বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

বাংলাদেশের বন এলাকা

বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ১৭.০৯% অর্থাৎ প্রায় ২৪.৬ লক্ষ হেক্টর। নানা কারণে সকল বনভূমি এলাকা বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত নয়। এছাড়া বন সমস্ত দেশব্যাপী সমানভাবে বিস্তৃত নয়। বেশিরভাগ বনভূমি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।

কিন্তু বিস্তীর্ণ পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেবনভূমির পরিমাণ অনেক কম। মানচিত্রে বনভূমির অবস্থান দেখানো হয়েছে। এদেশে প্রকৃতপক্ষে বৃক্ষ- আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৭ ভাগের নিচে। অবস্থান ও বিস্তৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে তিন ভাগে করা যায়। যথা-

(১) পাহাড়ি বন

(২) সমতল ভূমি

(৩) ম্যানগ্রোভ বন

 

বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

 

(১) পাহাড়ি বন

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট এলাকা জুড়ে পাহাড়ি বন বিস্তৃত। দেশের মোট বন এলাকার অর্ধেকের বেশি এলাকা জুড়ে এ বন অবস্থিত। মোট পাহাড়ি বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৩.৬ লক্ষ হেক্টর। এ বনের প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে এখন গাছপালা নেই বললেই চলে।

অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃক্ষ কর্তন এবং ব্যাপকভাবে ঝুম চাষের ফলে পাহাড়ি বনের অধিকাংশ এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। এ সমস্ত বৃক্ষশূন্য এলাকাতে এখন পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ এলাকায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত চট্টগ্রাম ২৫০ সেমি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ২২৫ সেমি, ও সিলেটে সর্বোচ্চ ৫০০ সেমি।

এ অঞ্চলের মাটিতে হিউমাস বা জৈব পদার্থের আধিকা হেতু মাটির রং কালো হয়। বাংলাদেশের অন্য যেকোন বনাঞ্চলের তুলনানা এ বনাঞ্চলে অধিক পরিমাণে চিরহরিৎ ও পরকারা উদ্ভিদ জন্যে। গভীর উপত্যকা ও যেসব এলাকায় পানির প্রাচুর্য রয়েছে সেখানে ঘনন্তের বিশিষ্ট চিরহরিৎ উদ্ভিদ জন্যে।

এ বনাঞ্চলে বিভিন্ন উদ্ভিদের মধ্যে সেগুন, গর্জন, চাপালিশ, কড়ই, তেলসুর, হারগোজা, বৈলাম, মেহগনি, গামার, জারুল, চম্পা, ময়নাকাট ইত্যাদি উলেখযোগ্য। তাছাড়া এ বনে প্রচুর পরিমানে বাঁশ জন্মে। বিভিন্ন ধরণের পাখি ও উল্লুক, চিতাবাঘ, ভল্লুক, হাতি, বানর, হরিণ, বনমোরগ, গেছোব্যাঙ, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রাণী এ বনে দেখা যায়। বিষধর সাপ গোখরা এবং বৃহদাকৃতির অজগর সাপও এবনে দেখা যায়।

 

বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

 

(২) সমতল ভূমির বল

বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাংগাইল, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী এবং কুমিল্লা অঞ্চলের বনাঞ্চল নিয়ে সমতল ভূমির বন গঠিত। সাধারণত লোকালয়ের কাছাকাছি সমতল ভূমিতে এ ধরনের বনের সৃষ্টি। এ বনের প্রধান উদ্ভিদ শাল। আমাদের দেশে সমতল ভূমির পরিমাণ প্রায় ১.২ লক্ষ হেক্টর। এ বনাঞ্চলে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১৭৫ সেমি।

এখানকার মাটিতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল নয়। এ অঞ্চলের মাটি লাল বালু সমৃদ্ধ ও অনুর্বর, ফলে শীতকালে মাটি শুকিয়ে যায় । এ বনাঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদগুলো হলো শাল, জারী, অর্জুন, হরিতকি, আমলকি, সিধা, জারুল, কড়ই, জিগা, হলুদ, আদা, বনহলদি, কুচি ইত্যাদি।

লোকবসতির নিকটবর্তী হওয়ার গাছ কাটার চাপ এ বনের উপর অনেক বেশি। অনেকে বনের গাছ কেটে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র তৈরির কাজে লাগায়। আবার অনেকে গাছ কেটে সেখানে চাষাবাদ করে। বনের মধ্যে এভাবে গাছকেটে চাষাবাদ করার স্থানকে বাইন বলে।

এসব কারণে বনাঞ্চল প্রায় বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এসব বনাঞ্চলের খালি স্থানগুলোতে নতুনভাবে গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা চলছে। এ বনে কৃত্রিমভাবে লাগানো গাছগুলোর মধ্যে-অর্জুন, আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস উল্লেখযোগ্য।

(৩) ম্যানগ্রোভ বন

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে এক বিশেষ ধরনের বনাঞ্চল পরিলক্ষিত হয়, এদেরকে ম্যানগ্রোভ বা লোনা পানির বনাঞ্চল বলা হয়। এ বনাঞ্চলের মাটি প্রতিদিন দুবার সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানি দ্বারা সিঙ্ক হ্যা বলে একে লোনা পানির বনাঞ্চলও বলা হয়।

এছাড়া সমুদ্র উপকূলবর্তী চট্টগ্রামের চকোরিয়া অঞ্চলে সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্য হেতু, একে সুন্দরবনও বলা হয়। এ বনে সুন্দরী বৃক্ষের পাশাপাশি গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা, হাড়গোজা, ভোলা, কাকড়া, বাইন, গরাণ, পতন, হিন্দল ইত্যাদি উদ্ভিদ জন্মে ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদগুলো অন্যান্য বনের উদ্ভিদগুলো অপেক্ষা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়।

এসকল উদ্ভিদে শ্বাসমূল তৈরি হয়। বনে মাটি সব সময় ভেজা বা কর্দমাক্ত থাকায় শ্বাসমূল তৈরি হয়। তাছাড়া এ বনের অধিকাংশ উদ্ভিদে বীজ গাছে থাকা অবস্থায় অঙ্কুরিত হন। এ ধরনের অঙ্কুরোদগমকে সরায়ুজ অঙ্কুরোদগম বলে।

 

বনাঞ্চলের বিস্তৃতি

 

বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এ বনের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া এ বনে হরিণ, বানর, বনকর, অজগর, কুমির ও বিভিন্ন ধরনের পাখি বসবাস করে। সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জন্মে গোলপাতা। গোলপাতা ঘরের ছাউনি ও ঘরের বেড়া তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ বনে প্রচুর পরিমাণে মধু পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬২২১ বর্গ কি.মি.। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনের বিস্তৃতি এককভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম। বর্তমানে একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন এলাকার – লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার সুন্দরী বৃক্ষের আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপকহারে সুন্দরীবৃদ্ধ মারা যাচ্ছে। পরিকল্পিত উপায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুন্দরবনকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

সারমর্ম

• বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৪.৬ লক্ষ হেক্টর। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত মোট বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৭ ভাগের নিচে।

অবস্থান ও বিস্তৃতিভেদে বন তিন ধরনের-

  • পাহাড়ি বন
  • সমতল ভূমি
  • ম্যানগ্রোভ বন।

Leave a Comment