বাংলাদেশের কৃষির জন্য জলাবদ্ধতা মোকাবিলা কৌশল

বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। দেশের প্রায় ৬৫% মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি এবং অতিবর্ষণজনিত কারণে বাংলাদেশে জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে কিংবা অপরিকল্পিত সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে কৃষিজমি দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে ডুবে থাকে। এর ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। তাই জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক ও টেকসই কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশের কৃষির জন্য জলাবদ্ধতা মোকাবিলা কৌশল

 

মাটির গঠন

 

. জলাবদ্ধতার প্রকারভেদ প্রভাব

. স্বাভাবিক জলাবদ্ধতা
বর্ষার সময় অতিবৃষ্টির কারণে সাময়িকভাবে জমিতে পানি জমে থাকে, যা সাধারণত ৭-১০ দিনের মধ্যে নেমে যায়। এটি আংশিক ক্ষতিকর হলেও কখনও কখনও মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

. দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা
কিছু এলাকায় নদীর পাড় ভেঙে যাওয়া, অপরিকল্পিত সড়ক বা বাঁধ নির্মাণ, নিষ্কাশন খাল ভরাট হওয়ার কারণে জমি মাসের পর মাস পানির নিচে ডুবে থাকে। এতে প্রধানত আমন ধান, শাকসবজি, পাটসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়।

প্রভাব

  • ফসল উৎপাদন কমে যায়।
  • গবাদিপশুর খাদ্য সংকট হয়।
  • মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়।
  • কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হয়।
  • দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

 

. জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় কৃষি কৌশল

. জলাবদ্ধতা সহনশীল ফসল চাষ

  • গভীরজল ধান (Deepwater rice): যেমন ভাসমান ধান বা স্থানীয় জাত।
  • সহনশীল শস্য: যেমন ভুট্টা, খেসারি, আলু, কচু, শাকসবজি।
  • অভিযোজনশীল জাত: কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) কর্তৃক উদ্ভাবিত জলাবদ্ধতা সহনশীল ধান যেমন ব্রি ধান ৫২, ব্রি ধান ৭১ ইত্যাদি।

. ভাসমান কৃষি (Floating agriculture)
বর্ষাকালে ভেলায় ফসল চাষের কৌশল। পানির উপর কচুরিপানা বা খড় দিয়ে ভাসমান বিছানা তৈরি করে সবজি, ধান ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করা হয়। বরিশাল, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা অঞ্চলে এটি প্রচলিত।

. উঁচু বেডে চাষ (Raised bed cultivation)
মাঠে ছোট উঁচু বেড তৈরি করে শাকসবজি বা ডাল চাষ করলে পানি জমলেও ফসল নষ্ট হয় না।

. মিশ্র ফসল চাষ (Mixed cropping)
একই জমিতে জলাবদ্ধতা সহনশীল ও অ-সহনশীল ফসল একসাথে চাষ করলে একটির ক্ষতি হলেও অন্যটি রক্ষা পায়।

. ফসলের ক্যালেন্ডার পরিবর্তন
বৃষ্টিপাতের সময় বিবেচনা করে বপন/রোপণ সময় পরিবর্তন করা। যেমন আগে বা পরে ধান রোপণ করে জলাবদ্ধতা এড়ানো।

 

. অবকাঠামোগত কৌশল

. খাল খনন পুনঃখনন
গ্রামীণ খাল-নালা পুনঃখনন করলে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হয়। স্থানীয় পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

. সেচ নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন
সেচের পাশাপাশি পানি বের হওয়ার পথও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়ন, স্লুইসগেট ও পাম্প স্থাপন কার্যকর হতে পারে।

. বাঁধ কালভার্ট নির্মাণ
অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা ও কালভার্ট জলাবদ্ধতা বাড়ায়। তাই পরিকল্পিতভাবে প্রকৌশল নকশা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন।

 

. প্রযুক্তিগত কৌশল

. তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

  • আবহাওয়া পূর্বাভাস ভিত্তিক কৃষি ক্যালেন্ডার তৈরি।
  • উপগ্রহ তথ্য ব্যবহার করে জলাবদ্ধতার পূর্বাভাস।
  • কৃষকদের মোবাইল এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রেরণ।

. গবেষণা উদ্ভাবন

  • জলাবদ্ধতা সহনশীল ধান ও সবজি জাত উদ্ভাবন।
  • জলাবদ্ধ পরিবেশে উপযোগী চাষাবাদ প্রযুক্তি উন্নয়ন।

 

. কৃষক প্রশিক্ষণ সচেতনতা

কৃষকদের জলাবদ্ধতা মোকাবিলার জ্ঞান ও দক্ষতা দেওয়া জরুরি। এজন্য:

  • কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ।
  • কৃষক মাঠ স্কুল (Farmer Field School) পরিচালনা।
  • গ্রামীণ কৃষক ক্লাব গঠন।

 

. সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল

. স্থানীয় সরকার কমিউনিটি উদ্যোগ
স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ ও কৃষক কমিউনিটির যৌথ উদ্যোগে খাল খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব।

. সরকারিবেসরকারি সহযোগিতা
সরকারি সংস্থা, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় জলাবদ্ধতা মোকাবিলা কার্যক্রম শক্তিশালী করা যায়।

. নীতি পরিকল্পনা
জাতীয় পর্যায়ে জলাবদ্ধতা মোকাবিলা কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি কৃষি নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

 

. জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় সাফল্যের উদাহরণ

  • গোপালগঞ্জ: ভাসমান কৃষি মডেল এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
  • সুনামগঞ্জ: হাওর এলাকায় গভীরজল ধান চাষ।
  • সিরাজগঞ্জ: খাল পুনঃখনন করে পানি নিষ্কাশন সহজীকরণ।

 

. ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ করণীয়

  • জলবায়ু পরিবর্তন: অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় বেড়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সমস্যা আরও তীব্র হতে পারে।
  • নগরায়ণ অবকাঠামো চাপ: কৃষিজমি দখল ও জলাধার ভরাট বাড়ছে।
  • প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: সমন্বয়ের অভাব ও বাজেট ঘাটতি।

করণীয়

  • টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ।
  • কৃষকদের বিকল্প জীবিকা (পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ) নিশ্চিত করা।
  • আন্তর্জাতিক সহায়তা ও গবেষণা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।

 

মাটি

 

বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তন, নদী অববাহিকা এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা। তবে বৈজ্ঞানিক কৃষি কৌশল, প্রযুক্তি ব্যবহার, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। জলাবদ্ধতা সহনশীল ফসল চাষ, ভাসমান কৃষি, খাল পুনঃখনন, আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবহারের মতো উদ্যোগ কৃষিকে আরও স্থিতিশীল করবে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ জলাবদ্ধতাজনিত কৃষি ক্ষতি কাটিয়ে উঠে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের উন্নয়নে এগিয়ে যেতে পারবে।