বাংলাদেশের কৃষিতে টিস্যু কালচার: সম্ভাবনা, অর্জন ও ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের কৃষি খাত ক্রমশ আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রচলিত কৃষি পদ্ধতির পাশাপাশি এখন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী গবেষণা কৃষিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো টিস্যু কালচার প্রযুক্তি। এটি এক ধরনের জৈবপ্রযুক্তি (Biotechnology) যেখানে উদ্ভিদের অঙ্গ বা টিস্যুর একটি ক্ষুদ্র অংশ ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বৃদ্ধি করে নতুন গাছ তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশে টিস্যু কালচার শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি কৃষকদের জন্য কার্যকর একটি প্রযুক্তি হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আলু, কলা, অর্কিড, চা এবং বিভিন্ন ফুল ও ফল চাষে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে টিস্যু কালচার

 

টিস্যু কালচার

 

টিস্যু কালচারের ইতিহাস সূচনা

বিশ্বে টিস্যু কালচার গবেষণা শুরু হয় ২০শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে, তবে গবেষণার প্রকৃত অগ্রগতি ঘটে ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA)-এর উদ্যোগে।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (IBGE), এবং অনেক বেসরকারি টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি সফলভাবে কাজ করছে।

 

টিস্যু কালচারের প্রক্রিয়া

টিস্যু কালচার একটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া যা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. এক্সপ্লান্ট সংগ্রহ (Explant Collection): উদ্ভিদের কুঁড়ি, কান্ড, পাতার অংশ বা কন্দ থেকে টিস্যু নেওয়া হয়।
  2. স্টেরিলাইজেশন: টিস্যু জীবাণুমুক্ত করা হয় যাতে কোনো ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি না পায়।
  3. কালচার মিডিয়াতে স্থাপন: পুষ্টি ও হরমোনসমৃদ্ধ মিডিয়াতে টিস্যু রাখা হয়।
  4. শুট রুট ডেভেলপমেন্ট: টিস্যু থেকে অঙ্কুরোদ্গম ও শিকড় গজানো শুরু হয়।
  5. অ্যাক্লিমাটাইজেশন: ল্যাবের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে গাছগুলোকে ধীরে ধীরে বাইরে মানিয়ে নেওয়া হয়।
  6. ক্ষেতে প্রতিস্থাপন: চারা মাঠে রোপণ করা হয় এবং সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ গাছ হয়।

 

বাংলাদেশের কৃষিতে টিস্যু কালচারের ব্যবহার

. আলু উৎপাদনে টিস্যু কালচার

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম আলু উৎপাদক দেশ। তবে আলুতে ভাইরাস ও রোগবালাইয়ের সমস্যা বেশি।

  • টিস্যু কালচার দ্বারা ভাইরাসমুক্ত আলুর চারা উৎপাদন সম্ভব।
  • বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) প্রতিবছর লাখ লাখ টিস্যু কালচার আলু চারা উৎপাদন করছে।
  • এর ফলে উৎপাদনশীলতা ২০–৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
. কলা উৎপাদনে টিস্যু কালচার

বাংলাদেশে কলা একটি জনপ্রিয় ফল। কিন্তু দেশীয় জাতগুলো রোগবালাইয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল রোগমুক্ত কলার চারা উৎপাদন হচ্ছে।
  • বর্তমানে কলা চাষিদের মধ্যে এই চারার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
  • প্রতি বছর কয়েক কোটি টিস্যু কালচার কলার চারা বাজারজাত করা হচ্ছে।
. ফুল শোভাবর্ধন উদ্ভিদ

অর্কিড, গ্লাডিওলাস, গোলাপ ইত্যাদি ফুলের টিস্যু কালচার চারা দেশে ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে।

  • ঢাকার আশেপাশে অনেক নার্সারি ও প্রাইভেট ল্যাব টিস্যু কালচার ফুলের ব্যবসা করছে।
  • এটি রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠছে।
. চা শিল্পে টিস্যু কালচার

চা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী রপ্তানি পণ্য।

  • টিস্যু কালচারের মাধ্যমে রোগমুক্ত, মানসম্মত এবং সমজাতীয় চা চারা উৎপাদন হচ্ছে।
  • এটি দেশের চা শিল্পকে আধুনিকায়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
. অন্যান্য ব্যবহার
  • আখ, আদা, হলুদ, মশলা ফসল ও ওষুধি গাছের জন্যও টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।
  • বনায়নে দ্রুতবর্ধনশীল গাছ উৎপাদনে এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ।

 

টিস্যু কালচারের সুবিধা

  1. রোগমুক্ত চারা পাওয়া যায়।
  2. অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক চারা উৎপাদন করা যায়।
  3. সমজাতীয় (Uniform) উদ্ভিদ উৎপাদন হয়।
  4. উন্নতমানের ফলন পাওয়া যায়।
  5. দুর্লভ বা বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণ সম্ভব।

 

চ্যালেঞ্জ সীমাবদ্ধতা

যদিও টিস্যু কালচার অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, তারপরও কিছু সমস্যা রয়েছে:

  • উচ্চ খরচ: টিস্যু কালচার ল্যাব স্থাপন ব্যয়বহুল।
  • প্রশিক্ষণ ঘাটতি: দক্ষ জনবল স্বল্পতা রয়েছে।
  • মান নিয়ন্ত্রণ: অনেক বেসরকারি ল্যাব নিম্নমানের চারা সরবরাহ করে।
  • প্রসারণের সমস্যা: গ্রামীণ কৃষকদের কাছে এখনও এই প্রযুক্তি পুরোপুরি পৌঁছায়নি।

 

সরকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

  • সরকার কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে টিস্যু কালচার চারা সরবরাহ করছে।
  • BRRI, BINA, BARI নিয়মিত নতুন জাত ও প্রযুক্তি উন্নয়ন করছে।
  • বেসরকারি খাত যেমন লাল তীর সীড, ইবনে সিনা এগ্রো, নবীন এগ্রো ইত্যাদি টিস্যু কালচার চারার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।

 

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশের কৃষিতে টিস্যু কালচার ভবিষ্যতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

  • রপ্তানি বাজার: কলা, অর্কিড ও আলুর চারা বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
  • কৃষি শিল্পে ব্যবহার: প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য উৎপাদনে টিস্যু কালচার ভূমিকা রাখবে।
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: খরা, লবণাক্ততা ও রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন সম্ভব হবে।
  • স্মার্ট এগ্রিকালচার: ডিজিটাল কৃষির সঙ্গে সমন্বয় করে টিস্যু কালচার কৃষিকে টেকসই করবে।

 

টিস্যু কালচার

 

বাংলাদেশের কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে টিস্যু কালচার একটি অনন্য প্রযুক্তি। আলু, কলা, ফুল, চা এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসলে এর ব্যবহার প্রমাণ করেছে যে, এ প্রযুক্তি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষক জীবিকা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

তবে এ খাতকে আরও এগিয়ে নিতে হলে মান নিয়ন্ত্রণ, দক্ষ জনবল সৃষ্টি এবং সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। যথাযথ বিনিয়োগ ও নীতিগত সহায়তা পাওয়া গেলে বাংলাদেশের কৃষিতে টিস্যু কালচার হবে একটি গেম চেঞ্জার প্রযুক্তি