আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পাট চাষ
Table of Contents
পাট চাষ
জমি নির্বাচন
উর্বর দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে বেলে ও এঁটেল মাটি ছাড়া সব জমিতেই পাট চাষ করা যায়। যে জমিতে বর্ষার শেষের দিকে পলি পড়ে সে জমি পাট চাষের জন্য উত্তম। তোষা পাট উঁচু জমিতে এবং দেশী পাট উঁচু ও নিচু দু’ধরনের জমিতেই চা করা যায়।
পাটের জাত, বপণ সময় ও বীজহার
নিচে দেশী ও তোষা পাটের জাত, বপন সময় ও বীজহার ছকাকারে উল্লেখ করা হলো :
(কেজি/হেক্টর)
বগন সময়
বীজহার
দেশী পাট সিসি-৪৫, সিভিই-এ, নিভি, এবং ১, ডি-১৫৪, এটা গটি এবং ১৫ মার্চ-১৫ এপ্রিল, সারিতে ৫-৬ কেজি
ছিটিয়ে ৭-৯ কেজি
তোষা পাট: 3-8, 3-৯৯৯৭ (ফাল্গুনী তোমা, সি. জি. (চিনসূর হীন ) ১৫ই এপ্রিল – ১৫ই মে
সারিতে ৩.৭৫-৫.০ কেজি ছিটিয়ে ৬-৮ কেজি
সঠিক সময়ের আগে বা পরে বীজ বুনলে আলোক সংবেদনশীলতার কারণে পাট গাছ সুষ্ঠুভাবে বাড়তে
পারে না, অসমনে ফুল দেখা দেয় এবং পাটের ফলন মারাত্মকভাবে কমে
জমি তৈরি
জমির জো অবস্থায় ৫-৬ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়। এবং জমি থেকে আগাছা, পূর্ববর্তী ফালের গোড়া, শিকড় ইত্যাদি বেছে পরিষ্কার করতে হয়।
সার প্রয়োগ
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (১৯৯২) সুপারিশ অনুযায়ী সার ব্যবস্থা মাত্রা নিম্নরূপ
উপরি প্রয়োগে ব্যবহৃতব্য
গোবর সার প্রয়োগ করতে চাইলে বীজ বপনের ১৪-২১ দিন আগে গোবর জমিতে ছিটিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। শেষ চাষের সময় ইউরিয়া সারের প্রথম অংশসহ অন্যান্য সব সার ছিটিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ বপন করার ৬-৭ সপ্তাহ পর প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিতে হবে। ছিটানোর সময় ইউরিয়া দানা যেন কচি পাতায় লেগে না থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে পাটের পাতা ক্ষতিগ্রড হবে। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে উপরি প্রয়োগ করা কাম্য।
বীজ শোধন
বীজ বপন করার আগে শোধন করে নেয়া উত্তম। প্রতি কেজি পাট বীজের সাথে ২০ গ্রাম সেরিসান বা এপ্রোসান জি এন অথবা ২০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ৫০% বা ক্যাপটান ৭৫% ওষুধ মিশিয়ে বীজ শোধন করে নেয়া উচিত। বীজ শোধনকারীর রাসায়নিক দ্রব্যের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
বপন পদ্ধতি
সারিতে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সে.মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৭-১০সে.মি। বীজ বেশি পরিমাণে বোনা হলে বীজ খরচ বেশি ছাড়াও জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলতে খরচ বেশি পড়ে। বেশি পাতলা হলে গাছে শাখা-প্রশাখা গজায়, ঘন হলে জীর্ণ শীর্ণ হয়, উত্তম আঁশ প্রাপ্তির জন্য কোনটাই কাম্য নয়।
পরিচর্যা
চারা পাতলাকরণ ও আগাছা দমন চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর একবার ঘন জায়গায় দূর্বল চারাগুলো তুলে ফেলা ও জমির আগাছা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এর ১৫ দিন পর আরও একবার চারা পাতলাকরণ ও আগাছা তুলে ফেলা আবশ্যক। প্রতি হেক্টর জমিতে ৪,৪০,০০০ টি চারা থাকলে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করা যায়।
পোকামাকড় দমন পাট ক্ষেত্রে বিছা পোকা, পাটের এলিওন, ঘোড়া পোকা, উড়চুঙ্গা, মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে থাকে। কৃষি কর্মকর্তা, ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ অনুযায়ী এগুলো দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোগ দমন পাটগাছ ঢলে পড়া, কাজ পড়া, কালো পট্টি, অকনো ক্ষেত, গোড়া পচা ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এগুলো দমনের জন্য থানা কৃষি কর্মকর্তা বা ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ নিন।
পাট কাটা ও আঁটি বাঁধা
উন্নতমানের আঁশের জন্য গাছে ফুল ধরার সময় পাট কাটতে হয়। তবে এক্ষেত্রে ফলন কম হয়। ভালো ফলন ও আঁশ পাওয়ার জন্য ফুল থেকে ফল ধরার সময় পাট কাটার উত্তম সময়। বেশি মোটা করে আটি বাধলে পড়তে বেশি সময় লাগে। এ জন্য ১৫-২০ সে.মি.
পাতা ঝরানো ও গোড়া ডুবানো
পাট জাগ দেয়ার আগে পাতা করিয়ে নেয়া উচিত। কারণ পানকারী অণুজীব পাটের শত্রু কাজের চেয়ে নরম পাতা বেশি পছন্দ করে। এজনা পাতা থাকলে পাট পচতে অসুবিধা হয়। আঁটি বাঁধার পর আটির আভাগকে অপর আঁটির গোড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হয় এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে সাজাতে হয়।
৪-৫ দিন পর আঁটিগুলো তুলে একটু ঝাঁকুনি দিলেই পাতা ঝরে পড়বে। পাট গাছের গোড়া মোটা ও শক্ত বিধায় মধ্য ও অগ্রভাগের তুলনায় দেরিতে পড়ে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য গোড়ার দিকটা ৩-৪ দিন পানির ভিতর রেখে আঁটিগুলো খাড়াভানে স্তূপ করে রাখা হয়। এরপর জাগ দিলে পাটের আগা গোড়ার একসাথে পচনক্রিয়া তনু হয়।
জাগ দেওয়া
পাটকে পচানোর জন্য পালো আছিলো সাজিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখাকে জাগ দেওয়া বলা হয়। কম প্রোরবিশিষ্ট পরিষ্কার পানিতে পাট জাগ দিতে হয়। বন্ধ পানিতেও জাগ দেওয়া যায় তবে সেক্ষেত্রে প্রতি ১০০ আলির জন্য ১ কেজি ইউরিয়া সার ভাগের উপর ছিটিয়ে দিতে হয়।
এতে পা এবং আনের মান ভালো হয়। বেশি পরিমাণ লৌহযুক্ত পানিতে পট ছাগ নেওয়া উচিত নয়। এতে পাটের ট্যানিনের সাথে লৌহযুক্ত হয়ে পাটের আঁশের রং কালো করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে আঁশের ও জাগের আকার বিভিন্ন রকম হতে পার।
যেমন- পাটের আঁটিনা পোড়া মাথা একসাথে সাহিতে বেলে দিতে হয়। পরে দ্বিতীয় ন একই নিয়মে সাজাতে ও বেঁধে দিতে হয়। আাগের উপর মাটি কলাগাছ, বিলাগাছ প্রভৃতি ব্যবহার করে জাগ জুরানো বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে পাটের আঁশের রং কালো হয়।
বিজ্ঞানসম্মত উপায় হলো আগের দুই পার্শ্বে শক্ত খুঁটি পুতে আম ডুবানো। তবে কচুরিপানা, পাছার বা কংক্রীটের চাকতিও ব্যবহার করা যেতে পারে। জাগ দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে আাগের উপরে কমপক্ষে ৩০ সে.মি. এবং নিচে কমলাক্ষে ৬০ সে.মি. পানি থাকে। পাট পচনের সমাপ্তি নির্ণয় পাট পচনের মাত্রা এমন হওয়া উচিত যাতে আঁশগুলো একটির সাথে অন্যটি লেগে না থাকে। দেবার ১০-১১ দিন পর থেকেই পাটের পচন পরীক্ষা করে যেতে হবে। কৃষকরা সাধারণত জাগ থেকে ৪-৫ টি পাট গাছ টেনে বের করে ছাল ছাড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখে।
তবে বিজ্ঞানসম্মত উপায় হলো ২-৩ টি পাট গাছ জাগ থেকে বের করে তার মাঝখান থেকে ২.৫ সে. মি. পরিমাণ ছাল কেটে তা একটি পানি ভর্তি শিশির ভিতর নিয়ে ঝাঁকাতে হবে। পরে এই ছালগুলো পুনরায় পরিষ্কার পানি ভর্তি শিশির ভিতর নিয়ে ঝাঁকানোর পর যদি দেখা যায় যে আঁশগুলো ভালোভাবে পৃথক হয়ে গেছে তবে বুঝতে হবে পাটের পচন শেষ হয়েছে। সাধারণত পাট পচতে ১৫-২৫ দিন সময় লাগে।
আঁশ ছাড়ানো ও পরিষ্কারকরণ
পচার পর পাট গাছ থেকে দুভাবে আঁশ ছাড়ানো যায় –
শুকনো জায়গায় বসে প্রতিটি পাট গাছ থেকে আলাদা আলাদাভাবে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর কায়েকটি পাট গাছের আঁশ একত্রে করে ধুয়ে নেওয়া হয় এবং আঁটি বেঁধে রাখা হন। এক্ষেত্রে পাটের কারি ভাষা হয় না বিধায় আস্ত থাকে। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে পাটের আঁটির কাঠ বা বাঁশের মুর যারা পিটানো হয়। এরপর গোড়া থেকে ৪০-৪৬ সে.মি. দূরে ভেঙ্গে পানির মধ্যে লভাবে কয়েকটি বাঁকি দিলেই গোড়ার পাটকাঠি বের হতো নানা। পরে গোড়ার আশ হাতে পেচিয়ো নিয়ে পানির উপর সমান্তরালভাবে সামনে পিছনে ঠেলা দিলেই অর্থভাগের পাটকাঠি বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে আঁশগুলো ভালোভাবে বৃয়ে নিয়ে আঁটি বেঁধে রাখা
আঁশ শুকানো ও সংরক্ষণ
প্রখর সূর্যালোকে বাঁশের আড় তৈরি করে তাতে পাটের আঁশ শুকানো হয়। আঁশ বেশি অকালে তা ভঙ্গুর হয় এবং কম কোলে ভিজা থাকে বিধান পচনকিয়া হয়। এতে আদের জনগ মান নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সঠিকভাবে পাটের আঁশ শুকিয়ে নেয়ার পর সুন্দর করে বেঁধে নামে । জাতভেদে ফলনের তারতম্য হয়। তোষা পাটেনা তুলনায় দেশী পাটের ফলন সামান্য বেশি হয়। দেশী পাটের ফলন প্রতি হেক্টরে ৪.৫-৫.৫ টন এবং তোষা পাটের ফলন ৪-৫ টন পর্যন্ত
সারমর্ম
বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাট অন্যতম। এদেশের মাটি, জলবায়ু ও পরিবেশ পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। উর্বর দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য উত্তম। জো অবস্থায় ৫০ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই নিয়ে পাটের জমি তৈরি করতে হয়।
জমি তৈরির শেষচাষের সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়াসহ সকল ान সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। ফুল থেকে ফল ধরার সময় পাট কাটলে ভালো আঁশ ও ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া পাতা ঝরানো, জাগ দেওয়া আঁশ ছাড়ানো ও অকানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।