিরণ ভারসাম্য, রাসায়নিক ও অজৈব গঠন ইত্যাদি তিঘড় হয় ।
কৃষি পরিবেশের য়িষ্ণু অবস্থা (Degradation of agricultural environment)
মানুষ তার মৌলিক চাহিদা ও অন্যান্য কল্যাণে পরিবেশের বিভিন্ন অঙ্গকে ব্যবহার করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একাজে মানুষ যখন যৌক্তিক সীমা লঙ্ঘন করে তখনই পরিবেশ দূষিত হয়, বিপদ সঙ্কুল হয়। সৃষ্টি হয় পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। এটাই পরিবেশের য়িষ্ণু অবস্থা। কৃষি পরিবেশের য়িষ্ণু অবস্থা কী তা আলোচনা করা যাক ।
“ভাতে-মাছে বাঙালি” একটি পুরনোপ্রবাদ। আবশিক্যভাবেই ধান উৎপাদন বাংলাদেশের কৃষির সর্ব বৃহৎ প্রক্রিয়া। বিগত তিনদশক ধরে বর্ধিত খাদ্য চাহিদার মোকাবিলায় অবিরত ধান চাষ করা হয়েছে। উন্নত জাতের ধানের আবাদ ক্রমেই বেড়েছে। তাই বেড়েছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও সেচ পানির ব্যবহার। উল্টোদিকে কমেছে জৈব সার ব্যবহার আর সেচের পানির উৎস।
এতে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়েছে। জ্বালানী, কাঠ ও অন্য প্রয়োজনে ক্রমে বন-জঙ্গল উজাড় হয়েছে। বন, জমি, পাহাড় ও বসতবাড়ি হতে ক্রমাগত ভূমি য় হয়েছে। নিম্নভূমি, বিল, খাল, নদী, জলাভূমি ভরাট হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে জলাধার শুকিয়ে অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদন কমেছে। মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। মাছের তীব্র অভাব অনুভূত হচ্ছে।
বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততার প্রকোপ ক্রমে বাড়ছে। বিভিন্ন অপরিকল্পিত উন্নয়নও কৃষি পরিবেশ বিনষ্ট করেছে। সার্বিকভাবে কৃষি পরিবেশ এখন নানা দূষণ ও বিরূপ অবস্থার ফলে য়িষ্ণু অবস্থায় উপনীত ।
য়িষ্ণু কৃষি পরিবেশ (Degraded agricultural environmental)
বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশের দূষণ, য়, বিরূপতা ও অনুৎপাদনশীলতা কম-বেশি এর প্রায় সকল অঙ্গেই ঘটেছে। এর বিশদ বিবরণ এরূপ পরিসরে করা সম্ভব নয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি কৃষি প্রক্রিয়া/ প্রযুক্তি/ অবস্থাসমূহের দ্বারা কৃষি পরিবেশে তিকর/বিরূপ প্রভাব সংপ্তিভাবে নি েআলোচনা করা হলো।
অবিরত একক ফসল (ধান) চাষ
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় একই জমিতে বছরে দুই বা তিনবার পর পর ধান চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে-
- জমিতে জৈব পদার্থ দ্রুত কমে যাচ্ছে
- মাটিতে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দিচ্ছে
- প্রতি বছর ফসলে পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে
- মাটির গঠন পরিবর্তিত হচ্ছে, পানি ধারণমতা কমছে
- স্বল্পকালীন গো-চারণ এলাকা কমে যাচ্ছে।
সেচযুক্ত বোরো ধানের আবাদ জমি
মাঝারি উঁচু, মাঝরি নিচু ও নিচু এলাকায় সেচযুক্ত উন্নত বোরো ধান চাষের আবাদ প্রতি বছর বাড়ছে। ফল দাঁড়িয়েছে নিম্নরূপ-
- শুষ্ক মৌসুমে রবি ফসল বিশেষত: ডাল ও তৈলবীজ আবাদ এলাকা কমে গিয়েছে
- গ্রামীণ মানুষের খাদ্যে প্রোটিন ও স্নেহ জাতীয় উপাদান কমে যাচ্ছে
- ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে পানীয় জল ও সেচের পানির অভাব হচ্ছে
- মাছের প্রজনন ও চারণ ত্রে কমে গিয়েছে (নিচু জলাশয়, বিল এলাকা)
- ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির আধার শুকিয়ে যাচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে
- অনেক স্থানীয় বোরো ধানের জাত বিলুপ্ত হয়েছে
- শুষ্ক মৌসুমে তে দাঁড়ানো পানি মশার বংশ বৃদ্ধি ও উৎপাত বাড়িয়েছে।
ডাল ও তৈলবীজ আবাদ কমে যাওয়া
আমন ধান কাটার পর পর জমি শুকিয়ে যাওয়া এবং প্রায় সকল জমিতে গম বা বোরো ধান চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে রবি মৌসুমে বিভিন্ন ডাল ও তৈলবীজ ফসল আবাদ কমে গিয়েছে। এর ফলে-
- দেশের ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন কমেছে, আমদানি বেড়েছে
- পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য উৎপাদন কমেছে
- মাটির জৈব পদার্থ কমেছে ও মাটির পানি ধারণমতা কমে যাচ্ছে
- মাটির উপকারী অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে
- মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব ধর্মের গুণগত পরিবর্তন ঘটছে।
পাট চাষ কমে যাওয়া
পাটের বাজার মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম থাকায় এবং বিকল্প কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার বাড়ায় বিগত দশকে পাটের চাষ উলেখযোগ্য হারে কমেছে। এতে যা হচ্ছে তা হলো-
- জৈব জ্বালানী ও গৃহস্থালী উপাদানের তীব্র অভাব
- মাটির জৈব পদার্থ ও উর্বরতা কমে যাওয়া গোবর, ঘাস, পাতা ইত্যাদির জ্বালানীরূপে ব্যবহার
- গৃহস্থালী ঘর-বাড়ীর কাজে বাঁশ ব্যবহার বৃদ্ধি
- কৃষি জমিতে আগাছার উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়া
একই জমিতে ক্রমাগত কলা/ই, চাষ
বাংলাদেশের উঁচু ও মাঝারি উঁচু এলাকায় কোথাও কলা বা কোথাও ই লাভজনক ফসল রূপে একই জমিতে দীর্ঘদিন চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে-
- মাটির জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে
- মাটির পুষ্টি উপাদানের অভাব ঘটছে মাটি হতে পানি শোষণ বেশি হচ্ছে
- সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে
- মাটির গুণগত পরিবর্তন ঘটে পরে অন্য ফসল আবাদ ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে (ফলন কমে যাচ্ছে)
অধিক রাসায়নিক সার (অন্যান্য) ব্যবহার
বর্তমানে প্রচুর টি.এস.পি (Triple super phosphate), পটাশ (Muriate of potash), জিপসাম এবং কোথাও দড় ও বোরন সার জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু জৈব সার অনেককম বা কিছুই দেয়া হচ্ছে না। এর প্রভাবে-
- মাটির জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে
- মাটির পুষ্টি উপাদানের অভাব ক্রমেই বাড়ছে
- অব্যবহৃত সার নিচু স্থানের জমি ও পানিতে জমে দূষণ বাড়ছে
- জলজ পরিবেশে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে
- মাটিতে উপকারী জীব ও অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে
- ফসলের ফলন ক্ৰমে কমছে
- মাছ ও জলজ প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
উপকূলীয় চিংড়ি চাষ বিস্তৃতি
দেশের দ িণাঞ্চলে উপকূলবর্তী স্থানে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক বাগদা চিংড়ির চাষ বাড়ছে। এটি দেশে বৈদেশিক মুদ্রা লাভের পাশাপাশি কৃষি পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে। যেমন—
- জমিতে ক্রমাগত লোনা পানি ঢুকানোর ফলে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে ধান উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে
- উপকূলীয় জনগণের অন্যত্র স্থানান্তর শুরু হয়েছে
- উজানের নদীর পানি প্রবাহ কমছে, তাই উপকূলীয় লবণাক্ততা ক্রমে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে।
সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ
দেশে ফসল উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন সেচ প্রকল্প এলাকায় এবং বন্যার হাত হতে জমি রায় বন্যা প্রবণ এলাকায় বাঁধ দেয়া হয়েছে। তছাড়া রাস্তাঘাট নির্মাণেও উঁচু বাঁধের ন্যায় কাঠামো গড়ে উঠেছে। কৃষি পরিবেশে এসব বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব পরিকল্পনায় স্থান না পাওয়ায় এগুলোর ফলে-
- বাঁধের ভিতর এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, ফসল উৎপাদন হ্রাস বা বন্ধ হয়েছে
- মুক্ত জলাশয়ের মাছ প্রাপ্তি বন্ধ হয়েছে, মাছ চাষও করা যাচ্ছে না, মাছের প্রজাতি লুপ্ত হচ্ছে
- মাটি য় হয়ে ভরাট হচ্ছে সেচ খাল, নালা
- পরিবেশে জীব-বৈচিত্রতা হ্রাস পেয়েছে, ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।
অপ্রচলিত জ্বালানি ব্যবহার
গ্রামাঞ্চলে জৈব জ্বালানির প্রচলিত উৎস পাটকাঠি, বিভিন্ন গাছপালা ও বাঁশ। সাম্প্রতিককালে এসবের অভাবে গোবর, লতা-পাতা, ঘাস, ধৈঞ্চা, ফসলের উচ্ছিষ্ট, খড় প্রভৃতি জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে –
- জমিতে জৈব সার বা জৈব পদার্থের উৎস ও ব্যবহার মারাত্মকভাবে কমেছে; জমি অনুর্বর হচ্ছে
- পশুপাখির খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে
- মাছ চাষে উপকরণের অভাব হচ্ছে
- সবুজ সার রূপে ধৈঞ্চার প্রয়োগ কমেছে।
ভূমিয়
ফসলের জমি, বসতবাড়ি, ভিটা, উঁচু ভূমি, নদীকূল, পাহাড় প্রভৃতি স্থান হতে বিভিন্ন কারণে ভূমি হচ্ছে। এর ফলে-
- মাটির উর্বরতা হ্রাস ও ফসল উপযোগীতা বিনষ্ট হয়
- মানুষ বসতভিটা, ফসলের ত ইত্যাদির বিপুল য় হলে স্থানান্তর হয়
- কীটপতঙ্গ ও পশুপাখির আবাসস্থল বিনষ্ট হয়
- নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট হয়ে নানা কৃষি সমস্যা ঘটায়।