বাংলাদেশের জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। খাদ্য নিরাপত্তা, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উন্নয়নের সঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সারের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও এর অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে, মাটির উর্বরতা কমাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই প্রেক্ষাপটে জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষিতে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপায় হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

 

বাংলাদেশের জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার

 

জৈব সারের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

জৈব সার হলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত সেইসব সার যা জৈব পদার্থের (গাছের পাতা, গোবর, কম্পোস্ট, বায়োগ্যাস স্লারি, ফসলের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি) পচন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি হয়। রাসায়নিক সারের তুলনায় এগুলো মাটির প্রাকৃতিক গুণাবলি রক্ষা করে এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশে প্রচলিত জৈব সারের কয়েকটি ধরণ হলো:

  1. গোবর সার – গরু, মহিষ বা অন্যান্য গবাদি পশুর মলমূত্র থেকে উৎপন্ন।
  2. কম্পোস্ট সার – পচা শাকসবজি, ফসলের অবশিষ্টাংশ, পাতা ও অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে তৈরি।
  3. বায়োগ্যাস স্লারি – বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে গ্যাস উৎপাদনের পর অবশিষ্টাংশ।
  4. ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) – কেঁচোর মাধ্যমে জৈব পদার্থ পচিয়ে তৈরি উচ্চমানের সার।
  5. সবুজ সার – ডাল জাতীয় গাছ যেমন সানহেম্প, ঢেঁড়শ ইত্যাদি জমিতে চাষ করে পরে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

 

জৈব সার উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে কৃষকেরা গোবর সার ব্যবহার করলেও বিগত কয়েক দশকে রাসায়নিক সারের প্রাপ্যতা ও দ্রুত ফলাফল পাওয়ার কারণে এর ব্যবহার বেড়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জৈব সার উৎপাদনে উৎসাহ দিচ্ছে।

  • গৃহস্থালি পর্যায়ে: শহর ও গ্রামে রান্নাঘরের বর্জ্য, ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করে অনেক পরিবার কম্পোস্ট সার তৈরি করছে।
  • বাণিজ্যিক পর্যায়ে: দেশে বর্তমানে শতাধিক নিবন্ধিত জৈব সার কারখানা রয়েছে। এরা বছরে কয়েক লাখ টন কম্পোস্ট ও কেঁচো সার উৎপাদন করে বাজারজাত করছে।
  • সরকারি উদ্যোগ: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সহায়তা ও ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে।
  • এনজিও সমবায় সংস্থা: অনেক এনজিও কৃষকদের জৈব সার উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করছে এবং বাজার সংযোগ তৈরি করছে।

 

জৈব সার ব্যবহারের উপকারিতা

  1. মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা: জৈব সার মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, মাটিকে ঝুরঝুরে করে এবং পানিধারণ ক্ষমতা বাড়ায়।
  2. পুষ্টি উপাদান সরবরাহ: এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র উপাদান থাকে যা ফসলের জন্য প্রয়োজনীয়।
  3. পরিবেশবান্ধব: রাসায়নিক সারের মতো ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ ঘটায় না এবং কার্বন নিঃসরণ কমায়।
  4. খরচ সাশ্রয়ী: স্থানীয়ভাবে উৎপাদনযোগ্য হওয়ায় কৃষকেরা কম খরচে ব্যবহার করতে পারে।
  5. দীর্ঘমেয়াদি উর্বরতা: জৈব সার ধীরে ধীরে পুষ্টি সরবরাহ করে, ফলে মাটির উর্বরতা দীর্ঘদিন বজায় থাকে।
  6. স্বাস্থ্য সুরক্ষা: জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক অবশিষ্টাংশমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়।

 

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব সার ব্যবহারের অবস্থা

বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সারের আধিক্য থাকলেও জৈব সারের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়ছে।

  • ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, শাকসবজি ও ফলের চাষে জৈব সার ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • সবজি ও ফলচাষে কৃষকেরা কেঁচো সার ও কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে ভালো ফল পাচ্ছেন।
  • জৈব ধান ও শাকসবজি চাষ করে অনেক কৃষক বাড়তি দাম পাচ্ছেন।
  • শহরাঞ্চলে ছাদবাগান ও কনটেইনার ফার্মিংয়ে জৈব সারের ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে।

 

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

যদিও জৈব সার ব্যবহারের উপকারিতা অনেক, তারপরও এর ব্যাপক প্রচলন এখনো সীমিত। এর পেছনে কিছু কারণ হলো:

  1. উৎপাদনের স্বল্পতা – কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী জৈব সার পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
  2. মান নিয়ন্ত্রণের অভাব – বাজারে অনেক সময় নিম্নমানের বা অপদ্রব্যযুক্ত সার পাওয়া যায়।
  3. সচেতনতার ঘাটতি – অনেক কৃষক এখনো মনে করেন রাসায়নিক সার ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়।
  4. সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া – জৈব সার তৈরি করতে সময় লাগে এবং দ্রুত ফল পাওয়া যায় না।
  5. সংরক্ষণ পরিবহন সমস্যা – জৈব সার আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল হওয়ায় সংরক্ষণে সমস্যা হয়।

 

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশে জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

  • প্রতি বছর প্রায় ২০০–২৫০ মিলিয়ন টন কৃষি অবশিষ্টাংশ উৎপন্ন হয়, যা ব্যবহার করলে বিপুল পরিমাণ জৈব সার পাওয়া সম্ভব।
  • গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি, যাদের গোবর ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সার উৎপাদন করা যায়।
  • বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করলে একদিকে গ্যাস পাওয়া যাবে, অন্যদিকে উচ্চমানের সার পাওয়া যাবে।
  • বিশ্ববাজারে জৈব খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, যা বাংলাদেশের কৃষিকে রপ্তানিমুখী করতে পারে।

 

করণীয় ও সুপারিশ

  1. সরকারি নীতি সহায়তা: জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি, স্বল্পসুদে ঋণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
  2. কৃষক প্রশিক্ষণ: মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জৈব সার তৈরির সহজ পদ্ধতি শেখানো উচিত।
  3. গবেষণা প্রযুক্তি উন্নয়ন: নতুন ধরনের কার্যকর জৈব সার তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা বাড়াতে হবে।
  4. বাজারজাতকরণ: কৃষকের উৎপাদিত জৈব সার যেন সহজে বিক্রি করা যায় সে জন্য বাজার কাঠামো তৈরি করতে হবে।
  5. সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জৈব সারের গুরুত্ব প্রচার করা প্রয়োজন।
  6. পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব: সরকার, বেসরকারি খাত ও এনজিও একসঙ্গে কাজ করলে জৈব সার উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

 

উপসংহার

বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার অপরিহার্য। রাসায়নিক সার হয়তো দ্রুত ফল দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে। অন্যদিকে জৈব সার মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে, ফসলকে পুষ্টি জোগায় এবং মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করে। তাই জৈব সারকে প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে জাতীয় কৃষি নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে।

সারসংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষির টেকসই উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জৈব সার উৎপাদন ব্যবহার বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি।