পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট এবং এর তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত।
Table of Contents
পাটের রিবন রেটিং
পাঠ: ৫.৩ | ইউনিট: ৫ | বিষয়: বিশেষ উৎপাদন-সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি
এ দেশের পাট অঁাশের গুণমান অত্যন্ত উন্নত হলেও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে পাট উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কোনো না কোনো মাত্রায় পাট চাষ হয়। তবে কিছু জেলা পাট চাষে বিশেষভাবে এগিয়ে, যেমন:
পাট উৎপাদনে অগ্রগামী জেলা |
জামালপুর |
টাঙ্গাইল |
ফরিদপুর |
রংপুর |
যশোর |
কুষ্টিয়া |
পাবনা |
রাজশাহী |
ঢাকা |
পাট পচানোর সমস্যায় রিবন রেটিংয়ের গুরুত্ব
অনেক এলাকায় পাট কাটার পর পর্যাপ্ত পচনযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। ফলে ঐসব অঞ্চলে সাধারণ পদ্ধতিতে পাট পচানো সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে একটি কার্যকর পদ্ধতি— রিবন রেটিং।
রিবন রেটিং কী?
রিবন রেটিং হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কাঁচা পাট গাছ থেকে ছাল বা বাকল আলাদা করার পর তা অল্প পানিতে পচানো হয়। এই ‘রিবন’ শব্দের অর্থ ‘ফিতা’ আর ‘রেটিং’ অর্থ ‘পচানো’। অর্থাৎ, পাটের ছালকে ফিতার মতো করে কেটে কম পানিতে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পচানো হয়।
রিবন রেটিংয়ের সুবিধাসমূহ:
- ✅ অল্প পানিতে পচানো সম্ভব, ফলে পানি সংকট এলাকায় কার্যকর।
- ✅ ছাল ছাড়ানো সহজ হয়, শ্রম ও সময় সাশ্রয় হয়।
- ✅ খরচ কম পড়ে।
- ✅ পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি, পানিদূষণের হার কম।
- ✅ পাটের অঁাশের গুণমান ভালো থাকে।
- ✅ পাটের বাজারমূল্য বাড়ে।
পাটের অঁাশের গুণাগুণ নির্ভর করে পচন পদ্ধতির উপর, আর পাটের মূল্য নির্ভর করে সেই অঁাশের মানের উপর।
সুতরাং:
পচন পদ্ধতি ↔ অঁাশের গুণমান ↔ পাটের বাজারমূল্য—এগুলো একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পাটের রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহ:
পাট চাষের আধুনিকীকরণ ও মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে রিবন রেটিং পদ্ধতি একটি কার্যকর কৌশল। এই পদ্ধতিতে পাট গাছের কাঁচা ছাল ছাড়ানো এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা পচিয়ে আঁশ তৈরি করা হয়। নিচে এই পদ্ধতির ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
ক) ছাল বা বাকল ছাড়ানোর পদ্ধতি (রিবনিং)
ধাপ | কার্যবিবরণ |
১ | ৬ ফুট দীর্ঘ একটি বোরাক বাঁশের উপরের প্রান্তটি আড়াআড়িভাবে কেটে ইংরেজি ‘T’ বা ‘ট’ অক্ষরের মতো আকৃতি দিতে হবে। এটিই বাঁশের হুক হিসেবে কাজ করবে। |
২ | এসব বাঁশ মাটিতে এমনভাবে পুততে হবে যাতে একটির থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩–৩.৫ ফুট হয়। |
৩ | বাঁশগুলোর হুকের সাথে একটি মুরুলি বাঁশ বেঁধে আড়া তৈরি করতে হবে, যাতে পাটগাছ কেটে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। |
৪ | পাটগাছ আড়ায় স্থাপনের আগে গোড়ার ৩–৪ ইঞ্চি একটি কাঠের হাতুড়ি দিয়ে থেতলে দিতে হবে। |
৫ | থেতলানো অংশ থেকে হাত দিয়ে ছাল দুইভাগ করে ধরে হুকের মাধ্যমে টান দিলে ছাল সহজেই ছাড়ানো যায়। এতে কাঠি আলাদা হয়ে যায়। |
৬ | একসাথে ৩–৪টি পাট গাছের ছাল ছাড়ানো সম্ভব। ছালগুলো পরিমাণমতো একত্র করে গোলাকার মোড়া বাঁধতে হয়। |
এই ছাল ছাড়ানোর যন্ত্রকে রিবনার বলা হয় এবং এই প্রক্রিয়াকেই রিবনিং বলে। বর্তমানে লোহার সিঙ্গল ও ডাবল রোলার রিবনার ব্যবহারে আরও দ্রুত ও সহজ রিবনিং সম্ভব হয়েছে।
খ) ছাল পচানোর পদ্ধতি
পাট গাছের কাঁচা ছাল তিনটি পদ্ধতিতে পচানো যায়:
পদ্ধতির ধরন | বিবরণ |
১. ড্রাম বা চাড়ি ব্যবহার | ৩০ কেজি কাঁচা ছাল ড্রাম বা মাটির চাড়িতে সাজিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ভরে রাখলে পচন সম্পন্ন হয়। |
২. প্রাকৃতিক জলাধারে ঝুলিয়ে পচানো | ছালগুলো লম্বা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে ডোবা/পুকুর/খালে ডুবিয়ে রাখা হয়। |
৩. কৃত্রিম গর্ত তৈরি করে পচানো | ১৫–১৬ ফুট দীর্ঘ, ৬–৭ ফুট প্রস্থ ও ১.৫–২ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে, তলা ও কিনারা পলিথিন দিয়ে ঢেকে ছাল পানিতে ভিজিয়ে পচানো হয়। |
প্রতিটি পদ্ধতিতেই কচুরিপানা, খড়, বা চট দিয়ে ছাল ঢেকে দিতে হয় এবং ১২–১৫ দিনে পচনক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
গ) কম সময়ে ছাল পচানোর পদ্ধতি
উপায় | কার্যবিবরণ |
১. ইউরিয়া ব্যবহার | প্রতি ১০০০ কেজি কাঁচা ছালের জন্য ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পচন দ্রুত হয়। |
২. পূর্ব–পচিত পাট গাছের পানি ব্যবহার | কিছু পাটগাছ কেটে ছোট টুকরো করে ছোট হাঁড়িতে পচিয়ে সেই পানি মূল পচন প্রক্রিয়ায় মিশিয়ে দিলে পচন ত্বরান্বিত হয়। |
এই রিবন রেটিং পদ্ধতির সুফল:
- কম পরিশ্রমে দ্রুত ছাল ছাড়ানো যায়
- আঁশের গুণমান ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়
- পরিবেশবান্ধব ও কম খরচে কার্যকর প্রক্রিয়া
ঘ) ছাল পচনের সমাপ্তি নির্ণয়
পচনের মাত্রার ওপর পাটের ছালের গুণগত মান নির্ভর করে। যদি পচন কম হয়, তাহলে অঁাশের সঙ্গে শক্ত দাগ থেকে যায়, যা গুণগত মান হ্রাস করে। পচনের মাত্রা এমন হওয়া উচিত যাতে অঁাশগুলো একটির সাথে অন্যটি আটকে না থাকে।
পচনের সমাপ্তি পরীক্ষা করার পদ্ধতি:
- পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর ৮ থেকে ৯ দিন পর ছালের পচন সঠিকভাবে হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে।
- মোড়া বাঁধা ছালের মধ্য থেকে একটি ছালের গোড়ার দিকের প্রায় ২.৫ সে.মি. কেটে তা পরিষ্কার পানির বোতলে ঝাকিয়ে পানি ফেলে দিয়ে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে ঝাকালে যদি দেখা যায় অঁাশগুলো বেশ আলাদা আলাদা হয়ে গেছে, তাহলে বোঝা যায় পচন শেষ হয়েছে।
- এছাড়াও দু’একটি ছাল নিয়ে পানিতে ধুয়ে যদি অঁাশগুলো আলাদা আলাদা মনে হয়, তাও পচনের সমাপ্তি নির্দেশ করে।
ঙ) পাটের ছাল বা আঁশ ধৌতকরণ
পরিষ্কার পানিতে অঁাশগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে পরে আটি বাঁধতে হয়।
চ) পাটের আঁশ শুকানো
- রৌদ্রময় স্থানে বাঁশের আড় তৈরি করে অঁাশগুলো শুকাতে হয়।
- শুকানোর পর অঁাশগুলো একত্রে বেঁধে রাখতে হয়।
- অতিরিক্ত শুকানো বা কম শুকানো উভয়ই গুণগত মানে ক্ষতি করে। বেশি শুকালে অঁাশ ভঙ্গুর হয়, আর কম শুকালে পানি থাকায় অঁাশ পচে যায়।
রিবন রেটিং পদ্ধতির গুরুত্ব
ক্র. নং | উপকারিতা |
১ | পানি স্বল্পতাজনিত এলাকায় পাট পচানোর জন্য অত্যন্ত উপযোগী। |
২ | এ পদ্ধতিতে ছাল পচাতে কম জায়গা ও পানি লাগে। |
৩ | প্রচলিত জাক পদ্ধতির অর্ধেক সময়েই ছাল পচে যায়। |
৪ | পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি জমে না, ফলে স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব। |
৫ | অঁাশে কাটিংস না থাকার কারণে গুণগত মান উন্নত ও বাজার মূল্য বেশি। |
৬ | প্রাপ্ত পাট খড়ি শক্তিশালী ও টেকসই হয়, জ্বালানী সাশ্রয় হয়। |
৭ | প্রতি বিঘা জমির জন্য মাত্র ৪-৫ জন শ্রমিক প্রয়োজন। |
৮ | চাষীকে প্রচলিত জাক পদ্ধতি ভাবতে হয় না। |
৯ | প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় খরচ কম। |
১০ | পচানো পানি জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। |
১১ | অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। |
রিবন রেটিং পদ্ধতির সতর্কতা
- দেশি ও কেনাফ পাটের ছাল সহজে ছাড়ানো যায়, তাই এ ধরণের পাট পানি স্বল্প এলাকায় চাষ করতে হয়।
- অনুমোদিত মাত্রায় সার ব্যবহার করলে রিবনিং ভাল হয়।
- পাট গাছে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে রিবনিং কঠিন হয়, তাই পাট কাটার ২-৩ দিন আগে হালকা সেচ দিতে হয়।
- পাতা ঝরানোর সঙ্গে সঙ্গে রিবনিং করতে হয়, কারণ রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ছাল ছাড়াতে সমস্যা হয়।
- পাট পচন গর্তের চারপাশ উঁচু করে বেঁধে রাখতে হবে যাতে বাইরের পানি গর্তের ভিতরে ঢুকতে না পারে।
এভাবেই রিবন রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে পাটের ছাল ছাড়ানোর কাজ সম্পাদন করলে সময়, খরচ, শ্রম এবং গুণগত মান সকলেই সুরক্ষিত থাকে।
সারাংশ :
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এদেশে উৎপাদিত পাটের অঁাশের মান খুবই ভালো। পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না এমন এলাকায় রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানো হয়। রিবন রেটিং পদ্ধতির ধাপসমূহ হলো পাটের ছাল ছাড়ানো, ছাল পচানো, কম সময়ে ছাল পচানো, ছাল পচনের সমাপ্তি নির্ণয়, ছাল বা অঁাশ ধৌতকরণ ও অঁাশ শুকানো। রিবন রেটিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।