বাংলাদেশের কৃষিতে কৃষি বিষ নিরাপত্তা

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি অর্থনীতির ধারাবাহিক উন্নতির জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং বিভিন্ন কৃষি বিষ ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষের অযাচিত ও অনিরাপদ ব্যবহার কৃষক, ভোক্তা, মাটি, পানি, পরিবেশ এবং সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই কৃষি বিষ নিরাপত্তা আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও বৈশ্বিক আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশের কৃষিতে কৃষি বিষ নিরাপত্তা

 

মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা

 

কৃষি বিষের ধরন ও ব্যবহার

বাংলাদেশে সাধারণত চার ধরনের কৃষি বিষ ব্যবহৃত হয়—

  1. কীটনাশক (Insecticides): পোকামাকড় দমন করতে ব্যবহৃত হয়।
  2. ছত্রাকনাশক (Fungicides): ফসলের ছত্রাকজনিত রোগ দমনে ব্যবহৃত হয়।
  3. শাকনাশক (Herbicides): আগাছা দমনে ব্যবহৃত হয়।
  4. ইঁদুরনাশক অন্যান্য: দানাদার ফসল ও গুদামজাত পণ্যে ক্ষতিকর প্রাণী দমনে ব্যবহৃত হয়।

১৯৭০–এর দশকে বাংলাদেশে কৃষি বিষের ব্যবহার ছিল সীমিত। কিন্তু সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে হাইব্রিড বীজ, উচ্চফলনশীল জাত এবং নিবিড় চাষাবাদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি বিষের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

 

কৃষি বিষ ব্যবহারের ইতিবাচক দিক

  • কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
  • পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
  • খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা
  • কৃষকের আর্থিক ক্ষতি রোধ

তবে অতি ব্যবহার বা অনিরাপদ ব্যবহার করলে এসব সুফল পরিণত হয় ক্ষতির দিকে।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তা সমস্যা

বাংলাদেশে কৃষি বিষ ব্যবহারে কয়েকটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে:

  1. অতিরিক্ত ব্যবহার: অনেক কৃষক ধারণা করেন বেশি কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসল ভালো হয়। এর ফলে বিষাক্ততা বেড়ে যায়।
  2. অসচেতনতা: কৃষকরা লেবেলে লেখা নির্দেশনা অনেক সময় মানেন না।
  3. নকল নিম্নমানের কৃষি বিষ: বাজারে ভেজাল ও নকল কীটনাশকের প্রবণতা রয়েছে।
  4. সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব: কৃষকরা সঠিক মাস্ক, গ্লাভস বা চশমা ছাড়া স্প্রে করেন।
  5. সংরক্ষণ সমস্যা: ঘরে, রান্নাঘরে বা শোবার ঘরে কৃষি বিষ মজুত রাখা হয়, যা পরিবারের শিশু ও গবাদি পশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
  6. প্রশিক্ষণের ঘাটতি: কৃষকদের অনেকের কাছে বিষ ব্যবহারের সঠিক প্রশিক্ষণ নেই।

 

কৃষি বিষের স্বাস্থ্যঝুঁকি

কৃষি বিষের প্রভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়:

  • তাৎক্ষণিক প্রভাব: মাথা ব্যথা, বমি, চোখ জ্বালা, শ্বাসকষ্ট, ত্বক জ্বালা।
  • দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ক্যান্সার, কিডনি বিকল, স্নায়বিক সমস্যা, বন্ধ্যত্ব, শিশু জন্মগত ত্রুটি।
  • অকালে মৃত্যু: প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কৃষক কৃষি বিষে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

পরিবেশগত প্রভাব

  • মাটির উর্বরতা নষ্ট: বিষাক্ত রাসায়নিক মাটির অণুজীব ধ্বংস করে।
  • পানি দূষণ: কীটনাশক বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদী-খালে মিশে যায়।
  • জলজ প্রাণী হুমকির মুখে: মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়াসহ জলজ প্রাণী মারা যায়।
  • জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: মৌমাছি ও পরাগায়নকারী পোকা নষ্ট হয়, ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তায় আইনি কাঠামো

বাংলাদেশ সরকার কৃষি বিষ ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে—

  • কৃষি বিষ আইন, ২০১৮
  • কৃষি বিষ নিয়মাবলি, ২০১৯
  • কীটনাশক আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনুমোদন ও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
  • ভেজাল বা অবৈধ কৃষি বিষ বিক্রির জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

তবে আইন বাস্তবায়নে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন—বাজার পর্যবেক্ষণ দুর্বল, কৃষকের সচেতনতা কম, দুর্নীতি ইত্যাদি।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তা নিশ্চিতের উপায়

  1. সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। লিফলেট, পোস্টার, টিভি প্রোগ্রাম, ইউটিউব ভিডিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
  2. আইন প্রয়োগ: ভেজাল ও নকল কৃষি বিষ নির্মূল করতে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।
  3. ব্যক্তিগত সুরক্ষা: কৃষকদের স্প্রে করার সময় মাস্ক, গ্লাভস, বুট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  4. অর্গানিক জৈব কৃষি: রাসায়নিক বিষের পরিবর্তে জৈব সার, নিম তেল, ট্রাইকোডার্মা, ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।
  5. ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (IPM): প্রাকৃতিক উপায়ে কীট দমন, জৈবিক শত্রু ব্যবহার, ফসলের আবর্তন ইত্যাদি কার্যকর করতে হবে।
  6. সংরক্ষণ ব্যবস্থা: বিষ আলাদা ঘরে তালাবদ্ধ স্থানে রাখতে হবে।
  7. মনিটরিং গবেষণা: বিষের ক্ষতি ও বিকল্প প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা বাড়াতে হবে।

 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন: অনেক ক্ষতিকর কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে এবং অর্গানিক চাষাবাদ উৎসাহিত করছে।
  • ভারত: IPM প্রোগ্রাম চালু করে ধীরে ধীরে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়েছে।
  • শ্রীলঙ্কা: ভেজাল কীটনাশকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশ এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নীতিমালা ও বাস্তবায়ন কাঠামো শক্তিশালী করতে পারে।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তায় প্রযুক্তির ভূমিকা

  • মোবাইল অ্যাপ: কৃষকরা কোন বিষ, কতটা ব্যবহার করবেন তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারেন।
  • ড্রোন প্রযুক্তি: ফসলের রোগ সনাক্তকরণ ও সুনির্দিষ্ট জায়গায় বিষ প্রয়োগে ড্রোন ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • ডিজিটাল ডাটাবেস: বাজারে কোন কোন কীটনাশক অনুমোদিত, তার তালিকা অনলাইনে দেওয়া যেতে পারে।

 

টেকসই কৃষির পথে

বাংলাদেশে কৃষি বিষের সঠিক ব্যবহার, জৈব ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগ এবং কৃষক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কৃষি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কৃষি বিষ নিরাপত্তা শুধু কৃষকের জীবন রক্ষার প্রশ্ন নয়, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কৃষি

বাংলাদেশের কৃষি আজ এক দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন—একদিকে বাড়তে থাকা খাদ্যের চাহিদা, অন্যদিকে কৃষি বিষ ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি। তাই কৃষি বিষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের নয়, কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, ভোক্তা এবং সমাজের সকলের দায়িত্ব। সচেতনতা, আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিকল্প জৈব পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুস্থ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।