বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনের মূল চালিকা শক্তি হলো কৃষি। তবে কৃষি উৎপাদনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিভিন্ন রোগ, পোকা-মাকড় ও আগাছার আক্রমণ। দীর্ঘদিন ধরে এসব সমস্যার মোকাবেলায় কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু অতিরিক্ত ও নির্বিচারে রাসায়নিক ব্যবহারে পরিবেশ, মাটির উর্বরতা, পানির গুণগত মান এবং মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি (Biological Control Technology) ক্রমে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি

 

মাটি

 

জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি কী?

জৈব নিয়ন্ত্রণ হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে প্রাকৃতিক শত্রু যেমন—শিকারী (Predators), পরজীবী (Parasitoids), রোগজীবাণু (Pathogens) ইত্যাদি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগ দমন করা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতির ভারসাম্যকে কাজে লাগিয়ে, কৃত্রিম রাসায়নিকের বদলে প্রাকৃতিকভাবে শস্যকে সুরক্ষিত রাখা।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জৈব নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা

  1. রাসায়নিক কীটনাশকের অপব্যবহার
    বাংলাদেশের কৃষকরা দ্রুত ফল পেতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে কীট প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে অধিক মাত্রার কীটনাশক দরকার হয়।
  2. স্বাস্থ্যঝুঁকি
    ফসলের অবশিষ্ট কীটনাশক মানুষের শরীরে গিয়ে ক্যানসার, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা তৈরি করছে।
  3. পরিবেশের ক্ষতি
    রাসায়নিক কীটনাশক মাটি ও পানিকে দূষিত করছে এবং উপকারী কীটপতঙ্গ যেমন মৌমাছি ও প্রজাপতির ক্ষতি করছে।
  4. রপ্তানি বাজারে বাধা
    ইউরোপ ও আমেরিকার মতো বাজারে বাংলাদেশি শাকসবজি ও ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের কারণে প্রায়ই সমস্যা হয়।

 

জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির ধরন

১. শিকারী কীট (Predators) ব্যবহার
  • লেডি বার্ড বিটল (Ladybird beetle) এফিড বা লিফ হপার দমন করে।
  • ড্রাগনফ্লাই ও ড্যামসেলফ্লাই ধানের ক্ষতিকর পোকা যেমন প্ল্যান্ট হপার দমন করে।
২. পরজীবী (Parasitoids) ব্যবহার
  • ট্রাইকোগ্রামা (Trichogramma) বোলওয়ার্মের ডিমে পরজীবী হয়ে ফসলকে রক্ষা করে।
  • ব্রাকোনিড বোলতা (Braconid wasp) শস্যক্ষেতে শুঁয়োপোকা দমন করে।
৩. প্যাথোজেন বা রোগজীবাণু ব্যবহার
  • ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (Bacillus thuringiensis বা Bt) শুঁয়োপোকা দমন করতে কার্যকর।
  • বভেরিয়া বাসিয়ানা (Beauveria bassiana) পোকায় সংক্রমণ ঘটিয়ে তাদের মেরে ফেলে।
  • এনটোমোপ্যাথোজেনিক নিমাটোড মাটিতে বসবাসকারী কীট দমন করে।
৪. ফেরোমন ট্র্যাপ
  • ফেরোমন ব্যবহার করে ক্ষতিকর কীটকে ফাঁদে ফেলে ধ্বংস করা যায়। ধানের পোকা ও সবজি ক্ষেতের ফলছিদ্রকারী পোকায় এটি কার্যকর।
৫. সাংস্কৃতিক পদ্ধতি
  • ফসলের আবর্তন (Crop rotation)
  • প্রতিরোধী জাত ব্যবহার
  • সঠিক সময়ে বপন ও কাটাই
  • আগাছা নিয়ন্ত্রণ

 

বাংলাদেশে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো—

  • ধানক্ষেতে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার: ধানের মাজরা পোকা ও পাতাফড়িং নিয়ন্ত্রণে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • সবজি ক্ষেতে ট্রাইকোগ্রামা রিলিজ: বাঁধাকপি, ফুলকপি ও বেগুনের ফসলকে লার্ভা আক্রমণ থেকে রক্ষা করছে।
  • Bt স্প্রে: বাঁধাকপি ও টমেটোর ফলছিদ্রকারী পোকা দমনে কার্যকর।
  • বায়োপেস্টিসাইড: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নীমভিত্তিক জৈব কীটনাশক দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।

 

কৃষকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা

যদিও কৃষকদের মধ্যে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি, তবে বিভিন্ন প্রকল্প ও সচেতনতা কর্মসূচির কারণে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষকেরা উপলব্ধি করছেন যে এটি—

  • কম খরচে
  • পরিবেশবান্ধব
  • দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান

 

সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ

  1. কৃষকের অজ্ঞতা: অধিকাংশ কৃষক জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত নন।
  2. বাজারজাতকরণ সমস্যা: জৈব কীটনাশক ও বায়োপেস্টিসাইড সহজলভ্য নয়।
  3. ধৈর্য্যের অভাব: রাসায়নিক কীটনাশকের মতো তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় না।
  4. গবেষণা বিনিয়োগের অভাব: প্রযুক্তিকে আরও কার্যকর করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি।

 

সম্ভাবনা

  • রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য বৃদ্ধি
  • পরিবেশ সংরক্ষণ জীববৈচিত্র্য রক্ষা
  • জনস্বাস্থ্যের উন্নতি
  • কৃষকের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস

 

ভবিষ্যৎ করণীয়

  1. কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  2. স্থানীয়ভাবে জৈব নিয়ন্ত্রণ উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা।
  3. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গবেষণা ও প্রচার বাড়ানো।
  4. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া।

 

মাটি

 

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি শুধু একটি বিকল্প নয়, বরং একটি অপরিহার্য পথ। রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এই প্রযুক্তির বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।