বাংলাদেশের কৃষি বৈচিত্র্যময়। এ দেশের মাঠে শস্য, ফল, সবজি, পশু, পোল্ট্রি ও মৎস্যের অসংখ্য দেশীয় জাত (Indigenous Varieties) যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। এ জাতগুলো স্থানীয় পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে মানানসই এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষকের হাতে লালিত। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উচ্চফলনশীল জাত (HYV) এবং বৈশ্বিক বাজারের চাপে অনেক দেশীয় জাত আজ বিলুপ্তির পথে।
দেশীয় জাত সংরক্ষণ শুধু ঐতিহ্য রক্ষার জন্য নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, জিনগত বৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের কৃষিতে দেশীয় জাত সংরক্ষণ
দেশীয় জাত কী?
দেশীয় জাত বলতে বোঝায়—কোনো ফসল, পশু বা মাছের সেই জাত, যা প্রাকৃতিকভাবে বা কৃষকের হাতে স্থানীয়ভাবে বহু প্রজন্ম ধরে টিকে আছে। এ জাতগুলো সাধারণত পরিবেশ সহনশীল, স্বাদে ও গুণে অনন্য, যদিও উৎপাদনশীলতা অনেক সময় কম হয়।
উদাহরণ:
- ধান: কালোজিরা, লালচিনি, চিঙ্গরি, দুধকলম।
- গম: স্থানীয় গমের পুরোনো জাত।
- ফলমূল: দেশি আম (ল্যাংড়া, গোপালভোগ), কলা (কাঠালিপাকা, শবরি)।
- সবজি: দেশি লাউ, করলা, কুমড়া।
- পশুপালন: দেশি গরু, ছাগল, মুরগি।
- মৎস্য: ইলিশ, শিং, মাগুর, দেশি কার্প।
দেশীয় জাতের গুরুত্ব
১. জিনগত বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার
দেশীয় জাত হলো কৃষির জিনব্যাংক। এ জাতগুলোর জিন ভবিষ্যতের নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজে লাগে।
২. পরিবেশ সহনশীল
- লবণাক্ত মাটিতে সহনশীল ধান।
- খরা সহনশীল গম বা ভুট্টা।
- জলাবদ্ধ এলাকায় অভিযোজিত দেশি মাছ।
৩. খাদ্য ও পুষ্টিগুণ
দেশি জাতের শস্য ও ফল স্বাদে ও গন্ধে অনন্য, পুষ্টিগুণও অনেক সময় উন্নত। যেমন—দেশি ধানের চাল সহজপাচ্য, দেশি গরুর দুধে বেশি ক্যালসিয়াম।
৪. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
পান্তা ভাত, খিচুড়ি, পিঠা—এসব খাবারের আসল স্বাদ দেশি ধানের চালেই পাওয়া যায়। দেশীয় জাত তাই কেবল কৃষির নয়, সংস্কৃতিরও অংশ।
৫. কৃষকের নিরাপত্তা
দেশি জাত সাধারণত কম সার, কম কীটনাশক ও কম যত্নেই উৎপাদন সম্ভব। দরিদ্র কৃষকদের জন্য এগুলো টেকসই বিকল্প।
দেশীয় জাতের বর্তমান অবস্থা
ধানের দেশীয় জাত
বাংলাদেশে একসময় প্রায় ১০,০০০ এরও বেশি দেশি ধানের জাত ছিল। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে ২০০–৩০০ জাতের মতো। অধিকাংশ অঞ্চল এখন BRRI বা HYV জাতনির্ভর।
গম ও ভুট্টা
দেশীয় জাত প্রায় হারিয়ে গেছে। আধুনিক জাতই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
ফলমূল ও সবজি
- দেশি আম, কলা, কাঁঠাল এখনো জনপ্রিয়।
- তবে অনেক দেশি সবজি বিলুপ্তির পথে।
পশুপালন ও মৎস্য
- দেশি গরু (লাল সিন্ধি, দেশি জাত) এখনো টিকে আছে, তবে ক্রসব্রিড গরুর দাপট বেশি।
- দেশি মুরগি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির আধিপত্য বেড়েছে।
- দেশি মাছ যেমন শিং, মাগুর, টেংরা অনেক এলাকায় বিলুপ্তির পথে।
দেশীয় জাত হারিয়ে যাওয়ার কারণ
- উচ্চফলনশীল জাতের চাপ – HYV জাতের উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকের ঝোঁক বেড়েছে।
- বাজার অর্থনীতি – বাজারে বেশি ফলনশীল জাত লাভজনক।
- সংরক্ষণের অভাব – দেশীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা দুর্বল।
- গবেষণার ঘাটতি – গবেষণায় আধুনিক জাতের দিকে বেশি নজর, দেশীয় জাত অবহেলিত।
- জলবায়ু পরিবর্তন – বন্যা, খরা ও লবণাক্ততার কারণে অনেক দেশি জাত হারিয়ে গেছে।
দেশীয় জাত সংরক্ষণের উপায়
১. বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
- জাতীয় বীজ ভাণ্ডার (Gene Bank) শক্তিশালী করা।
- প্রতিটি জেলায় “Local Seed Bank” তৈরি করা।
২. কৃষক–নেতৃত্বাধীন সংরক্ষণ
- কৃষকদের হাতে থাকা দেশীয় জাত সংগ্রহ করে পুনরায় চাষে উৎসাহ দেওয়া।
- “কৃষক বীজ ভাণ্ডার” তৈরি করা।
৩. গবেষণা ও উদ্ভাবন
- BRRI, BINA, BARI-এর গবেষণায় দেশীয় জাত অন্তর্ভুক্ত করা।
- দেশীয় জাতকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে নতুন হাইব্রিড তৈরি করা।
৪. নীতি সহায়তা
- সরকারিভাবে দেশীয় জাত চাষে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া।
- সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নেওয়া।
৫. বিপণন ও ব্র্যান্ডিং
- দেশীয় ধান, দেশি গরুর দুধ বা দেশি মুরগির ডিম আলাদা ব্র্যান্ডে বাজারজাত করা।
- ভোক্তাদের সচেতন করা যে দেশি জাত পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত।
সফল উদাহরণ
দেশি ধান সংরক্ষণ
কিছু এলাকায় কৃষকরা এখনো কালোজিরা, লালচিনি, চিঙ্গরি ধান চাষ করছে। এগুলো স্থানীয় বাজারে ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে।
দেশি গরু
কুরবানির ঈদে দেশি গরুর চাহিদা সবসময় বেশি থাকে। সরকার দেশি জাত উন্নয়নে “পশু উন্নয়ন প্রকল্প” নিয়েছে।
দেশি মাছ
“জাতীয় মাছ ইলিশ” সংরক্ষণের ফলে উৎপাদন বেড়েছে। একইভাবে দেশি কার্প মাছ পুনরায় চাষে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
- ভারতে ন্যাশনাল ব্যুরো অব প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস (NBPGR) দেশীয় জাত সংরক্ষণ করছে।
- ফিলিপাইনে IRRI (International Rice Research Institute) দেশীয় ধান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে।
বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশীয় জাত সংরক্ষণকে শক্তিশালী করতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: দেশীয় জাতের বৈশিষ্ট্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজে লাগবে।
- টেকসই কৃষি: কম সার, কম পানি ব্যবহার করে দেশি জাত চাষ সম্ভব।
- রপ্তানি সম্ভাবনা: দেশি ধান, দেশি ফল বা দেশি মুরগির মাংস আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ ব্র্যান্ড হতে পারে।
- খাদ্য বৈচিত্র্য: দেশীয় জাত ভবিষ্যতে ভোক্তাদের জন্য নতুন বিকল্প যোগাবে।
বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের মূল শেকড় লুকিয়ে আছে দেশীয় জাতের ভাণ্ডারে। এগুলো হারিয়ে গেলে শুধু খাদ্য বৈচিত্র্যই নয়, বরং কৃষির জিনগত নিরাপত্তাও হারাবে। তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ—কৃষক, গবেষক, নীতি-নির্ধারক ও ভোক্তাদের একসঙ্গে কাজ করা।
দেশীয় জাত সংরক্ষণ মানে কেবল অতীতকে রক্ষা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।