ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ

ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ৯ নং ইউনিটের ৯.১ নং পাঠ।

ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ

ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ

ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচনশীল খাদ্য দ্রব্য বা মাঠ থেকে সংগ্রহ করার অল্প দিনের মধ্যেই সেগুলো খেয়ে ফেলতে হয়। বেশি দিন রেখে দিলে সেগুলো পচে নষ্ট হয়ে যায়। শাকসবজি ও ফল পচনের কারণ ও লক্ষণ গুলো নিচে আলোচনা করা হল।

১। পরিবেশ প্রতিকূল অবস্থা :

 

(ক) তাপমাত্রা :

উচ্চতাপমাত্রা শাক সবজি ও ফল পচনের জন্য দায়ী ফল ও শাকসবজির কোষ স্বাভাবিক থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। প্রতি ১০ সে. তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শ্বসনের মাত্রা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়, ফলে আভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত ইথিলিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যা শাকসবজি ও ফলে দ্রুত পচন ঘটায়। এমতাবস্থায় রোগজীবাণুর বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণ বেড়ে যায় যা ফল ও শাকসবজিতে পচন ঘটায়।

 

(খ) আর্দ্রতা :

আর্দ্রতা কমে গেলে (৮৩—৮৫% এর কম) ফল ও শাক সবজি অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।

 

(গ) বায়ুচলাচল :

শাকসবজি ও ফল যেখানে সংরক্ষণ করা হয় সেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইডের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচে যায়।

 

ফল ও শাকসবজি

 

২। শ্বসন :

ফল ও শাকসবজি সংগ্রহ করার পর যে সব আভ্যন্তরীণ মেটাবলিক পরিবর্তন ঘটে শ্বসন তাদের মধ্যে প্রধান। বিভিন্ন এনজাইমে র প্রভাবে শ্বসন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এতে ফলের অভ্যন্তরে যে শর্করা থাকে তা রাসায়নিক ভাবে ভেঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরি হয় এর ফলে ফল দ্রুত পচে যায় আবার শ্বসন বাড়লে ফল ও সবজিতে ইথিলিনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং শাকসবজি ও ফল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

 

৩। পানির পরিমাণ কমে যাওয়া :

ফল ও শাকসবজিতে জলীয় অংশ থাকে বেশি। সংগ্রহের পর শ্বসন ও প্রস্বেদনের মাধ্যমে দ্রুত পানি বের হয়ে যায় এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পানির অভাবে ফল ও শাকসবজি নেতিয়ে পড়ে, কুকড়ে যায়, দ্রুত সজীবতা হারায় ও খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।

 

৪। রোগজীবাণু ও পোকার আক্রমণ :

রোগজীবাণু ও পোকার আক্রমণে অনেক ফল ও শাকসবজি নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক উচ্চতাপে এবং অধিক আর্দ্রতায় সক্রিয় হয়ে উঠে এবং দ্রুত ফল ও শাকসবজিকে সংক্রমিত করে পঁচিয়ে ফেলে।

 

৫। সংরক্ষণ জনিত ত্রুটি :

সঠিক পদ্ধতিতে ফল ও সবজি সংরক্ষণ করা না হলে, সংরক্ষণ কক্ষের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি উপযোগী না হলে ফল ও সবজি পচে যায়।

 

৬। পরিবহণজনিত ত্রুটি :

পরিবহনের সময় ফল ও সবজি বাক্স বা ঝুড়িতে একটির উপর আর একটি ¯প ক‘ রে নেয়া হয়। পরিবহনের সময় ঝাকুনি, আঘাত বা চাপে ফল বা সবজি অনেক সময় থেতলে যায় বা আঘাত প্রাপ্ত হয়। এসব পণ্য তখন দ্রুত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় ও নষ্ট হয়ে যায়।

 

৭। পরিপক্কতা এ ফলের জাত ও ধরণ :

গাছ থেকে অপরিপক্ক ফল সংগ্রহ করলে দ্রুত পচে যায়। আবার বিভিন্ন ফল ও সবজির ভিন্ন ভিন্ন জাতের সংরক্ষণ গুণ ভিন্ন হয়।

 

৮। বাছাইজনিত ত্রুটি :

ফল ও সবজি সংগ্রহের পর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাছাই করতে হয়। আঘাত প্রাপ্ত, থেতলানো বেশি পাকা ফল বা সবজি আলাদা করা না হলে অন্যান্য ফল ও সবজিও দ্রুত পচে নষ্ট হয়ে যায়।

 

ফল ও শাকসবজি পচনের লক্ষণ:

১। ফল ও শাকসবজির গায়ে কালো, বড় দাগ হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সাদা বা ছাইয়ের মত আবরণ পড়ে।

২। ফল ও শাকসবজির রং পবির্তন হয়, বিবর্ণ হয়ে যায়।

৩। ফল ও শাকসবজি বেশি নরম হয়ে যায়।

৪। অনেক সময় ফল ও সবজির গায়ে গর্ত বা ছিদ্র তৈরি হয়।

৫। ফল ও শাকসবজি থেকে দুর্গন্ধ বের হয় ও পঁচা রস বের হয়।

৬। এদের স্বাদ পরিবর্তন হয়ে বেশির ভাগ সময় তিক্ত স্বাদ যুক্ত হয়।

৭। ফল ও শাকসবজির ওজন বেড়ে যায়।

৮। ফলের সাথে খোসা আলগাভাবে লেগে থাকে।

ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কিছু কিছু সবজি ও ফল আছে যা সারা বছর পাওয়া যায়। তবে অনেক ফল ও সবজি মৌসুমে উৎপন্ন হয়। যেমন আলু, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, আম, জলপাই, পেয়ারা ইত্যাদি। এই সমস্ত ফল ও সবজি সারাবছর বা অমৌসুমে খেতে চাইলে তাদের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিকল্প নাই।

আবার অনেক সময় উৎপাদন মৌসুমে কোন কোন ফল ও সবজি প্রচুর উৎপন্ন হয় যা চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে। এগুলো অনেক সময় পচে নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ আম, টমেটোর আনারস ইত্যাদি। এই অপচয় রোধের জন্য ও মারাত্মক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য ফল’ ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ 3 ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ ও লক্ষণ

 

শাকসবজি ও ফল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা:

যে সব কারণে শাকসবজি ও ফল সংরক্ষণ করা প্রয়োজন তা নিচে আলোচনা করা হল:

১। ফল ‘ও শাকসবজিকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন:

২। মৌসুম ছাড়াও বছরে অন্যান্য সময় বিভিন্ন ফল’ ও শাকসবজির সরবরাহ করার জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

৩। শাক সবজি বাজারজাত কাজের সময় ও পরিধি বৃদ্ধি পায়।

৪। দেশের সব স্থানে সব ধরণের ফল’ ও শাকসবজি উৎপন্ন হয় না, ফল ‘ও শাকসবজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে সারাদেশের সব স্থানেই ঐ সব ফল ও সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

৫। বিদেশে রপ্তানি করার সময় পরিবহনের সময়, অনেক ফল ও সবজি পচে যায়। সঠিকভাবে এগুলো সংরক্ষণ করে রপ্তানি করা হলে সবগুলোর গুণাগুন অক্ষুন্ন থাকবে এবং রপ্তানি আয়ও বাড়বে।

৬। আর্থিকভাবে বেশি লাভাবন হওয়া যায়। উৎপাদন মৌসুমে ফল’ ও শাকসবজির দাম কম থাকে। এগুলো সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যায়।

৭। ফল’ ও শাকসবজি থেকে চিপস, জুস, জ্যাম, জেলী, আচার মোরোব্বা ইত্যাদি তৈরি করে সারা বছর খাওয়া যায়।

৮। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বিভিন্ন খাদ্য পণ্য উৎপাদন করতে সারা বছর প্রচুর ফল’ ও শাকসবজি ব্যবহার করা যায়।

৯। ফল’ ও শাকসবজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে তার পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। ফলে সারাক্ষণ মানুষের পুষ্টির চাহিদা পুরণ হয়।

১০। আপদকালীন বা অসময়ের প্রয়োজন মেটানো যায়।

১১। অনেক সময় সংরক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ফল ও সবজি পচে নষ্ট হয়। ফলে কৃষক আর ঐ ফসল ফলাতে আগ্রহী হয় না। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে কৃষক ঐ সব ফসল উৎপাদনে আরও উৎসাহিত হবে।

১২। ফল ও সবজি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত করণ সরবরাহ ও ক্রয় বিক্রয় প্রক্রিয়ায় অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।

১৩। সর্বোপরি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment