রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ ও প্রতিকার

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে শিশুদের মধ্যে রাণীক্ষেত (Ranikhet) ও বসন্ত (Chickenpox) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত। এই দুইটি রোগই সংক্রামক এবং সময়মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে শিশুর স্বাস্থ্যে ও সামগ্রিক বিকাশে। রাণীক্ষেত মূলত পাখিদের মধ্যে দেখা গেলেও এটি পশু-পাখির সংস্পর্শে থাকলে মানুষের মধ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেখানে হাঁস-মুরগি পালন একটি সাধারণ চিত্র। অন্যদিকে বসন্ত একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা হঠাৎ করে শরীরে ফুসকুড়ি, জ্বর এবং দুর্বলতা সৃষ্টি করে, এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে।

রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ

রাণীক্ষেত রোগ

মুরগির সংক্রামক রোগের মধ্যে রাণীক্ষেত সবচেয়ে মারাত্মক। এটি একটি ভাইরাসজনিত ছোঁয়াছে রোগ। সময়মত টিকা না দিলে এ রোগে অনেক মুরগি মারা যায়। বছরের যে কোন সময় এ রোগ হতে পারে। তবে সাধারণত হেমন্তের শেষ থেকে শুরু করে শীতের শেষ পর্যন্ত (অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি) সময়ে এ রোগ বেশি হতে দেখা যায়।

যে কোন বয়সের মুরগিতে এ রোগ হতে পারে। এ উপমহাদেশে ভারতের রাণীক্ষেত নামক স্থানে এ রোগ প্রথম আবিষ্কৃত হওয়ায় একে রাণীক্ষেত রোগ বলা হয়। ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল নামক স্থানে এ রোগ সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হওয়ায় সারা বিশ্বে এটি নিউক্যাসল ডিজিজ নামে পরিচিত।

রোগের লক্ষণ

১। এ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়।

২। আক্রান্ত মুরগির শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত এবং মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নেয়। অনেক সময় শ্বাস নেয়ার সময় “কক, কর” শব্দ হয়। মুখ দিয়ে লালা পড়ে।

 

রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ

 

৩। আক্রান্ত মুরগি সাদা চুনের মতো পাতলা মল ত্যাগ করে। মলের রঙ অনেক সময় সবুজ, হলুদ বা এ দুই রঙের মিশ্রণও হতে দেখা যায়।

৪। পাখা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে, মুরগি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। মাথা নিচু ও চোখ বন্ধ করে ঝিমাতে থাকে।

৫। মাঝে মাঝে আক্রান্ত মুরগির ঘাড় বেঁকে যায় এবং খুঁড়িয়ে চলে।

৬। ডিমপাড়া মুরগির ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

৭। মুরগি দুর্বল হয়ে ঠোঁট ও বুক মাটিতে লাগিয়ে বসে পড়ে। পাতলা মল পেছনের পালকে লেগে থাকে।

৮। রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার দুই একদিনের মধ্যেই মুরগির মৃত্যু ঘটে। দু’একটা বেঁচে গেলেও তাদের উৎপাদন ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়।

রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ

রোগ দমন

রাণীক্ষেত রোগের কোন চিকিৎসা হয় না। নিয়মিত প্রতিষেধক টাকা দান এ রোগের হাত থেকে মুরগিকে বাঁচাবার একমাত্র উপায়। বাংলাদেশের সর্বত্র পশুসম্পদ অফিসের মাধ্যমে এ টাকা বিতরণ করা হয়ে থাকে। এ রোগের টাকা দুই রকমের হয়। যথা :

(১) বি.সি.আর.ডি.ভি

(২) আর.ডি.ভি.

১। বি.সি.আর.ডি.ভি

১ দিন বয়সের বাচ্চাকে এ টাকা দিতে হয়। এ টীকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাচ্চার ২ মাস বয়সকাল পর্যন্ত। টীকা ব্যবহার পদ্ধতি: শিশির টাকা বাঁজ ৬ সিসি পরিমাণ পরিশ্রুত পানিতে গুলে ড্রপার দিয়ে প্রতি চোখে ১ ফোটা দিতে হয়। প্রতি ১০০ মাত্রা টাকা বীজ থাকে।

২। আর ডিভি:

দুই মাস বয়সের বেশি সকল মোরগ-মুরগিকে বছরে ২ বার এ টাকা দিতে হয়।

টীকা ব্যবহার পদ্ধতি

ভায়েলের বা শিশির টীকা বীজ ১০০ সিসি পরিশ্রুত পানিতে মিশিয়ে রানের মাংসে ১ সিসি করে ইনজেকশন হিসেবে এ টীকা দিতে হয়। এ টীকা ৬ মাস পর পর অর্থাৎ বছরে ২ বার দিতে হয়।

প্রতিকার :

এ রোগের কোন চিকিৎসা হয় না। তবে আক্রান্ত মুরগিকে ০.০১% পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশানো পানি খাওয়ানো যেতে পারে। সালফাডায় জিন ট্যাবলেট বড় মুরগিকে ৪ ভাগ করে দিনে ২ বার খাওয়ানো যেতে পারে। রোগ দমনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পালন ব্যবস্থা খুবই সহায়ক। আক্রান্ত মুরগি আলাদা রাখতে হবে এবং কোথাও বিক্রি করা যাবে না। মৃত মুরগি মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।

ঊসন্তরোগ

বসন্ত মুরগির একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। এ রোগ ফাউল পক্স নামে পরিচিত। যে কোন বয়সের মুরগিতে এ রোগ হতে পারে। তবে ২-৩ মাসের কম বয়সের বাচ্চার বেলায় এ রোগে মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি। বছরের যে কোন সময় এ রোগ হতে পারে। তবে আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত সময়ে এ রোগ বেশি হতে দেখা যায়। আক্রান্ত মুরগির সংস্পর্শে এবং বাতাসের সাহায্যে এ রোগ একস্থান হতে অন্যস্থানে ছড়ায়।

 

রাণীক্ষেত ও বসন্ত রোগ

 

রোগের লক্ষণ

১। মুরগির শরীরের পালকবিহীন স্থানে, যেমন- ঠোঁটের পাশে, মাথার ফুলে, কানের লতি ও চোখের পাতায় ফোস্কা আকারে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ফোস্কা পরে গুটিতে পরিণত হয়।

২। খাওয়া কমে যায়, উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

৩। অনেক সময় চোখ বন্ধ হয়ে যায় এবং ছোট বাচ্চা মারা যায়।

৪। মুখের ভিতরে ঘা দেখা যায়, মুরগি খেতে পারে না।

রোগ দমন

এ রোগের হাত থেকে মুরগিকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় নিয়মিত টীকা প্রদান। পশুসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ টাকা দেওয়া হয়। আক্রান্ত মুরগির ফোস্কায় ডেটল, পটাশ, আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক ক্রীম বা পাউডার লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়। আক্রান্ত মুরগি আলাদা রাখতে হবে। মুরগির ঘর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

টীকা ব্যবহার পদ্ধতি

প্রথমে ভায়াল বা শিশির টীকা বীজ পরিশ্রুত পানিতে গুলে নিতে হবে। পরে দুই মুখওয়ালা একটি সুই বার বার টীকায় ডুবিয়ে ৩ বার পাখার পালকবিহীন স্থানে ছিদ্র করে এ টীকা দিতে হয়। সাধারণত বছরে একবার এ টাকা দিলেই চলে। ২১ দিন বা তদোর্ধ্ব বয়সী মুরগিতে এ
টীকা দিতে হয়।

প্রতিকার

১। পটাশের পানি দিয়ে শুঁটি বা ঘা পরিষ্কার করতে হবে।

২। ঘায়ে সালফোনিলামাইড পাউডার লাগানো যেতে পারে।

৩। আক্রান্ত মুরগি আলাদা করতে হবে।

৪। স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

সারমর্ম

রাণীক্ষেত ও বসন্ত মুরগির ভাইরাসজনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এসব রোগের কোন সন্তোষজনক চিকিৎসা নেই। নিয়মিত প্রতিষেধক টীকা দিয়ে এসব রোগের হাত থেকে মুরগিকে রক্ষা করতে হয়। যে কোন বয়সের মুরগির এ রোগ হতে পারে।

Leave a Comment