বাংলাদেশের কৃষিতে গবেষণা: উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত এবং কৃষি খাত জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তবে দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমি হ্রাস এবং খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে কৃষিকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও গবেষণাভিত্তিক করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে কৃষি গবেষণা বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন, কৃষি প্রযুক্তি এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রধান হাতিয়ার।

 

বাংলাদেশের কৃষিতে গবেষণা

 

কৃষি গবেষণার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে কৃষি গবেষণার ইতিহাস প্রাচীন হলেও আধুনিক গবেষণা শুরু হয় স্বাধীনতার পর।

  • পাকিস্তান আমলে কিছু কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকলেও পর্যাপ্ত সমন্বয় ছিল না।
  • স্বাধীনতার পর খাদ্য সংকট মোকাবিলায় নতুন কৃষি নীতি গ্রহণ করা হয় এবং গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
  • ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।

 

প্রধান কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ

বাংলাদেশে কৃষি গবেষণার জন্য একাধিক বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ফসল বা খাত নিয়ে গবেষণা করে এবং কৃষিকে আধুনিক ও টেকসই করার জন্য নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। নিচে সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:

১. বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৭০ সালে গাজীপুরে।

  • মূল কাজ:

    • উচ্চ ফলনশীল ধান জাত উদ্ভাবন।

    • খরা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল ধান জাত তৈরি।

    • ধানের রোগ প্রতিরোধী জাত উন্নয়ন।

    • আধুনিক ধান চাষ প্রযুক্তি প্রবর্তন (যান্ত্রিক ধান রোপণ ও কাটাইয়ের যন্ত্র)।

  • অবদান:

    • ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৭সহ শতাধিক জাত উদ্ভাবন।

    • বাংলাদেশকে চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

    • লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান-৬৭ এবং খরাপ্রবণ এলাকায় ব্রি ধান-৫৬ উল্লেখযোগ্য।

২. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৭৬ সালে গাজীপুরে।

  • মূল কাজ:

    • গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ, সবজি ও ফল নিয়ে গবেষণা।

    • উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন।

    • কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সহায়তা।

  • অবদান:

    • গমের নতুন জাত: বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, যেগুলো উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী।

    • ভুট্টার উন্নত জাত উদ্ভাবন, যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ ভুট্টা উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।

    • ডালজাতীয় ফসলে বারি মুগ-৬, বারি মসুর-৮; তেলবীজে বারি সরিষা-১৪ উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

    • সবজি ও ফলের ২০০টিরও বেশি নতুন জাত উদ্ভাবন।

৩. বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহে।

  • মূল কাজ:

    • পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের উন্নত জাত তৈরি।

    • কৃষি বায়োটেকনোলজি ও মিউটেশন ব্রিডিং।

    • রোগ প্রতিরোধী ও পরিবেশ সহনশীল ফসল উৎপাদন।

  • অবদান:

    • প্রায় ১০০টিরও বেশি নতুন জাত উদ্ভাবন।

    • ব্রি ধান-৭৪, বিনা ধান-৮, বিনা সরিষা-৯, বিনা মুগ-৮ উল্লেখযোগ্য।

    • খরা, লবণাক্ততা ও রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে বিশেষ অবদান রেখেছে।

৪. বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (BJRI)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৭৪ সালে ঢাকা।

  • মূল কাজ:

    • পাট ও পাটজাত পণ্যের গবেষণা।

    • রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন।

    • পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ।

  • অবদান:

    • উন্নত জাত যেমন BJRI পাট-২০১০, BJRI তোষা-৮ পাট উৎপাদনে বিপ্লব এনেছে।

    • পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ, জিওটেক্সটাইল, কার্পেটসহ নতুন পণ্য উদ্ভাবন করেছে।

    • বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের পাট শিল্পের পুনর্জাগরণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

৫. বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্র

  • অবস্থান: দিনাজপুর।

  • মূল কাজ:

    • গম ও ভুট্টার উন্নত জাত উদ্ভাবন।

    • রোগ প্রতিরোধী ও খরা সহনশীল জাত তৈরি।

    • আধুনিক চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন।

  • অবদান:

    • গমে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন।

    • ভুট্টা উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পোল্ট্রি ও ফিশারিজ খাতে পশুখাদ্য সরবরাহ করছে।

৬. বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (FRI)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহ।

  • মূল কাজ:

    • মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি।

    • নতুন প্রজাতির মাছ চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন।

    • মৎস্য রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জেনেটিক উন্নয়ন।

  • অবদান:

    • গিফট তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, গলদা চিংড়ির উন্নত চাষ প্রযুক্তি।

    • ইলিশ সংরক্ষণে গবেষণা।

    • মৎস্য খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা।

৭. বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (BLRI)

  • প্রতিষ্ঠিত: ১৯৮৪ সালে সাভারে।

  • মূল কাজ:

    • গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উন্নত জাত উদ্ভাবন।

    • পশুখাদ্য ও দুগ্ধ উৎপাদন প্রযুক্তি উন্নয়ন।

    • পশুর রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণা।

  • অবদান:

    • উন্নত জাতের গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি উদ্ভাবন।

    • গরুর কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি।

    • দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গবেষণা।

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষির আধুনিকায়ন এবং টেকসই উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে। ধান, গম, ভুট্টা থেকে শুরু করে মাছ, গবাদিপশু ও পাট পর্যন্ত প্রতিটি খাতে এসব প্রতিষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের গবেষণা বাংলাদেশের কৃষিকে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দেয়নি, বরং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার যোগ্য করে তুলছে।

 

গবেষণার মূল ক্ষেত্রসমূহ

. ফসল গবেষণা

  • উচ্চ ফলনশীল ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল জাত উদ্ভাবন।
  • জলবায়ু সহনশীল জাত (খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা সহনশীল)।
  • রোগ প্রতিরোধী জাত তৈরি।

. মাটি সার গবেষণা

  • মাটির উর্বরতা রক্ষা।
  • সুষম সার ব্যবহারের কৌশল।
  • জৈব সার ও সবুজ সার নিয়ে গবেষণা।

. সেচ পানি ব্যবস্থাপনা

  • পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি (ড্রিপ, স্প্রিঙ্কলার সেচ)।
  • ভূগর্ভস্থ ও উপরিভাগের পানি ব্যবহার কৌশল।

. কীটপতঙ্গ রোগ নিয়ন্ত্রণ

  • সমন্বিত কীটনাশক ব্যবস্থাপনা (IPM)।
  • জৈব কীটনাশক উদ্ভাবন।

. কৃষি যান্ত্রিকীকরণ

  • ধান রোপণ, কাটা, মাড়াইয়ের জন্য যন্ত্রপাতি।
  • কৃষিতে ড্রোন ও স্মার্ট প্রযুক্তি।

. টেকসই কৃষি পরিবেশ

  • জৈব কৃষি।
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৃষি প্রযুক্তি।
  • কৃষি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

 

কৃষি গবেষণার অবদান

  • ধান উৎপাদন বৃদ্ধি: স্বাধীনতার পর যেখানে ধানের উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি টন, বর্তমানে তা ৩ কোটিরও বেশি।
  • খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা: বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।
  • উন্নত জাত: শত শত নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
  • ফসলের বৈচিত্র্য: সবজি, ফল, ডাল ও তেলবীজ উৎপাদন বেড়েছে।
  • রপ্তানি সম্ভাবনা: পাট, আম, কাঁঠাল, সবজি, মাছ রপ্তানিতে অবদান।

 

চ্যালেঞ্জ

  1. জলবায়ু পরিবর্তন: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ফসল উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।
  2. ভূমি হ্রাস: প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমি কমছে।
  3. তহবিল সংকট: গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থায়ন হয় না।
  4. মানবসম্পদ ঘাটতি: পর্যাপ্ত গবেষক নেই।
  5. প্রযুক্তি সম্প্রসারণে ধীরগতি: উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দ্রুত মাঠ পর্যায়ে পৌঁছায় না।

 

কৃষি গবেষণায় ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

. স্মার্ট কৃষি

কৃষিতে Artificial Intelligence, IoT, ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

. জেনেটিক গবেষণা

  • জিন এডিটিং, বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চ ফলনশীল জাত তৈরি।

. জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি

  • লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল ধান ও ফসলের জাত উদ্ভাবন।

. রপ্তানিমুখী কৃষি

  • আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন।

. পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ

  • সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা।

 

ধান চাষ বাংলাদেশের কৃষিতে গবেষণা: উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

 

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে কৃষি গবেষণার কারণে ধান উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন হয়েছে এবং কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।

তবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ—জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমি হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি—মোকাবিলা করতে হলে গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি, পর্যাপ্ত অর্থায়ন, গবেষক তৈরি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা আগামী দিনে আরও শক্তিশালী হবে।