বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল – যা বনায়ন এর অন্তর্ভুক্ত। অরণ্য বা বন হলো ঘন বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদের দ্বারা ঘেরা একটি এলাকা। বিভিন্ন মাপকাঠির ভিত্তিতে, বনের নানান ধরনের সংজ্ঞা আছে। ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০০৬ সালে অরণ্য চার বিলিয়ন হেক্টর (১৫ মিলিয়ন বর্গ মাইল) বা বিশ্বের জমির প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে।

বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল

 

বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল

 

বন নার্সারির

বীজ বনজ উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

বীজ হলো উদ্ভিদের প্রধান বংশ বিস্তারকে উপকরণ। ভালো চারা পেতে ভালো বীজ প্রয়োজন। এ জন্য নির্দিষ্ট গুণাগুন সম্পন্ন মাতৃগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত বীজ আহরণ থেকে রোপনের পূর্ব পর্যন্ত সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে বাঁজ পোকা-মাকড়, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি দিয়ে আক্রান্ত হয় । ফলে বীজের মানের অবনতি হয়।

অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায় । তাছাড়া বীজ বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে এর গুণাগুণ নির্ণয় করতে হবে। বীজকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করণের পর বাজারজাতকরণ ও বিতরণ করা দরকার। এ পাঠে আমরা নির্বাচন, বীজ সংগ্রহ, পদ্ধতি, বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বীজ পরীক্ষা ও বীজ বপন পূর্ববর্তী প্রক্রিয়াকরণ সম্পর্কে জানব।

মাতৃগাছ নির্বাচনঃ মধ্য বয়সী, সুস্থসবল, রোগমুক্ত এবং অধিক ফল উৎপাদনকারি গাছকে নির্বাচন। নির্বাচিত এসব গাছ থেকে উপযুক্ত সময়ে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। আমাদের দেশে বীজ মাতা গাছ এক বা একাধিক উৎস হতে শনাক্ত করে বীজ সংগ্রহ করা হয়। যেমন-

  • নিজ ও অন্য এলাকার কৃষকের বাড়ি
  •  পার্ক বা বাগান এলাকা বা বনাঞ্চল
  •  রাস্তার পাশের বৃক্ষ
  •  বিভিন্ন স্থায়ী নার্সারি, প্রভৃতি ভালো চারা উৎপাদনের জন্য উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন মাতৃগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা অপরিহার্য।

বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি

সাধারণত দুইভাবে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয় ।

  • ভূমি হতে বীজ সংগ্রহ : বীজ পাকার পর যখন কিছু বীজ মাটিতে পড়ে তখন বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময় । বীজ পাকার মধ্যবর্তী সময়ে এ বীজ সংগ্রহ করতে হয়। যেসব গাছের ফল পেকে ফাটে না এবং বীজ ছড়িয়ে পড়ে না সেসব বীজ এ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়। সেগুন, গর্জন, শাল, কদম, পিতরাজ, তেলসুর প্রভৃতি উদ্ভিদের বীজ ভূমি থেকে সংগ্রহ করা যায়।
  • গাছ থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহ : এ পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যখন ফল পরিপক্ক হবে তখন দা বা ছুরি দিয়ে গাছের ছোট ছোট ডাল কেটে সরাসরি গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করা হয়। ছোট ছোট বীজ যা মাটিতে পড়লে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় ফলে মাটিতে হতে সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। সে সব বীজ এ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়। যেমন-

ক) পড় জাতীয় – বাবুল, কড়ই, খ) ক্যাপসিউল মেহগনি, চাম্পা, গ) কোন পাইন ।

গাছ থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহের পর রোদে শুকাতে হবে। এরপর পড়, ক্যাপসুল বা কোন ফাটিয়ে বীজ পৃথক করতে হবে।

বীজ নিষ্কাশন : ফল সংগ্রহ করার পর বীজগুলোকে শাস, আবর্জনা, খোসা ইত্যাদি থেকে পৃথক করাই হলো বীজ নিষ্কাশন। বীজ নিষ্কাশনের প্রধান তিনটি পদ্ধতি হলো-

  • ১. বাছাই পদ্ধতি : যে সব গাছের অঙ্কুরোদগমকাল সংক্ষিপ্ত অর্থাৎ ৪-৭ দিন, এসব ক্ষেত্রে বাছাই পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এসব গাছের গোটা ফলই বীজ হিসাবে বপন করা হয়। যেমন- নারিকেল, গর্জন, শাল, সেগুন বীজ রৌদে শুকালে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে।
  • ২. শুকনো পদ্ধতি : জারুল, তুলা, ইপিল-ইপিল, মেনজিয়াম, বাবলা মেহগনি, কড়ই গাছের বীজ শুকনো পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। গাছ থেকে ফল পেড়ে ভালো করে রোদে শুকাতে হয়। ফল ফেটে যখন বীজ বেরিয়ে আসে, তখন মাড়াই করে বীজ নিষ্কাশন করা হয়।
  • ৩. পচন পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে ফল পানিতে পড়ানোর পর বীজ বের করা হয়। যেমন- আম, কাঁঠাল, তেঁতুল, পেয়ারা ইত্যাদি তার পরে বাতাসে শুকাতে হয়।

বীজ সংরক্ষণ

গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের পর পরবর্তী বপন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা হয়। সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ না করলে বীজের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বীজের মানের অবনতি হয়। যেমন- গর্জন, শাল, সেগুন, চাপালিশ, তেলসুর প্রভৃতি গাছের বীজ গুদামজাত করলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। এসব গাছের বীজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই বপন করতে হবে। বীজ অপেক্ষাকৃত হালকা করে ছিটিয়ে গুদামজাত করা আবশ্যক। বীজ সব সময় শুকনো রাখতে হবে ।

অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে বীজ রাখতে হবে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বীজ খোলা অবস্থায় রাখা হয়। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এবং রেফ্রিজারেটর এ বীজ সংরক্ষণ করা যায়।

বন নার্সারি তৈরির কৌশল

স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় নার্সারি তৈরির জন্যই প্রয়োজন সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও কিছু নিয়মনীতি ।

স্থায়ী নার্সারি

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্থায়ী নার্সারি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বন বিভাগ, হর্টিকালচার, বিএডিসির উদ্যান, প্রাইভেট নার্সারি কেন্দ্রগুলো স্থায়ী নার্সারি। স্থায়ী নার্সারি স্থাপনের বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো।

১. স্থান নির্বাচন

আলো বাতাসপূর্ণ খোলা মেলা উঁচু ভূমি হবে। বর্ষার পানি উঠে না এবং জলাবদ্ধাতা হয় না এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। উর্বর বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটি সম্পন্ন হবে। উন্নত যোগাযোগ ও পানির সুষ্ঠ ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যাপ্ত জমি ও শ্রমিক পাওয়া যায় এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।

২. নার্সারির জায়গার পরিমাণ নির্ণয়

এক বর্গমিটার সাঁড় বেড বা পট বেডের জায়গা নির্ণয় ।

 

বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল

 

বন নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল

 

৩. বেড নির্মাণ

অনিষ্টকারী জীবজন্তুও পথচারীদের হাত থেকে চারা গাছ রক্ষা করার জন্য বেড়া দেওয়া দরকার। স্থায়ী নার্সারিতে বেড়া দেওয়ার উপায়ক –

  • ক) ইটের দেয়াল : স্থায়ী নার্সারির চার দিকে উঁচু ইটের দেয়াল নির্মাণ করে বেড়া দেওয়া যায় ।
  • খ) কাঁটা তারের বেড়া: স্থায়ী নার্সারিতে কাঁটা তারের বেড়া সহজে দেওয়া যায়।
  • গ) লোহার জালের বেড়া: লোহার জাল খুঁটির সাথে বেঁধে দিয়ে বেড়ার পাশ দিয়ে জীবন্ত গাছ লাগানো যেতে পারে। কাঁটা তারের বেড়ার মতো এ বেড়াতেও তিন ধরনের খুঁটি  ২ মিটার অন্তর অন্তর ব্যবহার করা যায়।
  • ঘ) জীবন্ত গাছের বেড়া : দূরন্ত, কাঁটা মেহেদী, মেন্দী, ঢোল কলমী প্রভৃতি জীবন্ত গাছ দিয়ে নার্সারির চার দিকে স্থায়ী বেড়া দেওয়া যায়।

৪. ভূমি উন্নয়ন

নার্সারি স্থান নির্বাচনের পর পরই উন্নয়নের কাজ করতে হয়। নার্সারি বেড় তৈরির স্থান উত্তমরূপে পরিষ্কার করতে হবে । মাটি তৈরির সময় বৃষ্টি বা সেচের পানি যাতে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য মাটি ঢালু ও ডেন করতে হবে। ভূমির মাটি দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ হতে হবে।

৫. অফিস ও আবাসিক এলাকা

নার্সারির অফিস ঘরটি প্রধান রাস্তার পাশে মূল গেটের কাছে অবস্থিত হওয়া প্রয়োজন। অফিস ও আবাসিক এলাকা চারা উৎপাদন এলাকার বাইরে রাখতে হবে। নার্সারি এলাকার ভিতরে আবাসন ঠিক নয় ।

৬. বিদ্যুতায়ন :

স্থায়ী নার্সারিতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকা ভালো। এতে নার্সারি রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা হয় ।

৭. রাস্তা ও পথ নার্সারিতে প্রবেশের জন্য একটি প্রধান রাস্তা থাকা আবশ্যক। প্রধান রাস্তাটি পরিকল্পিতভাবে নার্সারির ভিতরের পথগুলোর সাথে যুক্ত থাকবে।

৮. সেচ ব্যবস্থা নার্সারিতে চারা উত্তোলনের জন্য পানি প্রয়োজন। সে জন্য নার্সারি স্থাপনের শুরুতেই উত্তম সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. নর্দমা ও নালা

নার্সারিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে প্রয়োজনীয় নর্দমা ও পার্শ্বনালার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

১০. নার্সারি ব্লক

নার্সারির চারা উত্তোলনের স্থানকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করতে হবে। প্রত্যেক ব্লককে আবার কয়েকটি সাড় বেড় বা পট বেডে ভাগ করতে হবে। প্রত্যেক ব্লকে ১০-১২ টি বেড থাকতে পারে। গ্রিন হাউজ সেড রাখার জায়গা, কমপোস্ট তৈরির গর্ত, মাটি রাখার স্থান ইত্যাদিও সুবিধামতোভাবে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করে। দিতে হবে।

১১. নার্সারি বেড

বেড সাধারণত দুই রকম হতে পারে-

  • ক) সরাসরি বীজ বপন করে চারা উত্তোলনের জন্য বেডঃ এ জন্য জমি ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। জমির মাটির কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে করতে হবে। সব রকম আগাছা নুড়ি পাথর পরিষ্কার করে ভালো করে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। অতঃপর জায়গা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ১ মিটার ৩ মিটার ২০ সেমি আকারে বেড তৈরি করতে হবে। বেড তৈরির পর প্রয়োজনীয় গোবর বা কমপোস্ট ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে কয়েকদিন রেখে দেওয়ার পর বীজ বপন করতে হবে।
  • খ) পলিব্যাগে চারা উত্তোলনের জন্য বেড তৈরি: এক্ষেত্রে মাটিতে চাষ করার প্রয়োজন নেই। কেবল দুটি বেডের মধ্যবর্তী স্থানের মাটি তুলে বেডকে ১০-১৫ সে.মি. উঁচু করে উপরিভাগ সমান করতে হয়। এরপর বেডের ধার তৈরি করা হয়। তবে নার্সারি স্থানের প্রযোজ্যতা অনুযায়ী বেডের আকার ছোট বড় হতে পারে।

সারসংক্ষেপ

নার্সারিতে ভাল চারা উৎপাদন করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন ভাল বীজ। এক্ষেত্রে মধ্য বয়সী, সুস্থসবল, রোগমুক্ত এবং অধিক ফলনশীল মাতৃগাছ নির্বাচন করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি উপযুক্ত উপায়ে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের পর পরবর্তী বপন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়। সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ ব্যতীত বীজের আশানুরূপ মান পাওয়া সম্ভব নয়।

 

Leave a Comment